সাগরদ্বীপে ক্ষতিগ্রস্ত পানের বরজ। নিজস্ব চিত্র
ঝড় মানেই এলোমেলো সব কিছু। সুন্দরবনের মানুষের থেকে এই সত্য আর বেশি কে জানেন! তবে, ঝড় সয়ে নেওয়ার অভ্যাস আছে তাঁদের। কিন্তু কোনও কোনও ঝড় সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়। যেমন ছিল আয়লা। যেমন এল আমপান।
২০০৯ সালে আয়লার পরে দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকার অর্থনীতি কার্যত বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে গিয়েছিল। আগে দু’ছটাক জমির মালিক সেই জমি থেকেই সংসার চালিয়েছেন। সঙ্গে লাগোয়া ডোবা-পুকুর বা ছোট্ট ভেড়ির চিংড়ি-পার্শে বেচে সম্বৎসরের হাত-খরচ আসত। কিন্তু আয়লার পরে অল্প জমির মালিকেরা তো বটেই, বিঘে দশেক নিয়ে যাঁদের চাষবাস ছিল, তাঁরাও বেমালুম পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হন। কারণ, নদীর বাঁধ ভেঙে-ছাপিয়ে হাজার হাজার বিঘে জমি নোনা জলে পতিত হয়ে পড়েছিল।
শুধু জনজীবন তো নয়, আয়লা স্থায়ী ক্ষত রেখে গিয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্যে। প্রভাব পড়েছিল তার বাস্তুতন্ত্রেও। তবে, সুন্দরী-গরান-গেওয়া-ক্যাওড়া-গর্জন গাছেরা তা সইয়ে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, আয়লার চেয়ে আমপানের ক্ষতি আরও অনেক বেশি। আশার আলো, এ বারেও ম্যানগ্রোভ গাছেদের বিশেষ নোয়াতে পারেনি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়।
কৃষি দফতরের হিসেব বলছে, দুই ২৪ পরগনা মিলিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে আমপানে। তার মধ্যে সিংহভাগ জমি ভেসেছে নোনা জলে। আগামী কয়েক বছর সেই জমিতে চাষ হবে না। আয়লার পরে যেমনটা হয়েছিল। জমি-পুকুরে খেটে খাওয়া মানুষেরা তাই দুশ্চিন্তায়, এ বারও কি জীবিকা বদলাতে হবে?
শুধু চাষ নয়, জীবনধারণের জন্য সুন্দরবনে রয়েছে আরও হরেক জীবিকা। অন্যতম মাছ চাষ। কলকাতা তো বটেই সুন্দরবন এলাকার চিংড়ি, ভেটকি সরবরাহ হয় ভিন্ রাজ্যে, বিদেশেও। ধান-আনাজ আর পান এখানকার মূল অর্থকরী ফসল। এর বাইরেও অন্তত ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। কেউ খাঁড়ি এলাকায় মাছ-কাঁকড়া ধরে সংসার চালান। সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করেন। সমুদ্রে মাছ ধরতে যান এমন মৎস্যজীবীর সংখ্যা লক্ষাধিক। কাকদ্বীপের রমেন মণ্ডল, হিঙ্গলগঞ্জের নাজিম গাজি, সন্তীর নাজির হোসেন লস্কর, পাথরপ্রতিমার সুকুমার নস্কররা তাই বলছেন, “সুন্দরবন বাঁচলে আমরা বাঁচি।” এখন প্রশ্ন, কী করে বাঁচবেন তাঁরা?
সুকুমার ধান-আনাজ চাষ করেন। সে জমি নোনা জলে নষ্ট হয়েছে। নিজের একটি এবং তিনটি ইজারা নেওয়া পুকুরে মাছ চাষ করেন নাজিম। নোনা জলে মাছ মরেছে। নাজির বছরের বেশিরভাগ সময় পরিবার নিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরেন। এপ্রিল থেকে জুনে বাদাবনে মধু সংগ্রহ করেন। তাঁর আশা, সামনের শীতে ফের মাছ ধরার নাও ভাসাতে পারবেন। রমেনের তিনটি পান-বরজ ছিল। পুরোপুরি মাটিতে মিশেছে সেগুলি। ঋণ ছিল তিন লক্ষ টাকার। নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবেন, এমন ভরসা পাচ্ছেন না তিনি।
এ যাবত যে ঝড়গুলি সুন্দরবনকে তছনছ করেছে, সেই তালিকায় সবচেয়ে উপরে রয়েছে ‘সিডর’। তবে, এই ঝড়ে এ পার বাংলার তেমন ক্ষতি হয়নি। ২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর ‘সিডর’ বাংলাদেশে আঘাত করে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। জখম হন প্রায় ৫০ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রায় ৮৯ লক্ষ মানুষ। আমেরিকার উইনরক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় ২০১৭ সালে ঘোষণা করে, সুন্দরবন না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি প্রায় দ্বিগুণ হত।
সুকুমার, রমেনরা বলছেন, “ঝড় আটকানো যাবে না। আমরা বাঁচব কী করে? হয়তো জীবিকাই বদলে ফেলতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy