প্রাপ্তি: কোচ হিসেবে এটাই ছিল তাঁর শেষ প্রতিযোগিতা। বিদায়ী উপহার হিসেবে বিশ্বকাপ হাতে তুলে দেওয়ার পরে দ্রাবিড়কে নিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতলেন বিরাট, কুলদীপেরা। ছবি: সংগৃহীত।
আচ্ছা, বার্বেডোজ়ে কি রাত্তিরবেলাতেও সূর্যোদয় হয়?
না হলে শেষ ওভারের উথালপাথাল করা স্নায়ুর চাপের মধ্যে সূর্যকুমার যাদবের ক্যাচকে আর কী ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? যে ক্যাচটাতে তিনি ‘কিলার’ মিলারকে ফিরিয়ে দিয়ে নিশ্চিত করলেন, ১৯ নভেম্বরের আমদাবাদ ফিরবে না ২৯ জুনের বার্বেডোজ়ে।
আইপিএলের সৌজন্যে এই ধরনের ক্যাচ এখন প্রায়ই দেখা যায়। বলটা লুফে নেওয়ার পরে শরীর বেরিয়ে যাচ্ছে, ভারসাম্য ধরে রাখা যাচ্ছে না দেখে ফিল্ডার বাউন্ডারির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলটা শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছেন। তার পরে বল বাতাসে থাকা অবস্থায় গোলদড়ির ওপার থেকে ফিরে এসে সেটাকে তালুবন্দি করে নিচ্ছেন। ক্রিকেটের আইন অনুযায়ী আউট, কারণ শরীর যখন সীমানার বাইরে যাচ্ছে, তখন বলের সঙ্গে সংস্পর্শ নেই। কিন্তু যত সহজে বলা হল, তত সহজে কি করে দেখানো সম্ভব? কোথায় আইপিএল আর কোথায় বিশ্বকাপ ফাইনাল? দু’টোর চাপের মধ্যে কোনও তুলনা হতে পারে? আইপিএলে শুধু একটা শহরের প্রতিনিধিত্ব করতে হয় ক্রিকেটারদের। দেশের জার্সিতে দেড়শো কোটির প্রার্থনা, প্রত্যাশার উথালপাথাল করা চাপ। কখনও এক হতে পারে?
তার মধ্যে শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার দরকার তো ছিল মাত্র ১৬। মিলার কত বার মেরে তুলে দিয়েছেন। যে কারণে তাঁর নাম হয়েছে ‘কিলার মিলার’। বোলারের নামও হার্দিক পাণ্ড্য, যশপ্রীত বুমরা নয়। তাঁর ওভার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কে জানত, আজ হার্দিক আলিঙ্গনে উৎসব করার দিন। সূর্যকুমারের ক্যাচটা দেখে ক্রিকেট নয়, নাদিয়া কোমানেচির জিমন্যাস্টিক্স মনে পড়ে যাচ্ছিল। ক্রিকেটে ‘পারফেক্ট টেন’ বলে কিছু চালু নেই কেন, কে জানে!
আচ্ছা, ক্রিকেট কি কাউকে জাদুকাঠির ছোঁয়ায় রাতারাতি খলনায়ক থেকে নায়কে পাল্টে দিতে পারে? না হলে দামাল হার্দিকের বল হাতে এই কামালের কী ব্যাখ্যা? গত কয়েক মাস ধরে যিনি শুধু ট্রোল্ডই হয়েছেন, টুইটারে টানা এমন তুলোধনা হয়েছেন যে, মনে হবে কাউকে খুন-টুন করে পালিয়েছেন। অপরাধ কী? না, রোহিত শর্মার জায়গায় মুম্বই ইন্ডিয়ানসের অধিনায়ক হয়েছেন! জনতার হৃদয়জুড়ে রোহিত। তিনি কোথাকার কে হার্দিক পাণ্ড্য কী করে সেই জায়গা ছিনিয়ে নেন? ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি করতেও ছাড়েনি জনতা। বিবাহ-বিচ্ছেদের সম্ভাবনা নিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়। শোনা যাচ্ছে ভাল মন দেখিয়ে সৎ ভাইকে নিজেদের সংসারে নিয়ে এসেছিলেন। সে ঠকিয়ে অনেক টাকা লুঠপাট করে নিয়েছে।
ক্রিকেট অদৃষ্টের এমনই বিচার! নিন্দিত খলনায়ককেই বন্দিত নায়ক করে দিল শনিবারের বার্বেডোজ়ে। তেরো বছর ধরে অধরা থাকা বিশ্বকাপ ঘরে আনার ফাইনালে শুধু দুর্দান্ত একটা শেষ ওভারই করলেন না হার্দিক। তার আগে হাত থেকে ফস্কে যাওয়া ম্যাচ আবার ভারতের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হেনরিখ ক্লাসেনকে ফিরিয়ে। দারুণ বুদ্ধি করে অফস্টাম্প থেকে দূরে বলটা রেখেছিলেন হার্দিক। সেই সময় ক্লাসেন টপ গিয়ারে। সেই তোড়ে চালাতে গিয়ে ঋষভ পন্থের হাতে ক্যাচ দিয়ে গেলেন। বিরাট কোহলির উত্তেজক প্রতিক্রিয়া বলে দিল, ম্যাচ ঘুরছে! গ্যালারি এত ক্ষণ ক্লাসেন ঝড় দেখে ঝিমিয়ে পড়েছিল। নীল সমুদ্রে তরঙ্গ ফিরল। ভাঁজ করে রাখা তেরঙ্গা আবার বার করে দোলানো শুরু হল। কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকালেন। মন্ত্রজপ ফিরল।
আইপিএলে এ বার এমনই সব দুর্ধর্ষ ইনিংস খেলে গিয়েছেন ক্লাসেন। ইডেনে দু’শোর উপরে রান তাড়া করে কেকেআরকে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিলেন সানরাইজ়ার্স হায়দরাবাদের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান, মনে নেই? এ দিনও দক্ষিণ আফ্রিকার ‘চোকার্স’ তকমা ঘুচিয়ে নীল সমুদ্রের অপেক্ষা বাড়ানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। ২৭ বলে ৫২, পাঁচটা ছয় মেরে দিয়েছেন। ক্রিজে তখন সঙ্গী আবার মিলার। দু’জনে এমন ভাবে খেলছিলেন যে, মনে হচ্ছিল, শুধু জিততেই চান না। অনেক আগেই তুবড়ে দিয়ে জিতবেন। ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ পঁচিশ গজ পিছনে দৌড়ে কপিল দেব না ধরলে যেমন তিরাশির বিশ্বকাপ জেতা হয় না, তেমনই হার্দিকের ওই ক্লাসেন-বধ না ঘটলে ২০২৪-এর টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়ন হওয়া হত না।
বিশ্বজয়ী হওয়ার আনন্দে হার্দিক দেখা গেল কথাই বলতে পারছেন না। বারবার কেঁদে ফেলছেন। শুধু ক্রিকেট তো নয়, জীবনযন্ত্রণাও ঠিকরে বেরোচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, হত কয়েক মাস ধরে কয়েদি হয়ে জেলের ঘুপচি ঘরে পচতে থাকা কাউকে আজ মুক্তি দিয়ে দিল ক্রিকেট। জাদুঘরে ঢুকে থাকার মতো একাধিক ছবি তৈরি হল বার্বেডোজ়ের মাঠে। ঠিক যেমন হয়েছিল ২০১১-র ২ এপ্রিল, ওয়াংখেড়েতে। রোহিত শর্মা এসে হার্দিকের গালে চুম্বন দিয়ে দিলেন। হার্দিক তখন চোখের জল মুছতে মুছতে সম্প্রচারকারী চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। কে বলবে, ক’দিন আগেও অধিনায়কত্বের ব্যাটন বদল নিয়ে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিই ছিল খবরের শিরোনামে। আজ পুরনো সব দাগ, সব যন্ত্রণা মুছে যাওয়ার দিন।
রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলি নিজেদের তেরঙ্গায় জড়িয়ে ট্রফি হাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করলেন। কোহলি ঘোষণা করে দিলেন, দেশের জার্সিতে টি-টোয়েন্টি যাত্রা এখানেই শেষ। এর চেয়ে ভাল মূহূর্ত আর কী হতে পারে? সারা প্রতিযোগিতায় ব্যাটে রান নেই। কিন্তু বড় খেলোয়াড় মানেই যে বড় মঞ্চে ঝলসে ওঠা। শুরুই করলেন এমন ভঙ্গিতে যে, তখনই বোঝা গেল আজ কোহলিয়ানার সেই জেদ, প্রতিজ্ঞা নিয়ে নেমেছেন।
২০১১ বিশ্বকাপ জিতে সচিনকে কাঁধে ঘোরাতে ঘোরাতে সেরা মন্তব্য উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন কোহলি। অমর হয়ে আছে সেই উক্তি, ‘‘চব্বিশ বছর ধরে ভারতীয় ব্যাটিংকে কাঁধে বয়ে বেড়িয়েছে এই লোকটা। এখন আমাদের দায়িত্ব ওঁকে কাঁধে করে ঘোরানোর।’’ এ দিন আরও কয়েকটি মণিমুক্তো উপহার দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘‘আমি পাঁচটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছি। রোহিত খেলেছে ন’টা। সব চেয়ে বেশি করে এই বিশ্বকাপ যদি কারও প্রাপ্য হয়, তা হলে সেটা রোহিতেরই।’’ সচরাচর প্রকাশ্যে চোখের জল ফেলতে দেখা যায় না কোহলিকে। কিন্তু ২৯ জুনের বার্বেডোজ় ব্যতিক্রম। হর্ষ ভোগলে ইন্টারভিউ নিতে নিতে বলেই ফেললেন, ‘‘তোমাকে এ ভাবে চোখের জলে দেখি না আমরা।’’ কোহলি বললেন, ‘‘আজ অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারছি না।’’
আর তিনি রাহুল দ্রাবিড়? তিনি কোথায়? কোহলি এসে বিশ্বকাপ তুলে দিলেন তাঁর হাতে। কোহলি যখন অধিনায়কত্ব থেকে সরে গিয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, দ্রাবিড় প্রবল ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ কোহলির ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। কিন্তু তিনিও যে রাহুল দ্রাবিড়। মহাতারকা হয়েও চিরকাল প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। এখনও টুইটার, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট নেই। টিভিতে দেখে মনে হল, প্রথমে ট্রফিটা নিতেই চাইছিলেন না। তোমাদের ট্রফি, তোমরা জিতেছ। তোমাদের হাতেই শোভা পায়। চিরকালের সেই দ্রাবিড় সভ্যতা। কিন্তু কোহলিও নাছোড়। দ্রুত যোগ দিলেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ট্রফি হাতে নিতেই হল বিদায়ী কোচকে। তার পরে সেই ট্রফিকে দু’হাতে তুলে ধরে শিশুর মতো উল্লাস। এত উচ্ছ্বসিত আর কখনও দেখা গিয়েছে তাঁকে? এর পরে কোহলিরা বিদায়ী কোচকে শূন্যে তুলে লোফালুফি করলেন।
২০০৩-এ অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে হার। ২০০৭-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে অধিনায়ক হিসেবে বিপর্যয়। ২০২৩-এ কোচ হিসেবে আমদাবাদে স্বপ্নভঙ্গ। অবশেষে বিশ্বকাপে শাপমোচন। রাহুল দ্রাবিড়, আজ না হয় নীরব যোদ্ধার বর্ম সরিয়ে একটু হাসলেন! আনন্দ করলেন! ক্ষতি কী? সেই সময় আবার বার্বেডোজ়কে মনে হচ্ছিল যেন শাপমোচন আর গুরুদক্ষিণার মোহনা। দু’টো আবেগই তো একসঙ্গে ধরা থাকল।
সারা মাঠ জুড়ে আরও কী সব দৃশ্য! সিরাজ গিয়ে জড়িয়ে ধরে আছেন রোহিত শর্মাকে। ছাড়ছেনই না। দেখে মনে হবে, বড় ভাই উপহার নিয়ে এসে দিয়েছেন ছোটকে। সেই আনন্দে আত্মহারা ছোট। যুজ়বেন্দ্র চহাল একটাও ম্যাচ খেলেননি। কিন্তু ডাগআউটে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এমন জোরে হাততালি দিচ্ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল যেন দলের ক্রিকেটার নন, ‘ব্লু টাইগার্স’-এর ভক্ত। চোখের জলও যে কত প্রকারের হয় আজ আবার দেখে নেওয়া গেল। কোহলি, রোহিত, হার্দিকদের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি রাহুল দ্রাবিড়ও এক বার হাত দিয়ে চোখ মুছলেন। অন্য দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের সঙ্গী হল যন্ত্রণার অশ্রু। ফাইনাল না জিতুন, আজ অন্তত ক্লাসেনদের যেন ‘চোকার্স’ না বলা হয়। যথেষ্ট লড়াই করে তাঁরা হেরেছেন। যে কেউ জিততে পারত ফাইনাল।
আচ্ছা, যশপ্রীত বুমরার জীবনের চিত্রনাট্য কে লেখেন? ভাগ্যের কী পরিহাস! নিজের শহর আমদাবাদে ১৯ নভেম্বর, ২০২৩-এ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবেন কিন্তু জিতবেন না। অথচ গোটা বিশ্বকাপ দুর্ধর্ষ বোলিং করেছেন। কাপ জিতবেন কোথায়? না, শত সহস্র মাইল দূরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে। কয়েক দিন আগেই কপিল দেব বলেছেন, ‘‘আমার চেয়েও হাজার গুণ ভাল বুমরা।’’ এর চেয়ে বড় শংসাপত্র ভারতীয় ক্রিকেটে আর কিছু আছে? বুমরা যেন কপিলের প্রশংসার উৎসব করতে বেছে নিয়েছিলেন ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কেই।
এই লাইনটা লিখতে গিয়ে কেমন শিহরণ হচ্ছে। ক্লাইভ লয়েড মানে তো সেই অধিনায়ক, যাঁর অপ্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে হারিয়ে তিরাশি বিশ্বকাপ জিতেছিল কপিল দেবের ভারত। সবই কি অদৃষ্টের ঠিক করে রাখা? কপিল বলবেন বুমরাকে নিয়ে। তেরো বছর ধরে না জেতা বিশ্বকাপ বুমরা-রা জিতবেন কপিলের তিরাশি প্রতিপক্ষদের দ্বীপপুঞ্জে। এক জন বোলার বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হচ্ছেন, আগে কখনও হয়েছে? নানা রংয়ের রামধনুতে ভেসে যেতে যেতে এক্ষুনি মনে পড়ছে না।
বিরাটের মতো রোহিতও জানিয়ে দিলেন, দেশের হয়ে এটাই শেষ টি-টোয়েন্টি। ভারতীয় ক্রিকেটের দুই জাদুকর। নীল জার্সিতে আর তাঁদের কুড়ি ওভারে দেখা যাবে না। দ্রাবিড়কে আর কখনও কোনও ক্রিকেটেই হয়তো দেখা যাবে না। চিরকালের মতো হয়তো তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন ভারতীয় ড্রেসিংরুমে। ১৯ নভেম্বর, ২০২৩-এর রাতে তিন জনে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন বিষণ্ণ ভাবে। হয়তো বলছিলেন, ‘‘ঈশ্বর এই দিনটা কেন দিলে?’’ ২৯ জুন, ২০২৪-এও তাকালেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য। আচ্ছা অপেক্ষার রং যদি ধূসর হয়, তাহলে স্বপ্নপূরণের রং কী? নীল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy