সিফান হাসান। ছবি: এক্স (টুইটার)।
প্যারিস অলিম্পিক্সের শেষ দিন নেদারল্যান্ডসের পতাকা গায়ে জড়িয়ে হাসি মুখে ঘুরছিলেন সিফান হাসান। সদ্য সোনার পদক জয়ের হাসি। শুধুই সোনা জয়ের নয়। জীবন যুদ্ধে জয়ের তৃপ্তিও লেগেছিল সেই হাসির সঙ্গে।
সেই হাসির সঙ্গে মিশে ছিল আশঙ্কাও। সোনার পদক হারানোর আশঙ্কা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল ইথিয়োপিয়ার তিগস্ট আসেফাকে শেষ মুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে সোনা জিতেছেন তিনি। ইথিয়োপিয়া তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কাছে। সিফানের সোনা কেড়ে নেওয়ার দাবি করেছিল তারা।
অ্যাথলেটিক্সে নেদারল্যান্ডসের প্রতিনিধিত্ব করলেও সিফান আসলে ইথিয়োপিয়ার মানুষ। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা সব কিছুই আফ্রিকার দেশটিতে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ১৫ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসে। আশ্রয় দেওয়া দেশের হয়ে ৩১ বছর বয়সে প্রথম বার অলিম্পিক্স ম্যারাথনে অংশগ্রহণ। প্রথম বারেই সোনা। সেই সোনাতেই থাবা বসানোর চেষ্টা জন্মভূমির!
ইথিয়োপিয়ার কর্তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। অভিযোগ খতিয়ে দেখার পর সিফানের বিরুদ্ধে তেমন কিছু পাননি অলিম্পিক্সের কর্তারা। আসেফার ৩ সেকেন্ড আগে ম্যারাথন দৌড় শেষ করার পুরস্কার পেয়েছেন। ম্যারাথনের ৪২.১৯৫ কিলোমিটারের আগে নেদারল্যান্ডসের হয়ে পাঁচ এবং ১০ হাজার মিটার দৌড়েও নেমেছিলেন সিফান। দু’টি ইভেন্টেই জেতেন ব্রোঞ্জ। ১০ দিনের মধ্যে পাঁচ হাজার মিটারের হিট, ফাইনাল মিলিয়ে ৬২ কিলোমিটারের বেশি দৌড়তে হয়েছে তাঁকে। সব শেষে ছিল ম্যারাথন। সেই ইভেন্টে জন্মভূমির নিশ্চিত সোনা ছিনিয়ে নিয়েছেন।
ইথিয়োপিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিনিয়ে নিয়েছিল তাঁর কৈশোর, যৌবন। সিফান কি প্রতিশোধ নিলেন অলিম্পিক্সের মঞ্চে? গোটা বিশ্বকে সাক্ষী রেখে? না। তিনি শুধু নিজের দক্ষতাকে তুলে ধরেছেন। ঠিক কী কারণে জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছিল, তা কখনও বলেননি সিফানে। ইথিয়োপিয়ার বিরুদ্ধে কখনও মুখ খোলেননি তিনি। উদ্বাস্তু হিসাবে নেদারল্যান্ডসে পৌঁছানোর পর কয়েক সপ্তাহ ছিল অস্বিত্ব রক্ষার লড়াই। অচেনা দেশ, অচেনা পরিবেশ, অচেনা আবহাওয়া, অচেনা মানুষ— এক রকম অথৈ জলে পড়েছিলেন প্যারিসে তিনটি পদকজয়ী। নতুন দেশে কিছুটা থিতু হওয়ার পর জীবিকার লক্ষ্যে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে তাঁরই মতো ইথিয়োপিয়ার কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। তেমনই এক জনের সঙ্গে গিয়েছিলেন আইন্ডওভেন অ্যাথলেটিক ক্লাবে। সেই শুরু দৌড়। দৌড়তে দৌড়তেই পেয়েছেন একের পর এক সাফল্য।
বয়স কিছুটা বেশি হয়ে যাওয়ায় ক্লাবের মহিলা কোচ সিফানেকে বেছে নিয়েছিলেন ‘মিডল ডিসট্যান্স’ ইভেন্টের জন্য। কারণ ১০০, ২০০ বা ৪০০ মিটারের জন্য সিফানকে তৈরি করা তখন কঠিন ছিল।
১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সে পাঁচ হাজার, ১০ হাজার এবং ম্যারাথন — এই তিন ইভেন্টে পদক পেয়েছিলেন এমিল জ়াটোপেক। তাঁকে তখন ডাকা হত ‘হিউম্যান লোকোমেটিভ’ বলে। ৭২ বছর পর তাঁর কৃতিত্বে ভাগ বসালেন সিফান। তাঁকেও এখন ‘হিউম্যান লোকোমেটিভ’ নামে ডাকলে অতিরঞ্জিত হবে না। প্যারিস প্রথম অলিম্পিক্স নয়। ২০১৬ সালে রিয়ো অলিম্পিক্সে ৮০০ মিটার হার্ডলসে পেয়েছিলেন ২১তম স্থান। ১৫০০ মিটারে হয়েছিলেন পঞ্চম। ব্যর্থতায় হতাশ হননি। বরং পরিশ্রম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফল পেয়েছেন গত টোকিয়ো অলিম্পিক্সে। ১৫০০ মিটারে ব্রোঞ্জ পান। পাঁচ এবং ১০ হাজারে জেতেন সোনা।
পর পর দু’টি অলিম্পিক্সে তিনটি করে পদক। ১৫০০ মিটার থেকে ম্যারাথন। দৌড়ের দূরত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে উদ্বাস্তু জীবন থেকে। তাই কি? শিকড় ভোলেননি সিফান। ইথিয়োপিয়ার স্মৃতি টাটকা তাঁর। অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পথ এক দৌড়ে অতিক্রম করেননি। ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে ম্যারাথন শেষ করে অলিম্পিক্সে নতুন রেকর্ড গড়েছেন। অথচ ২৮ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করার সময় তিনি ছিলেন প্রতিযোগীদের দ্বিতীয় সারিতে। প্রথমে থাকা প্রতিযোগীর সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ছিল ৫০ মিটারেরও বেশি। পিছিয়ে থাকলেও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দৌড়েছেন। বাঁচিয়ে রেখেছেন শক্তি। পথের শেষ মোড় ঘোরার একটু আগে থেকে গতি বৃদ্ধি করেন। ম্যারাথনের শেষ পর্বে এমন গতি সাধারণত দেখা যায় না। যে গতিতে পাঁচ হাজার মিটার দৌড় শেষ করেছিলেন, প্রায় সেই গতিতেই ম্যারাথন শেষ করেছেন। বিশেষ করে শেষ ৩০০ মিটারে সিফানের গতি অবাক করেছে বিশেষজ্ঞদের।
ইথিয়োপিয়ার আসেফাকে সবার আগে দেখেই কি জেদ চেপে গিয়েছিল তাঁর? এমন কিছু বলেননি সিফান। সোনা জয়ের পর বলেছেন, ‘‘প্যারিসে আসার আগে ম্যারাথন নিয়ে একটু ভয় ভয়েই ছিলাম। দৌড়ের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। পাঁচ এবং ১০ হাজার মিটার দৌড়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। বলতে পারেন নিজেকে একটা পরীক্ষার মুখে ফেলেছিলাম। প্রথম ২০ কিলোমিটার কোনও সমস্যা হয়নি। শেষ পর্বটা তুলনায় কঠিন মনে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সোনা জেতার চেষ্টা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। জানতাম শেষ দিকে সকলে মরিয়া চেষ্টা করবে। তাই ১০০ মিটারের মতো স্প্রিন্ট টানার চেষ্টা করেছি শেষের দিকে।’’
সিফান গতির ঝড় তুলে অলিম্পিক্সে নিজের তৃতীয় সোনা জিতেছেন। চার বছর পর লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্সে থাকবেন কিনা নিশ্চিত নন। তাই এ বার নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সফল। আটকাতে পারেনি ইথিয়োপিয়া। সিফানের ভিত তো সে দেশেই। শিকড় উপরে ফেলা কি এতই সহজ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy