দিল্লি হাই কোর্ট। —ফাইল ছবি
টোকিয়ো অলিম্পিক্সে টেবল টেনিসের সিঙ্গলসে ভারতের চার জন প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। দু’জন পুরুষ এবং দু’জন মহিলা বিভাগে। একটি দেশ থেকে অলিম্পিক্স টেবল সিঙ্গলসে সর্বোচ্চ চার জনই সুযোগ পান। টানা দ্বিতীয় বার ভারতীয় দল এই সুযোগ পেয়েছিল দোহার যোগ্যতা অর্জন পর্বে সাফল্যের সুবাদে।
দোহার সেই যোগ্যতা অর্জন পর্ব হতে পারত দেশের জন্য গর্বের মুহূর্ত। কিন্তু মহিলা টেবল টেনিস তারকা মনিকা বাত্রার বিস্ফোরক অভিযোগের জেরে তৈরি হয় বিতর্ক। যার জল গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। জাতীয় টেবল টেনিস সংস্থার সঙ্গে খেলোয়াড়দের সম্পর্কও চলে আসে আতশ কাচের তলায়। মনিকার করা মামলায় গত শুক্রবার দিল্লি হাই কোর্ট রায় দিয়েছে। টেবল টেনিস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া (টিটিএফআই)-র এগ্জিকিউটিভ কমিটিকে সাসপেন্ড করেছে আদালত।
তৎকালীন জাতীয় কোচ সৌম্যদীপ রায়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তোলেন মনিকা। তাঁর অভিযোগ ছিল, অলিম্পিক্সে যোগ্যতা অর্জন পর্বের একটি ম্যাচ ছেড়ে দিতে বলেন সৌম্যদীপ। তাতে, সৌম্যদীপের ছাত্রী সুতীর্থা চক্রবর্তীর অলিম্পিক্সের ছাড়পত্র পাওয়া সহজ হত। দিল্লি হাই কোর্ট মনে করছে, তারকা খেলোয়াড়ের সঙ্গে জাতীয় কোচের এই দ্বন্দ্ব যথাযথ ভাবে সামলাতে পারেনি ফেডারেশনের এগ্জিকিউটিভ কমিটি। সে কারণেই কমিটিকে সাসপেন্ড করে তিন সদস্যের প্রশাসক মণ্ডলী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি রেখা পাল্লি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ফেডারেশনের কাজ সামলাবেন প্রশাসকরা।
টোকিয়ো গেমসের সময়ই প্রকাশ্যে আসে এই বিতর্ক। জাতীয় দলের কোচ সৌম্যদীপকে ছাড়াই অলিম্পিক্সে তিনটি সিঙ্গলস ম্যাচ খেলতে নামেন মনিকা। কোচ ছাড়া খেলার কারণ হিসেবে মনিকা তখনই জানান, যোগ্যতা অর্জন পর্বে সৌম্যদীপের দেওয়া ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাবের কথা। মনিকাকে ম্যাচের সময় গ্যালারি থেকে পরামর্শ দিতে দেখা যায় তাঁর ব্যক্তিগত কোচ সন্ময় পরাঞ্জাপেকে।
অলিম্পিক্সের ছ’মাস আগে হয়েছিল যোগ্যতা অর্জন পর্বের প্রতিযোগিতা। সেই ছ’মাসে মনিকার অভিযোগ সম্পর্কে কেন টিটিএফআই কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, সে প্রশ্ন তুলেছে দিল্লি হাই কোর্ট। ওই সময় টিটিএফআই-এর এগ্জিকিউটিভ কমিটির ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেছেন বিচারপতি। টিটিএফআই-এর বিরুদ্ধে করা মামলায় মনিকার পক্ষে রায় দিতে গিয়ে সৌম্যদীপকেও দোষী সাব্যস্ত করেছে হাই কোর্ট। দেশের এক নম্বর মহিলা টেবল টেনিস খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁকে অলিম্পিকের পর এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য ভারতীয় দলে রাখা হয়নি, সে প্রশ্নও উঠেছে।
প্রসঙ্গত, শুধুমাত্র জাতীয় শিবিরে যোগ না দেওয়ার কারণ দেখিয়ে দলে রাখা হয়নি মনিকাকে। অথচ সেই সময়, বিশ্ব ক্রম তালিকায় প্রথম ৫০-এ ছিলেন তিনি। পাশাপাশি টোকিয়ো অলিম্পিকে সিঙ্গলস ম্যাচের সময় কোচ হিসেবে সৌম্যদীপকে মেনে না নেওয়ার জন্যও টিটিএফআই কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় মনিকাকে। এর পরেই ফেডারেশনের বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন মনিকা।
দিল্লি হাই কোর্ট শুরুতেই সৌম্যদীপের বিরুদ্ধে মনিকার ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগের তদন্তের জন্য তিন সদস্যের প্যানেল তৈরি করে। গত নভেম্বরে সেই কমিটি আদালতকে রিপোর্ট দিয়েছে। তদন্তকারীরা আদালতকে জানান, মনিকা অভিযোগ করা সত্ত্বেও টিটিএফআই বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আদালত বলেছে, ‘২০২১ সালের ১৮ মার্চ এশিয়ান অলিম্পিক্স কোয়ালিফিকেশন টুর্নামেন্টে ম্যাচ হারতে চাপ দেওয়ার অভিযোগ ওঁর (সৌম্যদীপ) বিরুদ্ধে করেন তিনি (মনিকা)। সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেশনকে জানানোর পরেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওঁর (সৌম্যদীপ) ম্যাচ গড়াপেটার চেষ্টা ছিল নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাডেমির এক জনকে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার জন্য। পরিবর্তে ওঁর (সৌম্যদীপ) নির্দেশে তাঁকে (মনিকা) হেনস্থা করা হয় এবং টোকিয়ো অলিম্পিক্সে তাঁকে ব্যক্তিগত কোচকে ছাড়াই খেলতে বাধ্য করা হয়েছিল।’ আদালত জানায়, একটি জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার ক্রীড়াবিদদের পাশে থাকা উচিত। এই আচরণ একদমই প্রত্যাশিত নয়।
অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন প্রতিযোগিতার সময় বিশ্ব ক্রমতালিকায় মনিকা ছিলেন ৬৮ নম্বরে। অন্য দিকে, সুতীর্থা চক্রবর্তী ছিলেন ৯৮ নম্বরে। প্রতিযোগিতার ফাইনালে তাঁরাই মুখোমুখি হন। পরিস্থিতি এমন ছিল, যিনি ক্রমতালিকায় এগিয়ে থাকা খেলোয়াড় এবং প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন অলিম্পিক্সের টিকিট পাবেন। ফাইনালের আগে সৌম্যদীপ ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন মনিকাকে। সাত বছর ধরে কোচিং করানো সুতীর্থার অলিম্পিক খেলা নিশ্চিত করতেই এই প্রস্তাব দেন সৌম্যদীপ। সুতীর্থা ফাইনালে ৭-১১, ১১-৭, ১১-৪, ৪-১১, ১১-৫, ১১-৪ ফলে জেতায়, দু’জনেই অলিম্পিক্সে খেলার ছাড়পত্র পান। পুরুষ সিঙ্গলসের ফাইনালেও এমনই হয়েছিল। ক্রমতালিকায় এগিয়ে থাকা শরৎ কমল (৩৮) ফাইনালে হেরে যান ক্রমতালিকায় পিছিয়ে থাকা সাথিয়ান জ্ঞানশেখরনের কাছে। ফলে দু’জনেই টোকিয়োর ছাড়পত্র পান। এই প্রতিযোগিতার পরেই সৌম্যদীপের বিরুদ্ধে টিটিএফআই-কে অভিযোগ জানান মনিকা।
তার প্রেক্ষিতে টিটিএফআই মনিকাকে কারণ দর্শানোর জন্য চিঠি দেয়। মনিকা জানান, গড়াপেটার প্রস্তাব দেন এমন কারও অধীনে খেলতে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না। অগস্টে টিটিএফআই জানায়, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের দলে থাকার জন্য জাতীয় শিবিরে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। সৌম্যদীপের অধীনে শিবির হওয়ায় যোগ দেননি মনিকা। এর পর তাঁকে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের দল থেকে বাদ দেওয়া হলে দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন মনিকা।
আদালত নিযুক্ত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি রিপোর্টে জানায়, এক জন খেলোয়াড়ের স্বার্থের থেকে ফেডারেশন বেশি গুরুত্ব দিয়েছে অধিকারিকদের। তাঁদের সুরক্ষিত রাখতে সম্ভাব্য সব কিছুই করেছে। সৌম্যদীপের বিরুদ্ধে আদালত স্বার্থের সঙ্ঘাতের কথাও বলেছে। কারণ, সৌম্যদীপ জাতীয় কোচ হওয়ার পাশাপাশি দলের এক সদস্যের ব্যক্তিগত কোচও। জাতীয় কোচ নিযুক্ত হওয়ার পরেও সৌম্যদীপ তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাডেমির কোচ হিসেবে কাজ চালিয়েছেন। যা প্রাথমিক ভাবে স্বার্থের সঙ্ঘাতকেই বাড়িয়েছে।
আদালত ২০১১ সালের জাতীয় ক্রীড়া কোড থেকে উদ্ধৃত করেছে করেছে যা একটি জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার সাসপেনশন এবং প্রত্যাহার সম্পর্কিত। যাতে বলা হয়েছে, যদি একটি জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার কাজে গুরুতর অনিয়ম শনাক্ত হয় তা হলে তদন্ত সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে সংস্থার স্বীকৃতি স্থগিত করা হবে। বিচারপতি পাল্লি রায় দেওয়ার সময় বলেন, ‘‘এই আদালতের মতে বিষয়গুলি গভীর ভাবে যাচাই না করা পর্যন্ত একটি স্বাধীন কমিটি প্রয়োজন। ভারত সরকার নিয়োজিত বা একটি স্বাধীন প্রশাসকদের কমিটি দরকার। ফেডারেশনের কাজ পরিচালনার জন্যই নিযুক্ত করা দরকার।’’ এর পরেই তিন সদস্যের প্রশাসক মণ্ডলী গঠন করে আদালত। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি গীতা মিত্তলের নেতৃত্বে কমিটিতে রয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী চেতন মিত্তল এবং প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ এসডি মুদগিল।
সম্পূর্ণ তদন্ত শেষ হতে ছ’মাস লাগবে বলে মনে করছে দিল্লি হাই কোর্ট। তাতেই সৌম্যদীপের ভূমিকাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিচারপতি পাল্লি বলেছেন, ‘‘আমি আন্তরিক ভাবে আশা করি যে, এই আদেশটি সরকার এবং অন্য সব ক্রীড়া সংস্থার কাছে এই বিষয়ে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ করার জন্য একটি জাগ্রত আহ্বান হিসেবে কাজ করবে।’’ বিচারপতি আরও বলেছেন, ‘‘জাতীয় কোচ হিসেবে নিযুক্ত ব্যক্তিকে একই সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাডেমি চালানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয় জাতীয় সংস্থাগুলির। এই ধরণের সঙ্ঘাত এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদের ক্রীড়াবিদরা অবশ্যই আরও ভাল কিছু পাওয়ার যোগ্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy