কিশলয় হোমে ক্রিকেটে মজে কিশোরেরা। নিজস্ব চিত্র
এক সময়ে ছিল কারাগার। আজ সেই উঁচু প্রাচীরের ভিতরে পালং, কপির সবুজ, কিশোর চারা শীতের নরম রোদে চকচক করছে।
অনেকটা জায়গা জুড়ে খেত। পাঁচিলের গা ধরে, টানা...। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টোম্যাটো, বেগুন, লঙ্কা— কোথাও আবার শিমের মাচার নীচে লাল শাক। সেই সব ফসলের পাশেপাশে কয়েক জন কিশোর। এই ফসল হাতে তৈরি তাদের। দূরে দোতলা বাড়িটার কয়েকটা ঘরে ক্লাস চলছে। ক্লাসঘরের দেওয়ালগুলোতে ছবি আঁকা। ঘরবাড়ি, গাছ, সান্তা ক্লজ়ের। বেঞ্চে, কোথাও আবার মাটিতেই বসে পড়ুয়ারা। শিক্ষক-শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন। হইচই বিশেষ নেই। একটু দূরেই চওড়া রাস্তায় উইকেট বসিয়ে চলছে ক্রিকেট। মাঠ নেই, তাতে কী! যে টুকু জায়গা, তাকেই ব্যবহার করে খেলার প্রস্তুতি।
বারাসতের কিশলয় শিশু আবাসে সকাল থেকে এ ভাবেই দিন কাটছে প্রায় একশো জন শিশু-কিশোরের।
৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের জন্য রাজ্য সরকারের হোম। হারিয়ে যাওয়া শিশুদের ঠিকানা। শুধু ভারত নয়, রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলিরও কয়েক জন। ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরেরা আবাসিক এখানকার। পুরনো পথ বদলে ভবিষ্যতের জন্য তাদের প্রস্তত করার চেষ্টা করতেই এত কিছুর আয়োজন।
কয়েক বছর আগেও পরিস্থিতি অবশ্য এমন ছিল না। খাবার আর থাকার পরিবেশ নিয়ে অজস্র অভিযোগ— দমবন্ধ পরিবেশে আটকে থাকতে থাকতে অনেক কিশোরই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। সফলও হত কেউ কেউ। এমনকি, আত্মহত্যার চেষ্টাও হয়েছে। এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আবাসিকদের অভিযোগে নজর দিয়ে, তাদের জীবনে নিয়ে আসা হয়েছে নতুন পাঠ। ফুল, আনাজের বাগান। মাশরুম চাষ আর পশুপালন। আবাসিকদের মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। অব্যবহৃত, অন্ধকার ঘর ব্যবহার করে বসানো হয়েছে সারি সারি মাশরুমের ব্যাগ। সুপার মলয় চট্টোপাধ্যায়ের গলায় গর্বের সুর। বললেন, ‘‘শুধু সরকারি টাকায় নয়, নিজেদের হাতে ফলানো ফসলও এখন খেতে
পারছে ছেলেরা।’’
কয়েক বছর ধরেই ধীরে ধীরে পাল্টে গিয়েছে শিশু আবাসের পরিস্থিতি, দাবি করছেন সুপার। জানালেন, পালানোর সংখ্যা কমে গিয়েছে। গত বছর এক জন কিশোর পালিয়েছিল। তার পর থেকে তেমন ঘটনা আর ঘটেনি। বরং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিভাগে প্রতিযোগিতা, ক্যারাটে প্রতিযোগিতাতেও পুরস্কার জিতছে কিশলয়ের ছেলেরা। বাইরের স্কুলেও পড়তে যাচ্ছে দশ জন।
আবাসিকদের বয়স ১৮ হয়ে গেলেই চলে যেতে হবে— এমন নিয়মে ক্ষোভ ছিল বিস্তর। তার সমাধানেরও চেষ্টা হয়েছে। শিশু আবাসের পুরনো বাসিন্দাদের ৯ জন এখন এখানেই কাজ করে। অন্য অনেককেই বিভিন্ন কাজে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠী।
তবে কিশলয়ের যাতায়াতের দরজা এখনও সেই জেলখানার মতোই। নজরদারি, নিয়ম মেনে গেট বন্ধ। মাথা নিচু করে গরাদ ঠেলে ঢুকতেই সুপারকে ঘিরে ধরে কয়েক জন শিশু। স্যর, কবে বাড়ি যাব? কবে যাব স্যর? আকাশের দিকে মুখ তুলে স্যর তখন বোবা। শিশুরা হেঁটে চলে পাশে পাশে।
জুটে গিয়েছে কয়েক জন কিশোরও। নিচু গলায় এক জন বলল, ‘‘যা বলবেন, তাই করে দেব স্যর। শুধু ওই জিনিসটা দিন।’’ সুপার প্রশ্নচোখে তাকাতেই ছেলেটি বলে, ‘‘ওই যে, দূরবিন স্যর! বাইরেটা দেখব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy