Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
T20 World Cup 2024

২২ গজে আফগানদের জয় আর অঘটন নয়, বিপক্ষের যন্ত্রণা! লড়াই, অধ্যবসায়, সাধনার ফল পাচ্ছেন রশিদেরা

প্রকৃতির রুক্ষতা যাদের বশ করতে পারে না, তাদের কাছে ২২ গজ সমতল কি প্রতিকূল হতে পারে? লড়াই আফগানদের মজ্জাগত। সে রাজনৈতিক, মানবাধিকার রক্ষার, নারী স্বাধীনতার বা ক্রিকেটের।

Picture of Afghanistan Cricket Team

আফগানিস্তানের ক্রিকেট দল। ছবি: আইসিসি।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ১১:১৯
Share: Save:

সাদা বলের ক্রিকেটে আফগানিস্তান আর ‘ছোট দল’ নয়। এক দিনের বিশ্বকাপের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রশিদ খানদের সাফল্য সমীহ করার মতোই। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের এই উত্থান ক্রিকেটের জন্য ইতিবাচক। আরও বেশি হয়তো আফগানদের জন্য।

সাদা বলের ক্রিকেটে আফগানিস্তান আর ‘ছোট দল’ নয়। এক দিনের বিশ্বকাপের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রশিদ খানদের সাফল্য সমীহ করার মতোই। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের এই উত্থান ক্রিকেটের জন্য ইতিবাচক। আরও বেশি হয়তো আফগানদের জন্য।

গোলাগুলি, ভূমিকম্পের মাঝেও তালিবানের দেশ বেঁচে আছে ক্রিকেটেই। রশিদ, মহম্মদ নবি, নবীন উল হক, রহমানুল্লাহ গুরবাজ়েরা প্রমাণ করে দিয়েছেন সাধনার কাছে হার মানতে বাধ্য প্রতিকূলতা। গত বছর ভারতের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপেও প্রথম ছয় দলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল আফগানিস্তান। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন রশিদেরা। আফগানদের ক্রিকেটীয় দাপট চোখ খুলে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বের। সেই দাপট যে হঠাৎ বা সাময়িক ছিল না, তা আফগান ক্রিকেটারেরা প্রমাণ করে দিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। গ্রুপ পর্বে নিউ জ়িল্যান্ড এবং সুপার এইট পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে হারতে হল আফগানদের কাছে। কোনও রকমে নয়। বরং দাপুটে, আগ্রাসী ক্রিকেট খেলেই জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন রশিদেরা।

দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় লড়াই আফগানদের মজ্জাগত। সে রাজনৈতিক লড়াই হোক, মানবাধিকারের জন্য বা নারী স্বাধীনতার জন্য হোক বা ক্রিকেট মাঠে। লড়াই, লড়াই এবং লড়াই। একটি মন্ত্রে বাধা আফগানদের জীবন। সেই মন্ত্রের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ২২ গজের বিশ্বযুদ্ধে। দু’বছর আগে আফগানিস্তান নামটা শুনলেই উঠে আসত তালিবানের কথা। গোটা দেশের উপর শাসন কায়েম করতে তখন চারিদিকে গুলির আওয়াজ। তার মাঝে ব্যাট, বলের শব্দ শোনার কথা ভাবাই যেত না। তার মধ্যেও ক্রিকেট বেঁচে ছিল। তা না হলে বিশ্বকাপের মঞ্চে আফগানিস্তান ব্যাট, বলের শব্দ শোনাতে পারত না ক্রিকেট বিশ্বকে। তথাকথিত বড় দলের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের জয় এখন আর অঘটন নয়। অন্তত সাদা বলের ক্রিকেটে আফগানিস্তান এখন যে কোনও প্রতিপক্ষের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। আফগানেরা ক্রিকেট মাঠে বাঘ হতে চাননি। হায়নার মতো শিকার খুঁজে নিচ্ছেন।

আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সদর দফতর তালিবানদের দখলে।

আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সদর দফতর তালিবানদের দখলে। —ফাইল চিত্র।

রশিদেরা নিজেদের দেশের মাটিতে খেলতে পারেন না। যে দেশে পরের দিনের সূর্য দেখতে পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে ক্রিকেট সত্যিই অবাস্তব। তাই রশিদেরা এখনও জানেন না ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সময় সমর্থকদের চিৎকার কেমন হয়। তাকিয়ে থাকেন ভারতের দিকে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) প্রথম থেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছে। একটা সময় পর্যন্ত ধর্মশালা ছিল আফগান ক্রিকেটের ‘হোম’। নতুন চুক্তিতে নয়ডার নতুন স্টেডিয়াম। যে মাঠে ভারতের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন রশিদেরা। নিশ্চিন্তে অনুশীলনের সুযোগ, আধুনিক পরিকাঠামো, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম সব কিছু দিয়েই আফগানিস্তানের ক্রিকেটকে সাহায্য করেছে বিসিসিআই। তবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিদেশে পড়ে থেকে আসল লড়াইটা করেছেন আফগানিস্তানের ক্রিকেটারেরাই। সেই লড়াই, অধ্যবসায়, সাধনার ফল পাচ্ছে আফগানিস্তানের ক্রিকেট। অনেক কিছু নেইয়ের মাঝে এটুকু আনন্দ পাচ্ছেন সে দেশের সাধারণ মানুষও। আফগানিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার করিম সাদিক এখনও একটি ম্যাচের কথা ভুলতে পারেননি। ক্রিকেট মাঠে বোমা ছোড়া হয়েছিল। তিনি এক বার বলেছিলেন, “আমার দিকে বোমা ছুড়েছিল। চোখের সামনে দেখলাম দর্শকেরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটছেন। অনেক মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দরজা দিয়ে বার হওয়ার সময় দেখলাম একের পর এক বোমা ফাটছে। তার মধ্যেও অনেককে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলাম।”

গুলি, বোমা, মিসাইলের শব্দ, বারুদের গন্ধে ভারী বাতাস, রক্ত, মৃত্যু— এ সব কিছুই যেন আফগানদের প্রতি দিনের সঙ্গী। হিন্দুকুশ পর্বতমালার ও পারে এক অন্য পৃথিবী। বাকি দুনিয়ার সঙ্গে যে পৃথিবীর যোগাযোগ সীমিত, নিয়ন্ত্রিত। তার মধ্যে লড়াই চালাচ্ছেন সে দেশের ক্রীড়াবিদেরা। ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবলের মতো খেলাগুলিতে উন্নতির চেষ্টা করছেন। ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন কোচ ইগর স্তিমাচের চাকরি যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের কাছে হার। খেলার মাঠে আফগানদের উন্নতি অন্যদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। কাটছে কিন্তু রক্ত পড়ছে না!

আফগানিস্তানের রাস্তায় ক্রিকেট।

আফগানিস্তানের রাস্তায় ক্রিকেট। —ফাইল চিত্র।

রাজনৈতিক কারণে বিদেশি ক্রিকেটারদের পক্ষে আফগানিস্তানে গিয়ে ক্রিকেট খেলা বা কোনও সাহায্য করা সম্ভব হয় না। কিন্তু তা-ও ঘরোয়া ক্রিকেট আছে আফগানিস্তানে। আফগান ক্রিকেট বোর্ড তরুণ প্রতিভা তুলে আনার জন্য প্রতি বছর স্পাগিজা ক্রিকেট লিগের আয়োজন করে। সেখান থেকেই উঠে আসেন জাতীয় দলের ক্রিকেটারেরা। সেখান থেকেই বিশ্বকে শাসন করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন রহমানুল্লাহ, নবীনেরা। চোখে চোখ রেখে লড়াই ছুড়ে দেন প্রতিপক্ষের দিকে। হারার আগে হার মেনে নেওয়া আফগানদের রক্তে নেই।

অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর আফগান অধিনায়ক রশিদ বলেছেন, ‘‘এই জয়টা আমাদের দল এবং দেশের জন্য বিরাট বড়। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর আনন্দই আলাদা। ২০২২ এবং ২০২৩ সালের বিশ্বকাপে আমরা চেষ্টা করেও পারিনি। তবে হাল ছাড়িনি। তারই পুরস্কার পেলাম এ বার।’’ এই হাল না ছাড়া মানসিকতাই এগিয়ে নিয়ে চলেছে আফগানিস্তানের ক্রিকেটকে। রশিদেরাও জানেন দেশবাসী তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাই দলের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মুখে উঠে এসেছে দেশের কথা।

গত আইপিএলের পর দেশে ফিরেছিলেন রশিদ। চার বছর পর। ক্রিকেটের জন্য নিজের বাড়িতে একটা রাত কাটানোর সুযোগ হয় না তাঁর। শুধু রশিদ নন, জাতীয় দলের সব ক্রিকেটারকেই পড়ে থাকতে হয় বিদেশে। আত্মীয়-পরিজনদের থেকে দূরে।

ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম একাদশে পরিবর্তন করে সাফল্য আসেনি। তাই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আবার গ্রুপ পর্বের প্রথম একাদশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আফগান শিবির। জয়ের পরেও রশিদ বলেছেন, ‘‘আমাদের ব্যাটিংটা ভাল হয়নি। শেষ দিকটা আরও ভাল করা উচিত ছিল। এই ধরনের পিচে ব্যাট করা কঠিন। তাই ১৪৮ রানের কমে অস্ট্রেলিয়াকে আটকে রাখার আত্মবিশ্বাস ছিল আমাদের। দলে পাঁচ-ছ’জন অলরাউন্ডার রয়েছে আমাদের। এটা একটা বাড়তি সুবিধা। মাঠে অনেক বিকল্প থাকে আমাদের হাতে। আমাদের দলের সৌন্দর্য এটাই। সবাই নিজের নিজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা দিয়ে চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষ নিয়ে বেশি ভাবি না আমরা। পরিকল্পনা মতো নিজেদের কাজটা ঠিক ভাবে করার চেষ্টা করি। বোলিংয়ের শুরুটা বেশ ভাল হয়েছে আমাদের। সব মিলিয়ে আমাদের পারফরম্যান্স ভালই হয়েছে। তবে এটা সবে শুরু। আমাদের চোখ থাকবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের দিকে।’’

রশিদ বলছেন, এখনও শুরু! তাঁরা মাটিতে পা রেখে এগোতে চাইছেন। সাফল্য আত্মতুষ্টিতে পরিণত হোক, চাইছেন না। একই সুর শোনা গিয়েছে ম্যাচের সেরা ক্রিকেটার গুলবাদিন নাইবের গলাতেও। তিনি বলেছেন, ‘‘এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। আমাদের দেশ এবং দেশবাসীদের জন্য এই জয়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সমর্থকেরা যে ভাবে সব সময় পাশে থাকেন তার জন্য কোনও ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। সত্যি বলতে ভাষা হারিয়ে ফেলছি।’’ কী ভাবে সাফল্য পেলেন? ২০ রানে ৪ উইকেটের রহস্য কী? নাইব বললেন, ‘‘এই ম্যাচ থেকেই শিক্ষা নিয়েছি। আমাদের ব্যাটারদের খেলা দেখে বোঝার চেষ্টা করেছি, এই পিচে কেমন বল করতে হবে। তবে এই জয় দলগত। আমাদের ওপেনিং জুটির কথা কী করে অস্বীকার করব! এই বিশ্বকাপে নিউ জ়িল্যান্ডের পর অস্ট্রেলিয়াকে হারালাম আমরা। সন্দেহ নেই অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন দল। দারুণ, দারুণ। সবাইকে ধন্যবাদ আমাদের পাশে থাকার জন্য।’’

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের গন্ধ পাওয়া রশিদ খান এবং রহমানুল্লাহ গুরবাজ়।

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের গন্ধ পাওয়া রশিদ খান এবং রহমানুল্লাহ গুরবাজ়। ছবি: আইসিসি।

দেশ, দেশ এবং দেশ। বিদেশে পড়ে থাকা আফগান ক্রিকেটারদের দেশের প্রতি, দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি টান একটু বেশিই। তাঁরাই জনতার নায়ক। আম আফগানদের শাহরুখ খান, অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দিক্ষিত, দীপিকা পাডুকোন, সচিন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহলি, পিভি সিন্ধু নেই। আছেন রশিদ খান, মহম্মদ নবি, ইব্রাহিম জ়াদরান, নবীন উল হকেরা।

আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের আবেদনে ২০১৭ সালে সাড়া দিয়েছিল বিসিসিআই। দেশে আন্তর্জাতিক সিরিজ় আয়োজনের সুযোগ ছিল না আফগানিস্তানের। রশিদেরা হোম সিরিজ়গুলি খেলতেন ভারতে। আয়ারল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাঁরা সিরিজ় খেলেছেন। লখনউ, দেহরাদূন, গ্রেটার নয়ডার স্টেডিয়ামে হত ম্যাচগুলি। ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসতে শুরু করে সাফল্য। আইসিসির কাছ থেকে টেস্ট খেলার ছাড়পত্রও পায় আফগানিস্তান। বিসিসিআই কর্তারা আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে মুনাফা করার কথা ভাবেননি। নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে দেওয়া হত সব সুবিধা।

ক্রিকেটের ‘বড়’ দলগুলির বিরুদ্ধে জেতা, ক্রমশ অভ্যাস করে ফেলেছেন রশিদেরা। তা-ও বলছেন শুরু! আফগান ক্রিকেটকে মধ্য গগনে দেখার অপেক্ষায় থাকবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। অন্তত সাদা বলের ক্রিকেটে আফগানিস্তানকে বাদ দিয়ে ভাবার আর সুযোগ নেই। উপায় নেই সমীহ না করে। প্রকৃতির রুক্ষতা যাদের বশ করতে পারে না, তাদের কাছে ২২ গজ সমতল কি প্রতিকূল হতে পারে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy