Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

তিন দশক পরে আড্ডায় ময়দানের তিন কিংবদন্তি

কলকাতা ময়দানের তিন কিংবদন্তি একসঙ্গে। তিন দশক পরে। মজিদ, জামশিদ ও ভাস্করের সেই আড্ডার সাক্ষী আনন্দবাজার...মধ্যাহ্নভোজ সেরে হোটেলের ঘরে ঢুকেই জামশিদ নাসিরিকে দেখে বুকে টেনে নিলেন মজিদ বাসকর। ঠিক তখনই কথা বলে উঠলেন মজিদের একদা সতীর্থ ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।

ত্রয়ী: ফের এক ফ্রেমে তিন তারা। জামশিদ নাসিরি, মজিদ বাসকর এবং ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। মজলিসে উঠে এল অনেক সোনালি স্মৃতি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ত্রয়ী: ফের এক ফ্রেমে তিন তারা। জামশিদ নাসিরি, মজিদ বাসকর এবং ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। মজলিসে উঠে এল অনেক সোনালি স্মৃতি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৯ ০৪:০৮
Share: Save:

রবিবাসরীয় দুপুর। মধ্যাহ্নভোজ সেরে হোটেলের ঘরে ঢুকেই জামশিদ নাসিরিকে দেখে বুকে টেনে নিলেন মজিদ বাসকর। ঠিক তখনই কথা বলে উঠলেন মজিদের একদা সতীর্থ ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।

ভাস্কর: চিনতে পারছ আমাকে? আমি ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।

মজিদ (বিস্মিত): তুমি সেই ভাস্কর? এত মোটা হয়ে গিয়েছ! আমি তো চিনতেই পারিনি। কী দুর্ধর্ষ গোলকিপার ছিলে তুমি! ওহ! অসাধারণ।

ভাস্কর: কত দিন পরে দেখছি?

মজিদ: প্রায় ৩০ বছর পরে আমি কলকাতায় ফিরলাম।

ভাস্কর: মজিদ, তুমি কিন্তু আমাকে একবারের বেশি গোল দিতে পারনি। অনেক চেষ্টা করেও রোভার্স কাপের ওই গোলটা আটকাতে পারিনি। বাঁক খেয়ে গোলে ঢুকেছিল বলটা। শরীর ছুড়েও আটকাতে পারিনি। অসাধারণ গোল।

ভাস্করকে থামিয়ে জামশিদ: সেই রোভার্স কাপ। আমি আর তুমি তখন ইস্টবেঙ্গলে। ভাস্কর ছিল মহমেডানে। তোমার মনে আছে মজিদ?

মজিদ: (পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে) মনে নেই আবার। প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে গোলটা করেছিলাম। পায়ের ভিতরের অংশ দিয়ে সোয়ার্ভ করেছিলাম বলটা। (সামনের বসা ভাস্করের দিকে তাকিয়ে হাসি) তোমার মতো জেদি গোলকিপার আমাদের সময় কেউ ছিল না। শেষ পর্যন্ত বল ফলো করতে। কত গোল যে আটকে দিয়েছ।

ভাস্কর: মঙ্গলবার কিন্তু খেলা হবে।

মজিদ: তাই নাকি।

ভাস্কর: (হাসতে হাসতে) প্রাক্তন ফুটবলাররা খেলবে।

মজিদ: দারুণ ব্যাপার হবে। আমি আমার ফুটবল বুটটা নিয়েই এসেছি। ভালই হবে। জামশিদ তো সঙ্গেই রয়েছে।

মজিদ: ইরানে গিয়েও তোমাকে ভুলিনি ভাস্কর। যখনই আমার বিরুদ্ধে খেলেছ, নিজের সেরাটা মেলে ধরেছ। রোভার্সে সেই ম্যাচটার দিন মাঠে দিলীপকুমার খেলা দেখতে এসেছিলেন। মাঠের ভিতরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তুমিই সেরা। সে দিন দেখেছিলাম, শঙ্কর মালি কোচ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষুব্ধ হয়ে কত কী বলছে। এই জামশিদ, শঙ্কর মালি এখন কেমন আছেন?

জামশিদ: উনি প্রয়াত।

(শুনে চুপ মজিদ)

ভাস্কর: মজিদ তুমি এত ফিট কী ভাবে?

মজিদ: ইরানে প্রাক্তন ফুটবলাররা খেলার মধ্যে থাকে। দল গড়ে খেলে। প্রতিযোগিতা হয়। তাই এখনও ফিট আছি। পাশাপাশি বাচ্চাদের খেলা শেখাই। তাই শরীরটা এখনও ঠিক আছে।

জামশিদ: ১৯৭৯-র জুলাই মাসে ভারতে এসেছিলাম। জব্বলপুরে পড়তে। ওখানে ভর্তি হওয়ার পরে বিকেলে ফুটবল খেলতাম। সেখানে এক জন অধ্যাপক ছিলেন। যিনি আগে ফুটবল খেলতেন। আমাদের খেলা দেখে এক দিন বললেন, এখানে কী করছ? আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাও। ওদের অধিনায়ক তোমাদের মতোই এক জন ইরানের ছাত্র। নাম খাবাজি। আমরা আগে খাবাজিকে চিনতাম না। চলে গেলাম আলিগড়ে। কয়েক দিন পরেই দল যাবে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় খেলতে। তাই খাবাজি পরের দিন ভাইস চ্যান্সেলরকে ডাকলেন অনুশীলনে আমাদের দেখে নেওয়ার জন্য। সে বার উত্তরাঞ্চলের প্রতিযোগিতা হয়েছিল জয়পুরে। সেখানে আমি সর্বোচ্চ গোলদাতা আর মজিদ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। মনে পড়ছে মজিদ?

মজিদ: মনে পড়বে না? তার পরে মূলপর্বে খেলা তিরুচিরাপল্লিতে। বেশি গোল করার জন্য আমাকে ও জামশিদকে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়। সেমিফাইনালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রথম দিন খেললাম ২-২। একটা গোল আমার। আর একটা জামশিদের। পরের দিন ফের খেলা হল। ফের আমরা দু’জনে গোল করলাম। তার পরে ফাইনালে কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন। যে অধ্যাপক আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন, তিনি আনন্দে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি, তুমি আর খাবাজি মিলে চোখেমুখে জল দিয়ে সুস্থ করলাম।

ভাস্কর: আরে, তুমি তো সবই মনে রেখেছ দেখছি। সুভাষ ভৌমিক তখন খেলা ছেড়ে দিচ্ছে। আমি, সুরজিত চলে যাচ্ছি মহমেডানে। এর পরেই প্রি-অলিম্পিক্স খেলতে সিঙ্গাপুর চলে গেলাম। ফিরে এসে শুনলাম আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তিন ইরানি ইস্টবেঙ্গল অনুশীলনে দাপাচ্ছে।

জুটি: চা কতটা দেব? বন্ধু জামশিদের কাছে জানতে চাইছেন মজিদ। নিজস্ব চিত্র

মজিদ: (হো হো করে হাসতে হাসতে এ বার জড়িয়ে ধরেন ভাস্করকে)

ভাস্কর: পরশু দিনের অনুষ্ঠানে ইস্টবেঙ্গলের সব জীবিত অধিনায়ক মঞ্চে থাকবেন। সবাই সংবর্ধনা পাবেন। আর তুমি সংবর্ধনা পাবে সেরা বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে।

মজিদ: ইস্, কোনও দিন ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক হতে পারলাম না।

জামশিদ: আরে তুমি তো আমাদের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে অধিনায়ক ছিলে।

মজিদ: ইস্টবেঙ্গল এক বার আমাকে অধিনায়ক হতে বলেছিল। কিন্তু আমার চেয়ে দিলীপ পালিত বয়সে বড়। তাই বলেছিলাম ওকেই অধিনায়ক করতে।

আনন্দবাজার: জামশিদ নাসিরির সাফল্যে মজিদের কী অবদান?

জামশিদ: মজিদের পাস থেকে কত গোল করেছি তা গুনে বলা যাবে না। আমরা তখন ইস্টবেঙ্গলে। একটা ম্যাচ ছিল মহমেডানের বিরুদ্ধে। গোলকিপার বলটা লম্বা করে মারল। আমি সেই বল বিপক্ষের মাঝমাঠে ধরে দিলাম মজিদকে। ও তার পরে আমাকে এমন জায়গায় বলটা বাড়াল যে সেখান থেকে গোল না করাই অন্যায়। তিন টাচে গোল। এ রকমই সব ম্যাজিক আমাকে দিয়ে করাত মজিদ। আর আমি গোল করে বিখ্যাত হতাম।

আনন্দবাজার: ১৯৮৫ সালে যখন মহমেডান থেকে ইস্টবেঙ্গলে এলেন, তখন মজিদকে নিতে বলেছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের?

জামশিদ: সে বার দলবদলের আগে পল্টুদাকে আমিই বলেছিলাম মজিদকে নিয়ে ইস্টবেঙ্গলে ফিরতে চাই। দলবদল যে দিন শেষ হচ্ছে, তার চব্বিশ ঘণ্টা আগে পল্টুদা দেখা করতে বললেন। আমি সে দিন শিলংয়ে ছিলাম। জলদি ফিরলাম। নটরাজ বিল্ডিংয়ে তখন আমি মজিদের সঙ্গে থাকি। ইস্টবেঙ্গল কর্তারা বললেন, কৃশানু-বিকাশ মোহনবাগান থেকে আসতে পারে। ওদের পেলে মজিদকে খেলাব কোথায়? তাই আর মজিদের সঙ্গে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলা হয়নি।

আনন্দবাজার: জুটি ভেঙে যাওয়ার পরে কষ্ট হয়েছিল?

মজিদ: কথাবার্তা তখন একটু কমে গিয়েছিল। কষ্ট তো হবেই। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা সামলে নিয়েছিলাম। তার পরে রোজ জামশিদের সঙ্গে দেখা হত। দু’জনে এক সঙ্গে থেকেছি, ঘুরেছি, খেয়েছি। কোনও দিন সমস্যা হয়নি।

জামশিদ: সাতাত্তর সালের আগে মজিদের সঙ্গে খোরামশায়ারেই থাকতাম। কলকাতায় এসে মজিদের সঙ্গে পাঁচ বছর এক দলে খেলেছি। সে বার আমাদের জুটি ভেঙে গেলেও আমি রোজ ইলিয়ট রোডে মহমেডান মেসে মজিদের সঙ্গে দেখা করে আসতাম। আর ছুটির দিনে আমার বাড়িতে আসত মজিদ। আমার স্ত্রীয়ের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল মজিদের। এই তো একটু আগেই আমার স্ত্রী ফোন করেছিলেন মজিদকে। বলল, চলে এসো বাড়িতে। পার্ক স্ট্রিট মনে আছে তো? মজিদ বলল, পার্ক স্ট্রিট কি ভোলা যায়?

ভাস্কর: এ বার বলো তো, কলকাতা ছাড়ার পরে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলে? কোনও খোঁজই পাওয়া যাচ্ছিল না তোমার। এখন কী করছ?

মজিদ: ইরানের খোরামশায়ারে থাকি। আমার এক আত্মীয়ের কোম্পানিতে চাকরি করি। ইস্টবেঙ্গল আমাকে অনেক দিন ধরেই আসার জন্য বলছিল। ভেবেছিলাম আসব না। কিন্তু আমার সঙ্গে আসা তিন আত্মীয়ই জোর করে নিয়ে এল।

জামশিদ: আমিও ওকে ফোন করেছিলাম বেশ কয়েক বার। আসতে বলেছিলাম। বলেছিলাম, এখানে সবাই তোমাকে দেখতে চাইছে। এক বার অন্তত কলকাতায় এসো।

আনন্দবাজার: মজিদ, আপনাকে ‘ফুটবলের বাদশা’ নামটা কে দিয়েছিল?

মজিদ (হেসে): ‘বাদশা’ ইরানে প্রচলিত শব্দ। কলকাতায় মনে হয়, মিডিয়াই আমার খেলা দেখে ‘বাদশা’ নামকরণ করেছিল। মনে পড়ছে, আমি আর জামশিদ নিজ়ামে খেতে যেতাম। পার্ক স্ট্রিটে বেড়াতাম একসঙ্গে। তখন সবাই ‘বাদশা মজিদ’ বলে ডাকত আমাকে। আসলে আমাদের জুটিটা তখন খুবই হিট। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের কথা কখনও ভোলা যাবে না। ওঁরা আমাদের দারুণ ভালবাসতেন।

ভাস্কর: মজিদ, তুমি বিয়ে করেছ?

মজিদ: না, না। ব্যাচেলরই আছি।

ভাস্কর: ব্যাচেলরই থেকে গেলে তা হলে শেষ পর্যন্ত। বিয়েটা কেন করলে না?

মজিদ: বিয়েটা আসলে করে উঠতে পারলাম না। তাতে অবশ্য কোনও সমস্যা নেই। ভালই আছি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুখেই আছি।

ভাস্কর: মিহির বসুকে মনে আছে? ও তোমার মতোই ব্যাচেলর।

মজিদ (উচ্ছ্বসিত): মির (মিহিরকে মিরই ডাকেন মজিদ)। মনে থাকবে না। সেই বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা মির! সাইড ভলিতে ভাল গোল করত। (ভাস্কর ফোনে ধরিয়ে দিলেন প্রাক্তন ফুটবলার মিহির বসুকে)

মজিদ: আরে মির। কেমন আছো? কোথায়? তুমিও না কি আমার মতো বিয়ে করোনি। আমরা তা হলে দলে ভারী হয়ে যাচ্ছি। ভাস্করের সঙ্গে দেখা হল। তোমার সঙ্গে হবে তো? চলে এসো ইস্টবেঙ্গলের অনুষ্ঠানে।

আনন্দবাজার: ইস্টবেঙ্গলে আপনার পরে অনেক বিদেশি ফুটবলার খেলে গিয়েছেন। চিমা, ওকোরো থেকে আজকের কোলাদো। কিন্তু আপনার কথা উঠলেই আজও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা মেনে নেন মজিদই সেরা। রহস্যটা কী?

মজিদ: আমি ধন্য যে, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা আজও মনে রেখেছেন আমার খেলা। ফুটবলার হিসেবে হয়তো আনন্দ দিতে পেরেছিলাম ওঁদের। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা খুব আবেগপ্রবণ। অনেকটা আমার মতোই। তাই হয়তো ওদের হৃদয়ে ঢুকতে পেরেছিলাম অল্প সময়েই। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে আমাকে এ ভাবে ইরান থেকে নিয়ে এসে সংবর্ধনা দিচ্ছে, এটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

আনন্দবাজার: কখনও মনে হয়নি, জামশিদ এত গোল করে। এ বার আমাকেও গোল করতে হবে।

মজিদ: কোনও দিনই মনে হয়নি। জামশিদ আমার চেয়ে লম্বা। যখন ভারতে আসি, তখন ইরানে ৪-৩-৩ ছকে খেলা হত। আর ভারতে ৪-২-৪। তাই জামশিদকে বলেছিলাম, আমি ফ্রি খেলতে চাই। তাই জামশিদকে স্ট্রাইকারে রেখে আমি ওর পিছনে খেলতাম। আমি বল বাড়াতাম আর জামশিদ গোল করত। এতেই আমার আনন্দ হত বেশি।

জামশিদ: একদম। ইস্টবেঙ্গলে আমাদের দু’জনের জার্সির নম্বর ঠিক হওয়ার গল্পটা মনে পড়ছে মজিদ?

মজিদ: মনে পড়বে না আবার! শঙ্করবাবা তো আমার জন্য ১২ নম্বর জার্সি বেছে দিয়েছিলেন। ১২ নম্বর জার্সি পড়তাম। জামশিদের ছিল ৯ নম্বর। খাবাজি পরত ২১ নম্বর। কারণ, ভারতে আমাদের দু’জনের অভিভাবক ছিল ও। আমাদের দু’বছর আগে এসেছিল ইরান থেকে। ও আমার আর জামশিদের জার্সির নম্বর যোগ করে ২১ নম্বর চেয়ে নিল। এখনও ঘটনাটা মনে পড়লে হেসে ফেলি।

ভাস্কর: তোমার মনাকে (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) মনে আছে? ওর সঙ্গে দেখা হলে চিনতে পারবে তো? আমাকে তো প্রথমে দেখে চিনতেই পারোনি!

মজিদ: মোনা...মোনা! ওকে ভুলব কী করে। দারুণ বন্ধু ছিল আমার। দেখা হলে ভাল লাগবে।

জামশিদ: সুব্রত ভট্টাচার্যকে মনে আছে মজিদ। মোহনবাগানে খেলত?

মজিদ: আরে আমাদের সময়ের সেরা ডিফেন্ডার। খুব ভাল স্টপার ছিল। প্রদর্শনী ম্যাচে কতবার তোমার মাথায় বল ফেলেছি গোল করার জন্য, সুব্রত হেড করে বার করে দিয়েছে। ও থাকবে নাকি অনুষ্ঠানে?

আনন্দবাজার: রোভার্স কাপের সেই ম্যাচটা মনে পড়ছে? মোহনবাগানের এক ফুটবলার গান গাইতে গাইতে বুটের ফিতে বাঁধছিল? তখন মোহনবাগানের এক জন বলল, গান বন্ধ কর। মজিদ আসছে। বুঝে যাবে তুই চাপে আছিস। ওই দুই ফুটবলারের নাম মনে পড়ছে?

জামশিদ: না, না সবাই বন্ধু। কারও নাম করতে চাই না। (হাসি)।

মজিদ: আমাদের সবার সিনিয়র। নাম বলতে চাই না। মনে আছে, ব্যাপারটা আমাকে জামশিদ বলেছিল।

ভাস্কর: পাস ক্লাবের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের জয়ের ম্যাচেই জেনেছিলাম ইরানের ফুটবল ধীরে ধীরে আমাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

জামশিদ: ওই ম্যাচে আমার দাদা জাহাঙ্গির খেলেছিলেন সেটা জানো তো।

ভাস্কর: শেষ মুহূর্তে পরিমল দে-র গোলে ইতিহাস তৈরি করেছিল ।

মজিদ: ভারতীয় রেফারি ছিল। তাই অফসাইডে গোল করে ইরাকে হারিয়েছিলে (ভাস্কর উত্তেজিত দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন মজিদ)। ভাস্কর একই রকম আছে। ওকে একটু রাগিয়ে দিতে হয়।

আনন্দবাজার: আপনি নাকি বহু বার ‘শোলে’ দেখেছেন।

মজিদ: শোলের অমিতাভ দুর্দান্ত। গব্বর সিংহ, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনি। পরভিন ববিকেও আমার দারুণ লাগে। এখনও দেখি। ইরানে হিন্দি ছবি দেখা যায় না। আরবিক কেবল চ্যানেলে দেখি। ডিভিডি চালিয়েও দেখি।

আনন্দবাজার: ভারতীয় কোনও গানের কথা মনে পড়ে?

মজিদ: কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, মুকেশের গানের আমি ভক্ত। এঁরা ইরানেও দারুণ জনপ্রিয়। সময় পেলেই আমি এঁদের গান শুনি।

ভাস্কর: জামশিদের ছেলেও ফুটবল খেলছে। মোহনবাগানে এ বছর সই করেছে।

মজিদ: শুনেছি কিয়ান ফুটবল খেলছে। জামশিদের মতো ক্রাউড পুলার হতে গেলে ওকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে।

আনন্দবাজার: জামশিদের ছেলে মোহনবাগানে ফুটবলার জীবন শুরু করল?

মজিদ: তাতে কী হয়েছে? ও যেখানে খুশি খেলতে পারে।

আনন্দবাজার: আপনি ইস্টবেঙ্গল-মহমেডানে খেললেও কোনও দিন মোহনবাগানে খেলেননি, কোনও আক্ষেপ?

মজিদ: ইস্টবেঙ্গল, মহমেডানে খেললেও মোহনবাগানে খেলা হয়নি আমার। এই আক্ষেপটা আছে। ওদের মাঠে, তাঁবুতেও গিয়েছি। ইস্টবেঙ্গলে প্রথম বছর খেলা দেখার পরে আমাকে মোহনবাগানে খেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওদের তখনকার সচিব ধীরেন দে। কিন্তু ওই ক্লাবে তখন বিদেশি ফুটবলার খেলানোর নিয়ম ছিল না। গঠনতন্ত্র বদলাতে হত। সেটা ওঁরা করতে পারেননি। অনেক পরে নিয়ম বদলেছে শুনেছি।

আনন্দবাজার: কলকাতায় থাকার সময়ে অবসর কী ভাবে কাটাতেন?

মজিদ: পার্ক স্ট্রিটে আড্ডা মেরে, সিনেমা দেখে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, অম্বর। সব জায়গায় যেতাম। ফ্লুরিজ, মোকাম্বোতে আড্ডার দিনগুলো আজও মনে পড়ে।

আনন্দবাজার: এ বার কলকাতা এসে কোথায় যেতে চান।

মজিদ: একটা ভাল বিরিয়ানির দোকানে যেতে হবে। আমি খুব বিরিয়ানির ভক্ত। আমার সময়ে সিরাজ়, আমিনিয়া ছিল। এখন তো শুনলাম অনেক নতুন দোকান হয়েছে। জামশিদের স্ত্রী-ও নিমন্ত্রণ করেছে, ওর বাড়ি যাওয়ার জন্য। ইস্টবেঙ্গল, মহমেডানের যে মেসে থাকতাম সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সময় খুব কম।

আনন্দবাজার: বর্ষার কলকাতায় ইস্টবেঙ্গলে এসে ইলিশ মাছ খাবেন না?

মজিদ: আরে ওই মাছটা তো রোজ ভেজে খেতাম আমি আর জামশিদ। জামশিদের বাড়ি গেলে ওই ফ্রাইটা আবার খাব। দুর্দান্ত স্বাদ।

আনন্দবাজার: মঙ্গলবার মঞ্চে উঠে কী বলবেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের?

মজিদ: জানি না। হয়তো আবেগে কথাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তিন দশক পরে ফিরে যে ভালবাসা পাচ্ছি, সেটাই অভিভূত করে দিচ্ছে আমাকে। সুযোগ পেলে বলব, আনন্দের সঙ্গে শতবর্ষের উৎসব পালন করুন। আমাদের সময়ে ইস্টবেঙ্গল যেমন ভারত সেরা ছিল, সে ভাবেই এই ক্লাবকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যেতে হবে খেলোয়াড়দের।

আনন্দবাজার: কলকাতায় আপনার প্রথম কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (পিকে) কথা মনে আছে?

মজিদ: আমরা যখন এলাম, তখন আমাদের দেশের আয়াতুল্লা খোমেইনির যুগ। পিকে এক দিন আমাদের তিন ইরানিকে ডেকে বললেন, শোনো হে, আমার ক্ষমতা কিন্তু খোমেইনির থেকেও বেশি। শুনে আমি আর জামশিদ অবাক হয়ে গেলাম। বলে কী লোকটা? খাবাজি আবার এ সব শুনে রেগে যেত। আমরা হাসতাম। তবে নিঃসন্দেহে বড় কোচ। ফুটবলটা ভাল বোঝেন। আমিও মাঝে মাঝে রেগে যেতাম। বলতাম, আপনি এমন সব কথা দ্রুত বলে যান, যা ঠিক নয়। পিকে এ সব শুনলে কোনও কথা বলতেন না। পরে আমাদের দোস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। পিকে কত বড় কোচ তা বুঝেছিলাম ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে। আমাদের বিশ্বকাপ দলের কোচ আমি ভারতে খেলি শুনে বলেছিলেন, ওখানে পিকে ব্যানার্জি বলে এক জন কোচ আছেন। দুর্দান্ত ফুটবল বোধ ওঁর। আমি যখন বললাম, পিকে-র কোচিংয়ে আমি দু’বছর খেলেছি, তখন উনি অবাক। বলছিলেন, ভারতে গিয়ে তো তুমি দুর্দান্ত এক জন কোচ পেয়েছ। পিকে মঙ্গলবার আসবেন? ওঁকে খুব দেখার ইচ্ছে।

ভাস্কর: কয়েক দিন আগে ইস্টবেঙ্গলের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রদীপদা এসেছিলেন। জানি না, ১৩ অগস্ট আসতে পারবেন কি না? আসতেও পারেন।

আনন্দবাজার: সেরা ম্যাচ কোনটা?

মজিদ: মুম্বইয়ের এয়ার ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক। একটা গোল করেছিলাম ৩০ গজ দূর থেকে।

জামশিদ: খুব সম্ভবত ওটাই ছিল প্রথম এয়ারলাইন্স কাপ। ১৯৮৬ সাল। হারিয়েছিলাম এয়ার ইন্ডিয়াকে।

আনন্দবাজার: ভারতে আপনার ফুটবল জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত কী?

মজিদ: দার্জিলিং গোল্ড কাপে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ২ গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পনেরো মিনিটে তিন গোল করে আমরা জিতেছিলাম।

আনন্দবাজার: যে দিন কখনও মনে করতে চান না?

মজিদ: ১৯৮০-র ১৬ অগস্ট। ম্যাচের পরের দিন খবরের কাগজে সমর্থকদের মৃত্যুর খবর পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম।

আনন্দবাজার: তিরিশ বছর হল ইরানে ফিরে গিয়েছেন। কলকাতা বা ভারতীয় ফুটবলের খোঁজ রাখেন?

মজিদ: ইস্টবেঙ্গল বা অন্য কোনও ক্লাবের খোঁজ রাখিনি। তবে ভারতীয় দলের খেলা দেখেছি। অনেক উন্নতি করেছে। ক্লাব ফুটবল ছেড়ে ভারতীয়রা জাতীয় দলের দিকে নজর দিলে আরও ভাল করবে।

(সাক্ষাৎকার: রতন চক্রবর্তী , শুভজিৎ মজুমদার , দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy