ভাতারের তদন্তে ফরেন্সিক দল। নিজস্ব চিত্র।
পাওনাদারদের উৎপাত লেগে থাকত প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু বর্ধমানের মিঠাপুকুরের পূর্ত দফতরের আবাসন চত্বরে কোনও ক্লোজ্ড সার্কিট ক্যামেলা ছিল না। তবে ভাতারের খুন হওয়া বৃদ্ধ দম্পতির ঘরের বাইরে লাগানো ছিল ক্যামেরা। তাতেই ধরা পড়ে গেলেন ধৃতেরা।
তদন্তকারীদের দাবি, বৃদ্ধ দম্পতির বাড়ির মধ্যে সিসি ক্যামেরা দেখে তাঁদের প্রশ্ন জাগে। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে দু’বার বাড়ি বদল, এক আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের আঁচও মেলে কথাবার্তায়। সেই সবের সূত্র ধরেই দেহ উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করে ফেলা যায় তিন অভিযুক্তকে।মঙ্গলবার ভাতারের রবীন্দ্রপল্লি থেকে উদ্ধার হয় অভিজিৎ ও ছবিরানি যশের রক্তাক্ত দেহ। খুনের অভিযোগে নিহত ছবিরানির বোনঝি মহুয়া ও তাঁর দুই ছেলে, অনিকেত ও অরিত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ধৃতদের বুধবার বর্ধমান আদালতে তোলা হলে বিচারক ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠান। নিহতদের আত্মীয়, বর্ধমানের রায়ান গ্রামের বাসিন্দা ন্যায়স্বরূপা চৌধুরীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, শনিবার থেকে কোনও খবর না পেয়ে তাঁরা রবীন্দ্রপল্লির বাড়িতে গিয়ে দেখেন দরজা তালাবন্ধ। অথচ দুর্গন্ধ বার হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখা যায়, ছবিরানির মাথায় আঘাতের চিহ্ন। রান্নাঘরে পড়ে রয়েছেন তিনি। শোওয়ার ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় অভিজিৎ পড়ে রয়েছেন। পাশে পেঁচানো গামছা।
পুলিশের দাবি, রান্নাঘরে গিয়ে তাঁরা দেখেন, যে সব পদ রান্না হয়েছে তা সাধারণত দুপুরে খাওয়া হয়। থলি থেকে আনাজ ছড়িয়ে রয়েছে। তা ছাড়া সকাল পৌনে ১০টার পর থেকে ওই বৃদ্ধ দম্পতির মোবাইল বন্ধ ছিল। তদন্তকারীদের দাবি, চুরির জন্য খুন হলে আলমারি খোলা থাকত না, ভাঙা থাকত। কিন্তু টাকা, সোনার গয়না ‘লুট’ হলেও বাকি জামাকাপড় পরিপাটি করেই সাজানো ছিল। পুলিশ নিশ্চিত হয়ে যায়, দিনের বেলাতেই ঘটনাটি ঘটেছে। আর কোনও চুরির ঘটনা নয়, আত্মীয়েরাই এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করে বুঝতে পারে, ওই দম্পতির সম্পত্তির উপরে আত্মীয়দের ‘নজর’ ছিল। তাঁরা বেশ কয়েকবার সাহায্যও নিয়েছেন। ১০ দিন আগে মহুয়া ২০ হাজার টাকা ওই বৃদ্ধ দম্পতির কাছ থেকে নিয়ে যান। তার পরেও ৪০ হাজার টাকা চাইছিলেন। এ নিয়েই মনোমালিন্য হয়।
এই তথ্য পাওয়ার পরেই পুলিশ সিসি ক্যামেরায় নজর রাখে। জানা যায়, সকাল ৮টা নাগাদ মিঠাপুকুর থেকে মা ও দুই ছেলে বর্ধমান স্টেশনে যান। সাড়ে ন’টায় কাটোয়া লোকালে চেপে ১০টা নাগাদ ভাতারে পৌঁছন তাঁরা। টোটো করে রবীন্দ্রপল্লিতে পৌঁছনোর পরেই তিন জন মাস্ক পরে ফেলেন। সাড়ে ১০টা নাগাদ বৃদ্ধ দম্পতির বাড়িতে পৌঁছন তাঁরা। পুলিশের ধারণা, বাড়িতে ওই সময় বৃদ্ধা একাই ছিলেন। পরে বাজার করে বৃদ্ধ বাড়িতে ঢোকেন। তার মধ্যে অন্তত দু’বার অনিকেত ও অরিত্র বাড়ির বাইরে বেরিয়েছেন। পুলিশের অনুমান, পরিকল্পনা করেই এই খুন করা হয়েছে। বৃদ্ধাকে খুন করার পরে তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। বৃদ্ধ বাড়িতে ঢুকতেই তাঁর উপর হামলা হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে, খুনের পরে ধৃতেরা আর ট্রেনে বাড়ি ফেরেননি। তাঁরা প্রথমে টোটো করে আমারুন, সেখান থেকে অটোয় বাজেপ্রতাপপুর, তারপরে টোটো ধরে বর্ধমান শহরে ঢোকেন। পুলিশের এক কর্তার কথায়, “জিজ্ঞাসাবাদে ওই তিনজন এমন কিছু কথা বলেছেন, সেটা ঘটনার সময় বা পরে বাড়িতে না থাকলে জানা সম্ভব নয়। চেপে ধরতেই খুনের কথা স্বীকার করে নেন তাঁরা।’’
মহুয়ার প্রতিবেশীদের দাবি, ‘ধার করে ঘি’ খাওয়া স্বভাব ছিল তাঁর। চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতেন। সেই ঋণ শোধ করার জন্য ফের তাঁকে কারও না কারও কাছে ‘হাত পাততে’ হচ্ছিল। মহুয়ার স্বামী প্রতাপও তাঁর কর্মস্থলে কয়েক মাস ধরে ধার করতে শুরু করেছিলেন। পুলিশের দাবি, ধারের টাকা শোধ করতে গিয়ে পূর্ত দফতরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী প্রতাপের বেতন বাড়িতে পৌঁছচ্ছিল না। ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত ছেলেদের বেতনও বাকি পড়ে গিয়েছিল। টাকার দাবি মেটাতে পারেনি বলেই পরিকল্পনা করে বৃদ্ধ দম্পতিকে খুন করা হয়েছে, দাবি পুলিশের। বুধবার বিকেলে রবীন্দ্রপল্লির ওই বাড়িতে ফরেন্সিক দল গিয়ে তদন্ত করে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আজ, বৃহস্পতিবার সিআইডির আঙুল-ছাপ বিশেষজ্ঞদের আসার কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy