মহালয়ার আগের দিন, ঢাকেশ্বরী বৃদ্ধাশ্রমে। ছবি: পাপন চৌধুরী
‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে...’, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠটা শুনলেই যেন মনে হয় ‘মা এলেন’— শনিবার পরম যত্নে রেডিয়োটা মুছতে-মুছতে বলছিলেন সত্তরোর্ধ্ব ছবি মজুমদার। পশ্চিম বর্ধমানের বার্নপুরের ঢাকেশ্বরী বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক তিনি। তাঁর কথায় সঙ্গত দিলেন রিনা জোয়ারদার, বন্দনা বসু প্রমুখ। সবাই তখন যেন ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন মহালয়ার আড়-ভাঙা সকালের ছোটবেলাগুলো। ফিরে যাচ্ছেন অতীতে।
বৃদ্ধাশ্রমটির আশপাশে ঘন জঙ্গল। সামনে দিয়ে জলের ছোট একটি স্রোত বয়ে চলেছে। জঙ্গলে যেন সাদা তুলোর ভিড়, কাশের মেলা বসেছে। বৃদ্ধাশ্রমটিতে রয়েছেন ১৭ জন।
ওই আশ্রমে ঢুকতেই মনে হয় যেন, পরম মমতায় কিছু একা মানুষ জোট বেঁধেছেন। সেই জোট বাঁধার অনুভূতি থেকেই রিনা, বন্দনা বসু, সুকুমার রায়চৌধুরীরা বার বার আসছিলেন ছবির কাছে। একটাই জিজ্ঞাসা, ‘রেডিয়োটা ঠিক আছে তো?’ মুখের অভিজ্ঞ বলিরেখায় তখন যেন হাসি খেলে ছবির। রেডিয়ো ঝাড়পোঁছ করতে-করতে মাথা নেড়ে ইতিবাচক উত্তর দেন। বলেন, “সেই কোন ছোটবেলার অভ্যাস। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে, রেডিয়ো পাশে নিয়ে ঘুমোতে যাই। তার পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে দেবী-বন্দনা শুরু হলে, সজোরে তা চালিয়ে দিই। আমি, আমার মতো সবাই এক সঙ্গে শুনি মহালয়া।”— পাশে বসে থাকে রিনা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমই তাঁদের সংসার। পাশাপাশি, রেবা দত্ত নামে এক আবাসিক গত বার একটি রেডিয়ো উপহার পেয়েছেন। সেটাকে শনিবার সকাল থেকেই ‘চার্জ’-এ বসিয়েছেন।
শুনতে-শুনতে মনে হয় যেন, সবাই ছোটবেলায় ফিরে যেতে চাইছেন। সুলেখা চৌধুরী নামে এক আবাসিক বলেন, “ছোটবেলায় মহালয়া শুনতে-শুনতে ভাইবোনেরা বেরিয়ে পড়তাম। কোঁচড় ভর্তি করে শিউলি কুড়োতাম। এখন সে সব নেই। কিন্তু কী করে যেন মহালয়ার দিনটা বুঝতে পারি।” দেবীর আবাহনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ দিন রাতে তাড়াতাড়ি খাবারও খেয়ে নেবেন আবাসিকেরা।
তবে এ সবের মধ্যে কোথাও কি একাকিত্বও জেগে থাকে? আবাসিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেকেরই ছেলেমেয়ে-সহ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেকের তা নেই। আবার অনেক সময় ভোরে উঠে মহালয়া শুনতেও পারেন না সুরেনচন্দ্র মণ্ডলের মতো কেউ-কেউ। শরীর যে সঙ্গ দেয় না। ‘আমদের আর কে সঙ্গ দেবে?’, খানিকটা যেন অভিমান ভরেই বলে ওঠেন ইস্কোর প্রাক্তন কর্মী সুকুমার। স্ত্রী মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তার পরে থেকেইবৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। রেডিয়োয় মহালয়া শোনেন। বলেন, “স্তোত্র-পাঠ শুনতে শুনতে চোখ ভিজে যায় প্রতিবছর। আর কত বছর কষ্ট বয়ে যেতে হবে, তা দেবীই জানেন!”— শুনতে-শুনতে মনে পড়তে পারে একটি পূর্ব-প্রকাশিত লেখায় খোদ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুজাতার একটি অভিজ্ঞতার কথা। কলকাতায় রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে বসে বলেছিলেন, “মা (রমারাণী দেবী) এক বার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্তোত্রপাঠের সময়ে কোথাও কোথাও তোমার গলা ধরে আসে কেন?” বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জবাব ছিল, “মা চণ্ডীকে তখন সামনে দেখতে পাই আমি”!
বৃদ্ধাশ্রমের অদূরেই কাশ-বনে তখন যেন সোনা-রোদ আর হাওয়ার মাতোয়ারা খেলা। যেন জানান দিচ্ছে, দেবী শুধু উৎসব নন,অভিমানেরও আশ্রয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy