Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Paris Olympics 2024

স্বপ্নিলের স্বপ্নপূরণ, ভারত থেকে ট্যাটু-রহস্য ফাঁস করলেন ‘দ্বিতীয় মা’ দীপালি

ধোনির উত্থান রাঁচী থেকে, যা আগে বিখ্যাত ছিল পাগলা গারদের জন্য। তেমনই স্বপ্নিলের আগমন মহারাষ্ট্রের এক গ্রাম থেকে। বাবা স্কুলের শিক্ষক, মা গ্রামের ‘সরপঞ্চ’। ধোনির সঙ্গে সব চেয়ে বড় মিল, তিনি শুটিংয়ের ‘মিস্টার কুল’।

উচ্ছ্বাস: সোনা ও রুপোজয়ীর সঙ্গে নিজস্বী স্বপ্নিলের।

উচ্ছ্বাস: সোনা ও রুপোজয়ীর সঙ্গে নিজস্বী স্বপ্নিলের। ছবি: পিটিআই।

সুমিত ঘোষ
প্যারিস শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৫৬
Share: Save:

শুটিংয়ের মহেন্দ্র সিংহ ধোনি? বিশ্বকাপজয়ী ভারত অধিনায়কের যেমন খড়গপুর, তাঁর ক্ষেত্রে তেমন পুণে ডিভিশন স্টেশন। সেখানে টিটি-র চাকরি করেন তিনি। একটা সময়ে আমজনতার ভিড়ে মিশে থাকা সামান্য এক রেল বিভাগের কর্মী। কত লোক স্টেশনে নামার পরে হয়তো টিকিট দেখতে চেয়েছেন। কেউ চিনতেও পারেনি। টিকিট দেখিয়ে চলে গিয়েছে। তাঁরাই বিশ্ব মঞ্চে বাজিমাত করে দেখালেন। এমন আজগুবি চিত্রনাট্য মনে হয় মনমোহন দেশাইয়ের সেই অবাস্তব পুরনো ছবিতেও থাকত না।

ক্রিকেটে ধোনি ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। আর প্যারিস অলিম্পিক্স দেখল স্বপ্নিলের স্বপ্নপূরণ। বৃহস্পতিবার যে ইভেন্টে ৪৫১.৪ পয়েন্ট নিয়ে ব্রোঞ্জ জিতলেন স্বপ্নিল, তাতে আগে কোনও ভারতীয় কখনও পদক পাননি। সোনা জিতলেন চিনের লিউ ইউকুন। তাঁর অর্জিত পয়েন্ট ৪৬৩.৬। ইউক্রেনের সের্হেই কুলিশ ৪৬১.৩ পয়েন্ট পেয়ে রুপো জিতলেন। ৫০ মিটার রাইফেল থ্রি পোজিশন্‌স। শুটিংয়ের ট্রায়াথলন বলা হয় যে ইভেন্টকে এবং তুলনামূলক ভাবে অনেক কঠিন। তিনটি অবস্থানে গুলি চালাতে হয় বলেই এমন নামকরণ। প্রোন, নিলিং, স্ট্যান্ডিং। আর একটা ব্যাপার। মনু ভাকের যে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে ব্রোঞ্জ জিতলেন, তা হয় ইন্ডোরে। ৫০ মিটার রাইফেল থ্রি পোজিশন্‌স হয় আউটডোরে। তাই গুলি ছোড়ার সময় হাওয়াকেও বশ মানাতে হয়।

স্বপ্নিল প্রোন ও নিলিংয়ের পরে পাঁচ নম্বরে ছিলেন। কিন্তু দাঁড়ানো অবস্থায় গুলি চালানোটাই তাঁর শক্তিশালী জায়গা। স্ট্যান্ডিং রাউন্ডেই বাজিমাত করেন তিনি। ‘‘আমি স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাচ্ছিলাম না। পরের গুলিটা চালানোর উপরে মনোনিবেশ করছিলাম,’’ সাংবাদিকদের বললেন তিনি। মাইকে তো ঘোষণা হয়। সেটাও কি শুনছিলেন না? জিজ্ঞেস করায় ব্রোঞ্জজয়ীর জবাব, ‘‘না, শুনছিলাম না। আমার কানে অনেক বেশি করে বাজছিল পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের সমর্থনের আওয়াজ। ওঁরা যে ভাবে চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ওটা না থাকলে আজ কোনও কিছুই হয়তো সম্ভব হত না। আমি চেয়েছিলাম ওঁদের জন্য কিছু করে দেখাতে।’’

ধোনির উত্থান রাঁচী থেকে, যা আগে বিখ্যাত ছিল পাগলা গারদের জন্য। তেমনই স্বপ্নিলের আগমন মহারাষ্ট্রের এক গ্রাম থেকে। বাবা স্কুলের শিক্ষক, মা গ্রামের ‘সরপঞ্চ’। ধোনির সঙ্গে সব চেয়ে বড় মিল, তিনি শুটিংয়ের ‘মিস্টার কুল’। প্রবল দুর্যোগের মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রাখতে জানেন। এ দিন পিছিয়ে পড়েও তাই ঘাবড়ে যাননি। সতেরো বছর বয়স থেকে তাঁকে সন্তানতুল্য স্নেহে গড়ে তুলেছেন কোচ দীপালি দেশপাণ্ডে। ব্রোঞ্জ জয়ের পরেই যাঁকে হোয়্যাটস্‌অ্যাপ ভিডিয়ো কল করেন স্বপ্নিল। শাতোরুতে সাংবাদিকদের সামনে কোচকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘‘উনি আমার দ্বিতীয় মা।’’ দীপালি দেবী প্যারিসে আসেননি। ভারত থেকে মোবাইলে বললেন, ‘‘ওর সব চেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, শৃঙ্খলা আর বরফশীতল মস্তিষ্ক। কোনও কিছুতেই মনঃসংযোগ নড়ে যায় না।’’ কিন্তু একেবারেই কি কখনও বুক কাঁপে না তাঁর? কখনও বিশ্বাসে চিড় ধরে না? কখনও ধন্দ তৈরি হয় না মনের মধ্যে যে, আমি পারব তো? শুটার গুলি ছোড়ার আগের মুহূর্তে তেমন কিছু হওয়া মানেই তো সব শেষ। মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। তখন কী করেন তিনি? দীপালি দেবী বললেন, ‘‘হর হর মহাদেব। আউড়াতে থাকে ও।’’

জানা গেল, ভীষণই ঈশ্বর-বিশ্বাসী তিনি। পুজো-আর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। গণপতির মন্দিরে ছোটেন প্রায়ই। শিবেরও ভক্ত। শিবের ট্যাটুও আছে পিঠে। ডান হাতে আছে অর্জুনের ট্যাটু, তার পাশে লেখা ‘প্রমিস’। কেন এই শব্দটাই লেখা? কোচ ফাঁস করলেন, ‘‘নিজে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, বড় কিছু করতেই হবে। তাই হাতে লিখে রেখেছে। আজ নিজের কাছে করা সেই প্রতিজ্ঞা পালন করে দেখাল।’’ অর্জুনের মতোই লক্ষ্যভেদী হতে চান বলে ট্যাটু করিয়েছিলেন। আজ সেই লক্ষ্যপূরণেরও দিন। আনন্দবাজারের সঙ্গে ফোনে বলতে বলতে কোচেরও গলা রুদ্ধ। তাঁকে ‘দ্বিতীয় মা’ বলেছেন ছাত্র শুনে আবেগাপ্লুত ভাবে বলে উঠলেন, ‘‘আসলে বাড়ি থেকে দূরে থেকে শুটিংয়ের ট্রেনিং করতে হয় তো ওদের। তাই শুধু কোচ নই, মা হয়ে গিয়েছি হয়তো।’’

অলিম্পিক্সে এখনও পর্যন্ত ভারতের তিনটি পদকের তিনটিই শুটিংয়ে। আর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মনে হচ্ছে, মনু ভাকের, সরবজ্যোৎ সিংহ বা স্বপ্নিলদের পাশাপাশি জিতছে তাঁদের কোচেদের পরিশ্রম, দায়বদ্ধতাও। পোডিয়ামে ওঠা ছাত্রদের গলায় পদক সকলে দেখতে পায়। কিন্তু সেই সাফল্যের নেপথ্যে দ্রোণাচার্যদের কত রক্ত জল করা পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে, তা কোনও লাইভ টিভি সম্প্রচারে ধরা পড়ে না। ছাত্রের সঙ্গে কথা হল? কোচ বললেন, ‘‘অল্পক্ষণেরজন্য হয়েছে। পদকটা দেখাল। তার পরে ওকে ছুটতে হয়েছে প্রেস কনফারেন্স করতে। প্রধানমন্ত্রীও ফোন করেছিলেন। আমি তাই বলেছি, পরে ভাল করে, সময় নিয়ে কথা বলব।’’

এর আগে একাধিক ইভেন্টে চতুর্থ হিসেবে শেষ করেছেন। কী ভাবে চারের কাঁটা উপড়ে ফেললেন? স্বপ্নিলের জবাব, ‘‘নিজের উপর বিশ্বাস রেখে এগিয়েছি। অতীতে কী হয়েছে, মাথায় রাখিনি।’’ পদক জয়ের দিনেও কোনও তারকাসুলভ হাবভাব নেই। ‘‘অতীতে পারিনি কারণ আমার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু খামতি ছিল। হয়তো সেরাটা দিতে পারিনি।’’ দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার মতো কথা। প্রশ্ন করা হল, সকালে উঠে কী মনে হচ্ছিল? কী খেয়েছিলেন? স্বপ্নিলের উত্তর, ‘‘হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছিল। সেটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছিলাম। বিশেষ কিছু চিন্তা ঢুকতে দিইনি মাথায়। সকালে উঠে শুধু এক কাপ চা পান করেছি। ব্ল্যাক টি।’’

ছাত্র কি সত্যিই শান্ত ছিল? নাকি এত বড় ফাইনালের আগে অস্থির হয়ে উঠেছিল মন? কোচের জবাব, ‘‘না, না ওর মন শান্তই থাকে। এই গুণটা অদ্ভুত ভাবে ও দারুণ রপ্ত করেছে।’’ আবার সেই ধোনি-তুলনা মনে পড়বে। শেষ ওভারে ২০ দরকার হলেও ফিনিশার যেমন স্থিতধী থেকে শেষ করেন। স্বপ্নিলও প্রথম দু’টি অবস্থানে পিছিয়ে পড়ার পরেও শেষে গিয়ে জয়ের শট মারলেন।

ধোনির ক্ষেত্রে অসংখ্যবার বলা হয়েছে! আজ স্বপ্নিলকে নিয়ে লেখার দিন। বলে না, ওস্তাদের মারশেষ রাতে!

অন্য বিষয়গুলি:

Paris Olympics 2024 Swapnil Kusale
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy