Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Afghanistan

Refugee: কাবুলের সাজানো জীবন, সুন্দর বাড়ির দিন শেষ, হাওড়ায় ঘুপচি ঘরে শরণার্থী আফগান পরিবার

ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে আট ও নয় বছরের দুই শিশুকন্যা ও স্ত্রী-সহ বর্তমানে তিনি ভারতে শরণার্থী হিসাবে রয়েছেন।

হাওড়ার বাড়িতে দুই মেয়ের সঙ্গে মহম্মদ খান তারকাই। পাস্তানা ( বাঁ দিকে) মালাল (ডান দিকে)।

হাওড়ার বাড়িতে দুই মেয়ের সঙ্গে মহম্মদ খান তারকাই। পাস্তানা ( বাঁ দিকে) মালাল (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র

সারমিন বেগম
হাওড়া শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:০২
Share: Save:

বছর দশেক আগে আফগানিস্তানে তালিবানের গুলিতে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। টানা ছ’মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর জীবন ফিরে পান। এখনও শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। এক দশক পর সেই তালিবানের কারণেই জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন কাবুলের ব্যবসায়ী মহম্মদ খান তারকাই। ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে আট ও নয় বছরের দুই শিশুকন্যা ও স্ত্রী-সহ বর্তমানে তিনি ভারতে শরণার্থী হিসাবে রয়েছেন। বাবা-মাকে কাবুলেই ফেলে আসতে হয়েছে। আশ্রয় নিয়েছেন হাওড়ার গঙ্গারাম বৈরাগী লেনের একটি বাড়িতে। মাত্র ১২ দিনের মধ্যে তালিবানের আগ্রাসনে কী ভাবে তাঁদের জীবন বদলে গেল, এখনও হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি।

কাবুলে তালিবান ঢুকে পড়ছে, এই খবর পেতেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধাম্ত নেন মহম্মদ। যোগাযোগ করেন ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে। এর আগেও তালিবান তাঁর উপর হামলা করেছে। এ বারও ছেড়ে কথা বলবে না— আতঙ্কে উদ্বাস্তু হতেও পিছপা হননি তিনি। তালিবান কাবুলের দখল নিতেই ফের ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তালিবান যখন পুরোপুরি কাবুলের দখল নিয়েছে, সেই সময় এক রাত ভারতীয় দূতাবাসের আশ্রয়ে থেকে পর দিন ভারতে চলে আসেন বিমানে। কাবুলের সাততলা বাড়ি ছেড়ে প্রথমে দিল্লি পরে হাওড়ার দু’কামরার ঘর। একটি কামরার দেওয়ালে আফগান পতাকা টাঙিয়ে রাখা। সেই পতাকার সামনে বসেই ফেলে আসা দেশে লুকিয়ে থাকা মা-বাবার চিন্তায় আকুল মহম্মদ। একই সঙ্গে চলছে নতুন দেশের আদবকায়দা, নতুন ভাষা শিখে বেঁচে থাকার লড়াই।

বছর দশেক আগে তালিবানের গুলিতে আহত মহম্মদ খান তারকাই।

বছর দশেক আগে তালিবানের গুলিতে আহত মহম্মদ খান তারকাই। —নিজস্ব চিত্র

এখানে আসার আগে কাবুলে সাজানো বাড়ির মতোই স্বপ্নের জীবন ছিল মহম্মদের। মা-বাবা, স্ত্রী এবং দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। কিন্তু সব ওলোটপালট হয়ে যায় তালিবান ঢুকে পড়ার খবরে। দ্রুত দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। সাকুল্যে ৪টি বাক্স, তাতেই আফগানিস্তান থেকে যা কিছু আনা যায় সব ভরে নিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে আনতে পারেননি মা-বাবাকেই। ‘‘আমার পরিবারের জন্য বিমানে ৪টি জায়গা ছিল। তাই মা-বাবা নিজের জীবন বিপন্ন করে ওখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর আমাদের পালাতে বললেন,’’— হাওড়ার ঘরে বসে মঙ্গলবার বলছিলেন মহম্মদ। তাঁর কথায়, ‘‘মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলছি। কিন্তু যত ক্ষণ না ওঁদের নিরাপদে আফগানিস্তান থেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে পারছি, তত ক্ষণ শান্তিতে ঘুমাতেও পারছি না।’’

ভারতে আসার জন্য কাবুল বিমানবন্দরে ।

ভারতে আসার জন্য কাবুল বিমানবন্দরে । —নিজস্ব চিত্র

তালিবানি শক্তির কাছে মাথা না-নোয়ানো মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের ছোট মেয়ের নাম রেখেছেন মালাল। বড় মেয়ের নাম পাস্তানা। দুই খুদের চোখেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আপাতত ধূসর এই উদ্বাস্তু জীবনে। ‘‘দেশের সীমান্ত পেরনোর গুরুত্বই তো বুঝতে শেখেনি ওরা। স্কুলে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। তবে তার আগে শিখতে হবে নতুন ভাষা। স্কুলে গেলেই তো হল না, ভাষা না জানলে পড়াশোনা হবে কী করে?’’— প্রশ্ন মহম্মদের। হাওড়ায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব ভাল করে কথা বলতে না পারলেও দুই খুদে যে নতুন দেশে নিজেদের জায়গা করে নিতে চাইছে তা স্পষ্ট ওদের হাতের মেহেন্দিতে। মহম্মদের কথায় ‘‘পাশের বাড়িতে সবাই ওদের ভালবাসে। এখানে একটা অনুষ্ঠান ছিল তাই ওদের হাতেও মেহেন্দি পরিয়ে দিয়েছে।’’

কাবুলে কাপড়ের দোকান ছিল মহম্মদদের। সঙ্গে বাদাম, কিশমিশ-সহ শুকনো ফলের ব্যবসা। ব্যবসায়িক সূত্রে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আগে থেকেই। তবে এই লড়াইয়ে কলকাতায় থাকা আফগানিস্তানের অন্য বাসিন্দারাও তাঁদের সাহায্য করছেন বলে জানালেন তিনি। হাওড়ার নতুন আশ্রয়ের জন্য কোনও বন্ধু আলমারি কিনে দিয়েছেন, তো কেউ বিছানার চাদর, বালিশ। মহম্মদের কথায়, ‘‘আমার কাপড়ের দোকানেই শুধু ১৫ জন কাজ করতেন। ২৫টা ঘর আছে আমাদের কাবুলের বাড়িতে। আমারা তো মোটে ৬ জন। কত ঘর তো খালিই পড়ে থাকত। বাইরে থেকে বন্ধু, আত্মীয়স্বজনদের জন্য আমাদের বাড়ির দরজা খোলা ছিল সব সময়।’’ মহম্মদ জানালেন, বলিউডের সিনেমা দেখে তিনি হিন্দি শিখেছেন। বলছিলেন, ‘‘হিন্দি সিনেমা দেখার জন্য সিডি কিনতাম। সলমন, শাহরুখ, অমিতাভের সিনেমা দেখেছি। আমি সিনেমা দেখতে দেখতেই হিন্দি শিখেছি। আমার মেয়েদের অন্য দেশে বেঁচে থাকার জন্য শিখতে হবে।’’

কাবুলের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া।

কাবুলের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া। —নিজস্ব চিত্র

হাওড়ায় স্ত্রী-মেয়েরা নিরাপদে থাকলেও, দেশে থেকে যাওয়া মা-বাবার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত মহম্মদ। তিনি বলছিলেন, ‘‘ওদের কথা মনে পড়লে শুধু কান্না পায়। ইরান থেকে কার্পেট এনে বিছিয়েছিলাম বাড়িতে। সেই বাড়ির জিনিসপত্র তালিবান বাইরে ফেলে দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে বলে শুনছি।’’ আফগানিস্তানের এক বন্ধু মহম্মদকে জানিয়েছেন, তাঁদের কাবুলের বাড়ি দখল করে নিয়েছে তালিবান। মহম্মদের বয়স্ক মা-বাবা বাধ্য হয়েছেন অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে। কোন পথে তাঁদের আফগানিস্তান থেকে বার করে আনা যায় বিদেশে বসে সেই পরিকল্পনা করছেন দিনরাত।

হাওড়ার বাড়ি।

হাওড়ার বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র

মেয়েদের পড়াশোনা নিয়েও চিন্তায় মহম্মদ। হাওড়ায় তাঁদের বাড়ির কাছেই স্কুল আছে বলে শুনেছেন। সেখানেই খোঁজ নিয়ে দুই মেয়েকে ভর্তি করার পরিকল্পনা রয়েছে। মহম্মদের বড় মেয়ে পাস্তানা পুশতু ছাড়া অন্য ভাষা না জানলেও খুব তাড়াতাড়ি শিখে নেবে বলে আশা বাবার। চিকিৎসক হওয়ার পর কাবুলের হাসপাতালে চিকিৎসার কাজ করার ইচ্ছা পাস্তানার। কারণ ওখানেই তো রয়েছে পাস্তানার প্রিয় বন্ধু সানা। অন্য দিকে, বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার পর ভারতেই থাকতে চায় মালাল। এখানকার খাবারে খুব ঝাল। তবে ফুচকা খেতে ভাল লেগেছে বলে জানাল সে।

আফগানিস্তানে বৃদ্ধ মা-বাবা, হাওড়ায় দুই মেয়ে সঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে কিছুটা বিচলিত ও চিন্তিত মহম্মদ। চলতি মাসেই পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলেছে। তার ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই চিন্তাতেও ঘুম ছুটছে মহম্মদের। বললেন, ‘‘নতুন যে আসছে, সে-ও কি আমাদের মতো শরণার্থী পরিচয় পাবে?’’

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan Kabul refugee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE