আলাদা করে নারী দিবস নেই ওদের জীবনে। নিজস্ব চিত্র।
গত এক সপ্তাহ নারী দিবসকে কেন্দ্র করে জেলার নানা প্রান্ত সেজেছে হরেক বিজ্ঞাপনে। গয়না, পোশাক, প্রসাধনীর দোকানে চলছে আকর্ষণীয় ছাড়। নানা জায়গায় চলছে উৎসব, উদ্যাপন। চোখে পড়ছে সমানাধিকারের নানা বার্তা। তবে এ সবে কোনও আগ্রহ নেই হাজরা সর্দার বা আলো অধিকারীদের।
আর পাঁচটা দিনের মতোই শুক্রবারও ভোরবেলা কাজের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন ক্যানিংয়ের গোয়ালাপাড়ার বাসিন্দা হাজরা। ক্যানিং রেল স্টেশনের একমাত্র মহিলা কুলি তিনি। স্বামী রশিদ সর্দারের কাঁধেই ছিল সংসার খরচের দায়িত্ব। কিন্তু প্রায় বছর তিনেক আগে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন রশিদ। দুই ছেলে থাকলেও কেউই বাবা-মাকে দেখে না। তাই স্বামীর চিকিৎসা ও সংসার খরচ জোগাতে কুলির কাজ শুরু করেন হাজরা। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ক্যানিং স্টেশনে বোঝা বয়ে চলেন তিনি। কাজের ফাঁকেই বাড়ি গিয়ে রান্না করে স্বামীকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে ফের স্টেশনে চলে আসেন তিনি। আর পাঁচটা পুরুষ কুলির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই চলন্ত ট্রেনে উঠে ‘বোঝা ধরেন’ হাজরা। তিনি বলেন, “প্রথম প্রথম মহিলা কুলি বলে কেউ মালপত্র দিতেন না। আমার নিজেরও লজ্জা লাগত। কিন্তু কাজ না করলে সংসার চলবে কি করে? স্বামীর ওষুধ, চিকিৎসার বিপুল খরচ। তাই এটাই এখন আমার প্রতিদিনের রুটিন।’’ নারী দিবস সম্পর্কে তাঁর কী ভাবনা জিজ্ঞাসা করায় বলেন, ‘‘ওসব নারী দিবস, টিবস কী জানি না। শুধু জানি না খাটলে কেউ খেতে দেবে না।”
ক্যানিংয়ের দিঘিরপাড় নাথ পাড়ার বাসিন্দা আলো অধিকারীর বক্তব্যও অনেকটা একইরকম। বছর চল্লিশের আলো ক্যানিং বারুইপুর রোডের থানার মোড়ের কাছে সাইকেল সারান। এতদিনের অভিজ্ঞতায় নিজের কাজে রীতিমতো দক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি। একমাত্র ছেলে ক্যানিংয়ের রায়বাঘিনী স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। সংসারের কাজ সামলে প্রতিদিন নিয়ম করে দোকানে আসেন আলো। সাইকেল, ভ্যান, রিকশার নানা সমস্যার সমাধান করেন হাতের কারিকুরিতে। বয়সের ভারে স্বামী চন্দন এখন আর ভারী কাজ করতে পারেন না। তাই হাত লাগান আলো। তিনি বলেন, “কাজ না করলে খাব কি? ছেলের পড়াশোনা হবে কী করে? স্বামী একা পারেন না। উনি অসুস্থ, বয়সও হয়েছে। দেখতে দেখতে বছর দশেক হয়ে গেল এ কাজে।’’ নারী দিবস নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সে আবার কি? আমার ও সব জানা নেই।”
সংসারের হাল ধরতে পুরুলিয়া থেকে ক্যানিংয়ে কাজে এসেছেন দেবরানী কিসকু, মঞ্জিতা হাঁসদাঁরা। বছরভর ঠিকাদারের তত্ত্বাবধানে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন তাঁরা। প্রতিদিনের মজুরি সাড়ে তিনশো টাকা। তাঁরা বলেন, “কাজ না করলে আমাদের সংসার চলবে না। এলাকায় সে ভাবে কোনও কাজ নেই। অন্যদিকে, খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বামী স্ত্রী মিলে কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। নারী দিবস কি তা জেনে লাভ নেই। ও সব জানলে কেউ কি খেতে দেবে আলাদা করে?”
ওঁদের মতো জেলার আরও বহু মহিলা এমনই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। তাই নারী দিবসে কোনও উদযাপন নয়, বরং সমাজে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকতে চান ওঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy