আলিপুর সংশোধনাগার এখন রূপান্তরিত জাদুঘরে। নিজস্ব চিত্র।
কলকাতার অলিগলিতে যদি ইতিহাস ও সংস্কৃতির খোঁজ করেন, তা হলে ভারতীয় জাদুঘর বা সংগ্রহশালার নামই প্রথম উঠে আসে। কিন্তু এই শহরেরই আনাচকানাচে এমন আরও অনেক জাদুঘর ও সংগ্রহশালা রয়েছে, যেখানে থরে থরে দুষ্প্রাপ্য ও ঐতিহাসিক সব সামগ্রী ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সব খনির সন্ধান করার ইচ্ছা থাকলে বিশেষ বিশেষ কিছু জায়গা চিনে নিতে হবে। এমনই পাঁচটি সংগ্রহশালার হদিস রইল।
আলিপুর জেল জাদুঘর
ব্রিটিশ ভারতে নির্মিত কলকাতার প্রাচীনতম সংশোধনাগারের মধ্যে একটি হল আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। তৈরি হয়েছিল ১৯০৬ সালে। ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা হওয়ার পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে আর কোনও আবাসিককে রাখা হয় না সেখানে। সরকারি উদ্যোগেই এই সংশোধনাগার রূপান্তরিত হয় জাদুঘরে। এখন এটি কলকাতার অন্যতম ভ্রমণ স্থান। এই সংশোধনাগারের মধ্যেই এক সময়ে বন্দি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত, রাধাচরণ পাল, প্রমোদ রঞ্জন চৌধুরীরা। তাঁদের থাকার কুঠুরি, কী ভাবে তাঁরা বন্দিজীবন কাটিয়েছেন, সব কিছুর নিদর্শন রয়েছে এখানে। ধ্বনি-আলোর অনুষ্ঠানও হয় এখানে। তার জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হয়। ভিতরেই আছে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। কফি হাউস থেকে শুরু করে ফুড জ়োন।
সময়: মঙ্গলবার থেকে রবিবার দুপুর ১২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ধ্বনি-আলোর অনুষ্ঠান দেখতে হলে তা শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টার পরে।
নেতাজি ভবন
১৯০৯ সালে এলগিন রোডের এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর বাবা জানকীনাথ বসু। এখানেই সুভাষচন্দ্রকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল ইংরেজরা। সুকৌশলে ব্রিটিশদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বহু দুর্গম পথ অতিক্রম করে দেশ ছেড়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। ইতিহাসের অনেক স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি পরে সরকারকে দিয়ে দিয়েছিলেন ওই পরিবারের সদস্যেরা। ১৯৬১ সালে এই বাড়িটিকেই জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্রের রূপ দেয় ‘নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো’। সুভাষচন্দ্রের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করা হয় এখানে। তাঁর ব্যবহার করা অনেক অমূল্য জিনিসপত্রও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। রয়েছে তাঁর জামাকাপড়, খাট, জুতো, স্যুটকেস। ১৯৪১ সালে অন্তর্ধানের দিন যে গাড়িটি ব্যবহার করেছিলেন সুভাষচন্দ্র, তা-ও সযত্নে রয়েছে এই বাড়িতে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে সভাপতি থাকাকালীন ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে এই ভবনের যে ঘরটিতে বসতেন ও সকলের সঙ্গে দেখা করতেন, সেটি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর ব্যবহৃত টেবিল, বইয়ের তাক, আসবাবও রয়েছে সেই আগের মতোই।
সময়: সোমবার ছাড়া প্রতি দিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকে।
এশিয়াটিক সোসাইটি
১৭৮৪ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি স্যর উইলিয়াম জ়োনস কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনালেন ওয়ারেন হেস্টিংস এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৮০৮ সালে দক্ষিণ কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের একটি ভবনে এই প্রতিষ্ঠানকে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে ১৯৬৫ সালে এই ঐতিহাসিক ভবনটির পাশেই আরও একটি ভবন তৈরি হয়। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটির নিজস্ব গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা রয়েছে। লক্ষাধিক দুষ্প্রাপ্য বই, পুঁথি, মুদ্রা সংরক্ষিত রয়েছে সেখানে। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি কেন্দ্রের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যা ‘জাতীয় গুরুত্ব’ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাসম্পন্ন।
সময়: সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল পৌনে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ও শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা।
মার্বেল প্যালেস
১৮৩৫ সালে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এই প্রাসাদটি তৈরি করেন। জোড়াসাঁকোর কাছে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে রয়েছে এই রাজকীয় প্রাসাদ। এখানকার অফিসঘরে কাঠের ঝাড়বাতির দিকে চোখ পড়লে অবাক হয়ে যেতে হয়। দেওয়ালে হাডসনের দেড়শো বছর আগের তৈলচিত্র মুগ্ধ করবে। শিল্পরসিক রাজেন মল্লিকের আর্ট গ্যালারিও আছে এখানে। মার্বেল প্যালেসের সেরা আকর্ষণ হল এখানকার চিড়িয়াখানা ও পক্ষীশালা। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও হরিণের দেখা মিলবে সেখানে। প্রাসাদোপম এই বাড়ির নীচের তলায় রয়েছে সংগ্রহশালা। বিশাল বিশাল ফুলদানি থেকে ঝাড়লণ্ঠন, মূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে। মার্বেল প্যালেসে রাজেন মল্লিকের যাবতীয় শখ-আহ্লাদ, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা, ধর্মকর্ম সবেরই নিদর্শন রয়েছে। ঠাকুরদালানে রামায়ণ ও গ্রিক পুরাণের নানা নিদর্শন দেখা যাবে। প্রাসাদের ভিতরের বাগানে রয়েছে ১০০ বছরেরও পুরনো গাছপালা। এখানে বসেই রবীন্দ্রজয়ন্তীর ১২৫ বছরে গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সময়: বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে। সোমবার বন্ধ।
জিপিও মিউজ়িয়াম
১৮৬৮ সালে ইউরোপীয় স্থাপত্যের আঙ্গিকে তৈরি হয় জিপিও-র সাদা ভবন। তারই পশ্চিমে ইতালীয় ধাঁচের লাল ইটের তিনতলা বাড়িটি বর্তমানে ডিরেক্টর জেনারেল অফ কলকাতা জিপিও। ভবনের একতলায় রয়েছে সংগ্রহশালা, যা ‘পোস্টাল মিউজ়িয়াম’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনকালে ডাকব্যবস্থা কেমন ছিল সেই ইতিহাস সংরক্ষিত আছে এখানে। খুঁত-থাকা পয়সা বাতিল করার জন্য ১৯১২ সালে টাঁকশাল থেকে জিপিও-কে কয়েন কাটার যন্ত্র দেওয়া হয়। তা-ও রয়েছে স্মারক হিসাবে। রয়েছে রানারের ব্যবহৃত পোশাক, অস্ত্র, ঘণ্টা আর লণ্ঠন। পুরনো সব মানচিত্র, ডাকবাক্স, স্ট্যাম্পের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। জিপিও সংগ্রহশালায় গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাসবই ও তাঁর সেই মহামূল্য স্বাক্ষর দেখতে ভুলবেন না।
সময়: প্রতি দিনই বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy