গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
রাজনীতির রং ভুলে তৈরি হয়েছিল সহানুভূতির হাওয়া। কিন্তু, তাপস পালের মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুলতেই খানিকটা বদলে গেল পরিস্থিতি। রবীন্দ্র সদনে দাঁড়িয়ে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী দাবি করলেন, বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হতে হল তাপসকে। এর পরেই বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস-সহ এ রাজ্যের সব বিরোধী দল তীব্র নিন্দা শুরু করল মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের। তাপস পালের মৃতদেহকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন মমতা— মন্তব্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় থেকে রাজ্যের বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলেরই।
তাপস পালকে শ্রদ্ধা জানাতে এ দিন রবীন্দ্র সদনে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই তিনি বলেন যে, তাপস পালকে প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়ে অকালে চলে যেতে হল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে তাপস পালকে গ্রেফতার করানো হয়েছিল এবং বিনা বিচারে এক বছর এক মাস হাজতে রেখে দেওয়া হয়েছিল বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের চেয়ারপার্সনের এই মন্তব্য তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে রাজনৈতিক শিবিরে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় তীব্র নিন্দা করেন মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি বলেন, ‘‘কোনও দিনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান ছিল না। এখনও যে হয়নি, এ দিন ফের তা প্রমাণ করলেন। আমি মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি।’’ বাবুলের কথায়, ‘‘তাপস পাল আগে এক জন শিল্পী, তার পরে এক জন রাজনীতিক। এক জন শিল্পীর মরদেহ শায়িত রয়েছে, সেখানে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন!’’ মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র নিন্দা করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, ‘‘কী ভাবে ধিক্কার জানাব বুঝতে পারছি না। এক জন শিল্পী শেষযাত্রায় শুয়ে আছেন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন।’’
তাপস পাল যখন হাজতে ছিলেন, এ দিন সে সময়ের কথাও টেনে এনেছেন বাবুল। তিনি বলেছেন, ‘‘তাপস পাল শুধু নন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁকে দেখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন। সে সময়ে তো পাশের ঘরেই তাপস পালও ছিলেন। তাঁকে দেখতে কেন সে দিন যাননি মুখ্যমন্ত্রী? এত দিন ধরে তাপস পাল ভুগছিলেন। অসুস্থ তাপস পালকে তখন কেন সাহারা দেননি মুখ্যমন্ত্রী?’’
আরও পডু়ন: তাপস রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, বিস্ফোরক মমতা
শিল্পী তাপস পালের পদস্খলন ঘটেছিল তৃণমূলে গিয়েই— এমন অভিযোগও এ দিন তুলেছেন বাবুল। প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের একটি মন্তব্য টেনে এনে বাবুল এ দিন বলেন, ‘‘কুণাল বলেছিলেন, যাঁরা তৃণমূলে যান, তাঁরাই কলুষিত হয়ে যান। ঠিকই বলেছিলেন। আর কলুষিত করার প্রক্রিয়ার মূল পান্ডা তো দিদি নিজেই।’’ আজ তাপসের জন্য যিনি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন, তাপসের দুঃসময়ে তিনি কতটা পাশে ছিলেন, সেটা তাপসের পরিবারকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে— এমন মন্তব্যও এ দিন করেছেন বাবুল সুপ্রিয়।
ঠিক একই অভিযোগ তুলেছেন সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, গত লোকসভা নির্বাচনে যে তাপস পালকে টিকিট দেওয়া হল না, তার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাপসের কোনও খোঁজখবর রাখেননি। তাপস পাল ব্যক্তিগত ভাবে অনেকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলতেন যে, তাঁর সঙ্গে আর কেউ যোগাযোগ রাখেন না, কেউ আর তাঁর খোঁজ রাখেন না।’’ বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ তথা লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরী মঙ্গলবার এই একই কথা বলেছিলেন। তাপস ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর কাছেও ওই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন বলে অধীর গতকাল জানান। অধীরের সেই কথা টেনে এ দিন তন্ময় বলেন, ‘‘অধীর চৌধুরী তো প্রকাশ্যেই বলেছেন কথাটা। এবং আমি মনে করি অধীর চৌধুরী সত্যি কথাই বলেছেন।’’
আরও পড়ুন: কেওড়াতলায় গান স্যালুট, চোখের জলে চির বিদায় তাপসকে
তাপস পালের প্রতি সহানুভূতি জানাতে অবশ্য বাম বিধায়ক রাজি নন। তিনি বলেন, ‘‘যে কোনও মৃত্যুর সংবাদ যখন আসে, তখন সেটা একটা শোকের সংবাদ। তখন সেটা মানুষের মধ্যে একটা দুঃখ বোধ তৈরি করে। কিন্তু যে শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে সেই দুঃখের অনুভূতি তৈরি হয়, আমার মধ্যে সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। কারণ তাপস পালের নাম মনে এলেই, নদিয়ার চৌমুহাতে তাঁর সেই কুখ্যাত বক্তৃতা আমার মনে পড়ে। সেই ধিক্কারের রেশ তো এত সহজে চলে যেতে পারে না। সুতরাং আমাকে যদি বলেন, আমি বলব, আমার অনুভূতির ভিতরে সেই ধিক্কারটাই রয়েছে।’’
কিন্তু এখানেই থামেননি তন্ময়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ দিনের মন্তব্যের সমালোচনাতেই বরং বেশি জোর দিয়েছেন তিনি। তন্ময় বলেছেন, ‘‘সমস্ত বিষয়ের মধ্যেই গিমিক নিয়ে আসা এবং রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করাটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভ্যাস। মুখ্যমন্ত্রী আজ যা বলেছেন, তা যদি মানতে হয়, তা হলে সিবিআই, সিআইডি সব তো তুলে দিতে হয়! মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে যে সব থানা বা পুলিশ রয়েছে, সে সবও বন্ধ করে দিতে হয়!’’ তন্ময়ের ব্যাখ্যা, ‘‘তাপস পালের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তার ভিত্তিতে তদন্তকারী সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছিল। এখন তাপস পালের মৃত্যু হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী বলবেন যে, ওই তদন্তের কারণেই মৃত্যু হল? আশ্চর্য! তা হলে কি দেশে বিভিন্ন অপরাধের তদন্তের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা তুলে দিতে হবে?’’
এ প্রসঙ্গেই রাজ্যের পুলিশকে আক্রমণ করে তন্ময় এ দিন বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ তো রোজ মিথ্যে মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করছে। নানা রকম মামলা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের থেকে টাকা তুলছে। থানাগুলো উনি আগে তুলে দিয়ে দেখান।’’
তাপস পালকে প্রয়োজনের সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবহার করেছেন, প্রয়োজন মিটে যাওয়ার পরে ছুড়ে ফেলেছেন, এখন আবার তাঁর মৃত্যুকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন— দাবি উত্তর দমদমের ওই সিপিএম বিধায়কের। তিনি বলেন, ‘‘তাপসী মালিককেও সিঙ্গুরে মমতা কাজে লাগিয়েছিলেন। কাজ মিটতেই ছুড়ে ফেলেছেন। সে কথা এখন তাপসী মালিকের বাবা বলছেন। তাপস পালের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।’’ তন্ময়ের কথায়, ‘‘আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন, তাতে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদকে অসম্মানিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর পদকে লজ্জিত করেছেন। আমাদের ভাবতে লজ্জা করছে যে, উনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।’’ তন্ময়ের প্রশ্ন, ‘‘কী বলতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী? তাপস পাল কি নির্দোষ ছিলেন? সুলতান আহমেদ নির্দোষ ছিলেন? প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দোষ? যদি সে কথাই বলতে চেয়ে থাকেন, তা হলে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করে দিন যে, ওঁদের কোনও দোষ ছিল না।’’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তাপস পালের দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার রাজনীতি শুরু করেছেন। তিনি থাকতে তাঁকে কেউ দেখতে যাননি। তাঁকে তাঁরা ছেঁটে ফেলেছিলেন। তাঁর কষ্টের সময়ে পরিবার ছাড়া আর কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু এখন তাঁর মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক লাভ করার চেষ্টা হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তাপস পালের এই দুর্গতির জন্য কে দায়ী? সম্পূর্ণ তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়ী। সব কিছুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি করেছেন। এখন হয়তো অন্যকে দায়ী করে নিজের পাপমুক্তির চেষ্টা করছেন। আমার মনে হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মগ্নানি থেকে এ সব কথা বলছেন।’’
কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেও তৃণমূলের ‘দ্বিচারিতা’র দিকে আঙুল তুলেছেন বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের সুবিধা মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগায়, তদন্তের গতি নিয়ন্ত্রণ করে, এগুলো একদমই ঠিক কথা। কিন্তু তৃণমূলের নীতি তো কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরোলে কিষাণজি! ভুবনেশ্বরে দলের এক জন সাংসদকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে গেলেন কিন্তু পাশের ঘরে থাকা তাপস পালকে দেখতে যাননি। তদন্ত সংস্থার হাত থেকে রাজীব কুমারকে বাঁচাতে ধর্নায় বসেছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দৌড়ে গিয়েছেন। তাপস পালের জন্য কী করেছেন?’’
একই সুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের প্রশ্ন, ‘‘মরদেহের সামনে এ সব কথা বলা আমাদের সংস্কৃতি নয়। সিবিআই বা ইডি-র অতি সক্রিয়তার কথা আমরা সবাই জানি। মানসিক যন্ত্রণা কি মুখ্যমন্ত্রী তাপসকে কম দিয়েছেন? সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভুবনেশ্বরে দেখা করলেও তাপসের সঙ্গে করেননি। সুদীপবাবুকে গত লোকসভায় আবার টিকিট দিয়েছেন। নির্দোষ মনে করে থাকলে তাপসকে কেন দেননি?’’ বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান আবার ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে গানের দু’কলি মনে করিয়ে দিয়েছেন— ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy