গত বার শেষ ম্যাচে হয়েছিল ফয়সালা। এ বার দু’ম্যাচ বাকি থাকতেই ভারতসেরা মোহনবাগান। পর পর দু’বার আইএসএলের লিগ-শিল্ড জিতল তারা। ঘরের মাঠে ওড়িশা এফসিকে হারিয়ে এই রেকর্ড গড়ল মোহনবাগান। তারাই একমাত্র ক্লাব যারা পর পর দু’বার লিগ-শিল্ড জিতেছে।
মোহনবাগানের এই সাফল্যের নেপথ্যে ১০ কারণ কী কী। খুঁজে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।
১) কোচ মোলিনার পরিকল্পনা— মোহনবাগানের কোচ হওয়ার আগে স্পেনের ফুটবল সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। আগেও ভারতে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। আইএসএল শুরুর পর তৃতীয় মরসুমে আতলেতিকো দি কলকাতাকে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন মোলিনা। দ্বিতীয় বার ভারতে এসেও সফল হলেন তিনি। বাগানের গত বারের আইএসএল লিগ-শিল্ডজয়ী কোচ আন্তোনিয়ো লোপেজ় হাবাসের অভিব্যক্তি অনেক বেশি ছিল। তুলনায় মোলিনা অনেক শান্ত। গোল করলেও বেশি উচ্ছ্বাস করেন না। গোল খেলেও হতাশ হন না। ফুটবলারদের ভরসা জুগিয়েছেন। নিজের পরিকল্পনার উপর আস্থা রেখেছেন। এই রকম কোচকে পেয়ে অনেক ফুরফুরে মেজাজে খেলেছেন ফুটবলারেরা। দলের অন্দরের পরিবেশ ভাল রাখতে সফল হয়েছেন মোলিনা। তাঁর পরিকল্পনা বাগানের সাফল্যের বড় কারণ।
২) মূল দল ধরে রাখা— গত মরসুমের দলের বেশির ভাগ ফুটবলারকে ধরে রেখেছে মোহনবাগান। শুধু যে যে জায়গায় প্রয়োজন, সেখানেই নতুন ফুটবলার নেওয়া হয়েছে। জেসন কামিংস, দিমিত্রি পেত্রাতোস, মনবীর সিংহ, লিস্টন কোলাসো, আশিস রাই, সাহাল আব্দুল সামাদ, আশিক কুরুনিয়ান, শুভাশিস বসুরা আগের মরসুম থেকে একসঙ্গে খেলছেন। ফলে তাঁদের বোঝাপড়া ভাল। সেই বোঝাপড়ার ফসল তুলেছে বাগান। বাকিদের যেখানে দল গোছাতে সময় লেগেছে, সেখানে বাগান কয়েক পা এগিয়ে শুরু করেছে।
৩) ম্যাকলারেন, স্টুয়ার্টের অন্তর্ভুক্তি— এ বারের মরসুমের আগে জেমি ম্যাকলারেন ও গ্রেগ স্টুয়ার্টকে নিয়েছে বাগান। ম্যাকলারেন অস্ট্রেলিয়ার এ লিগের সর্বোচ্চ গোলের মালিক। আগে থেকেই সেখানে জেসন কামিংসের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। পাশাপাশি স্টুয়ার্ট ভারতীয় ফুটবলে পরিচিত মুখ। স্কটল্যান্ডের এই ফুটবলার ভারতে আসার আগে সেখানকার লিগ জিতেছেন। ভারতে মুম্বইয়ের হয়ে আইএসএল লিগ-শিল্ড, আইএসএল কাপ জেতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। এই দুই ফুটবলার বাগানের জয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছেন। ম্যাকলারেন সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন। স্টুয়ার্ট যে কয়েকটি ম্যাচ খেলেছেন, গোল করিয়েছেন।
৪) আনোয়ারের অভাব বুঝতে দেননি শুভাশিসেরা— গত বার মোহনবাগানের রক্ষণের প্রধান স্তম্ভ ছিলেন আনোয়ার আলি। এ বারের মরসুমের আগে তাঁকে নিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। তা নিয়ে দুই প্রধানের লড়াই অনেক দূর গড়িয়েছিল। আনোয়ার চলে গেলেও তাঁর অভাব বুঝতে দেননি শুভাশিস বসু, আশিস রাইরা। পাশাপাশি টম অলড্রেড ও আলবার্তো রদ্রিগেসের জুটি বাগানের রক্ষণকে স্থিরতা দিয়েছে। এই রক্ষণকে ভেঙে গোল করতে সমস্যায় পড়েছে সব দল। লিগে সবচেয়ে কম গোল খেয়েছে মোহনবাগান। ভাল রক্ষণ ট্রফি জেতাতে কত বড় ভূমিকা নিতে পারে তা দেখিয়েছে বাগান।
৫) ভারতীয় দলের ১১ ফুটবলার— ভারতীয় দলে খেলা ১১ জন ফুটবলার রয়েছেন মোহনবাগানে। প্রথম দলে খেলতে পারেন সাত জন ভারতীয়। অর্থাৎ, প্রথম একাদশে ঢোকার জন্য লড়াই হয় ভারতীয় ফুটবলারদের। তাঁদের অনেককেই বেঞ্চে বসতে হচ্ছে। এত ভারতীয় ফুটবলার থাকায় কোচ মোলিনার হাতে বিকল্প অনেক বেশি। কোনও ফুটবলার চোট পেলেও সমস্যা হয় না। প্রতিটি জায়গায় খেলার জন্য একাধিক ফুটবলার রয়েছে বাগানে। ফলে কোনও ম্যাচে বিদেশিরা ভাল খেলতে না পারলেও জিততে সমস্যা হয়নি দলের।
আরও পড়ুন:
৬) বিশাল কাইথের হাত— নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে ভারতের সেরা গোলরক্ষক বিশাল। গত বারের মতো এ বারও দলের জয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। বিশাল জানেন, কোন সময়ে কোথায় থাকতে হয়। অনেক অবধারিত গোল বাঁচিয়েছেন। আবার আক্রমণেও সাহায্য করেছেন। বাগানের অনেক গোলের আক্রমণ শুরু হয়েছে বিশালের পা থেকে। মরসুমে ২১টি ম্যাচের মধ্যে ১৩টি ম্যাচে ক্লিনশিট রেখেছেন তিনি। এতেই বোঝা যাচ্ছে, কেন এতটা দাপট দেখাতে পেরেছে মোহনবাগান।
৭) ফুটবলারদের শৃঙ্খলা— মোহনবাগানের ফুটবলারেরা যে শৃঙ্খলা দেখিয়েছেন, তা দলকে জেতাতে সাহায্য করেছে। প্রতিযোগিতায় বাগানই একমাত্র দল যার কোনও ফুটবলার লাল কার্ড দেখেননি। বাকি প্রতিটি দলের ফুটবলারেরা লাল কার্ড দেখেছেন। মরসুমের শুরুর দিকে বাগান ফুটবলারেরা বেশি হলুদ কার্ড দেখছিলেন। পরে সেই সংখ্যাও কমেছে। কার্ড সমস্যায় বাকি সব দলের তুলনায় কম ফুটবলারকে বাইরে বসতে হয়েছে। ফলে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলাতে সমস্যা হয়নি মোলিনার।
৮) গোল করার লোক বেশি— এই মরসুমে মোহনবাগানের ১০ জন ফুটবলার গোল করেছেন। এই পরিসংখ্যান অন্য কোনও দলের নেই। দলের তিন স্ট্রাইকার ম্যাকলারেন, কামিংস ও পেত্রাতোস গোল করেছেন। তিন মিডফিল্ডার স্টুয়ার্ট, মনবীর সিংহ ও লিস্টন কোলাসো গোল করেছেন। তবে চমক দিয়েছেন বাগানের চার ডিফেন্ডার। এ বার বাগানের বিরুদ্ধে ১৪টি গোল হয়েছে। বাগানের চার ডিফেন্ডার আলবের্তো রদ্রিগেস, টম অলড্রেড, শুভাশিস বসু ও দীপেন্দু বিশ্বাস মিলে ১৪টি গোল করেছেন। যে দলের ডিফেন্ডারেরা এত গোল করেন সেই দল যে লিগ-শিল্ড জিতবে সেটাই স্বাভাবিক।
৯) সেট-পিসে বেশি গোল— ফুটবলে এখন ওপেন প্লে থেকে বেশি গোল হয়। সেট-পিসের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু সেট-পিস কাজে লাগাতে পারলে কতটা সুবিধা হয় তা দেখিয়েছে বাগান। এ বারের মরসুমে সেট-পিস থেকে ২০টি গোল করেছেন বাগান। খেয়েছে মাত্র পাঁচটি। সেট-পিসের দক্ষতা মোহনবাগানকে বাকিদের থেকে অনেক এগিয়ে রেখেছে।
১০) ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগানো— ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগিয়েছে মোহনবাগান। এ বার যুবভারতীতে ১০টি ম্যাচ খেলেছে তারা। একমাত্র মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচটি ড্র হয়েছে। বাকি ন’টি হোম ম্যাচ জিতেছে বাগান। বড় লিগে ঘরের মাঠকে যে দল দুর্গ বানাতে পারবে সেই দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। সেটাই দেখিয়েছে বাগান। সেই কারণেই দু’ম্যাচ বাকি থাকতে লিগ-শিল্ড জিতেছে মোহনবাগান।