ত্রয়ী: স্ত্রী সোনম এবং পুত্র ধ্রুবকে নিয়ে সুনীল ছেত্রী। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
ভাবতেই পারছি না আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই ভারতীয় দলে অতীত হয়ে যাবে সুনীল (ছেত্রী)। ৬ জুন যুবভারতীতে কুয়েত ম্যাচ খেলেই জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন ও জানিয়েছিল, মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম। ওকে বলেছিলাম, কুয়েতকে হারিয়ে ভারত যদি বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের তৃতীয় পর্যায়ে ওঠে তোমাকে তো দরকার হবে। কারণ, লড়াই অনেক কঠিন হবে। তুমি কি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
সুনীলের স্ত্রী নয়, ওর এক জন ভক্ত এবং ফুটবলপ্রেমী হিসেবে চেয়েছিলাম জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যাক। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় সুনীল পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ভারতীয় দল এখন তৈরি। ওকে ছাড়াই ভাল খেলবে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, কোনও অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না সুনীল। ভুবনেশ্বরে জাতীয় দলের শিবির চলাকালীন প্রত্যেক দিন ফোন করে বলত, আর বাকি রয়েছে ১০ দিন... নয় দিন...অবশেষে সেই দিনটাও চলে এল। অনেকেই জানতে চাইছে, সুনীলের অবসরের দিন আমাদের বিশেষ কোনও পরিকল্পনা রয়েছে কি না। বিশ্বাস করুন, আমরা এই দিনটার জন্য মানসিক ভাবে একেবারেই তৈরি নই।
ফুটবল পরিবারে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও অবসরের সময় কী অনুভূতি হয়, জানতাম না। বাবা সুব্রত ভট্টাচার্য যে দিন ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন, দাদা ও আমি খুব ছোট ছিলাম। আমাদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাই সে ভাবে অনুভব করতে পারিনি এই দিনটা কতটা যন্ত্রণার হতে পারে। এখন উপলব্ধি করছি। হয়তো জুন মাস বলেই কষ্ট বেশি হচ্ছে। কেন এত তাড়াতাড়ি এই দিনটা চলে এল?
সুনীলের সঙ্গে প্রথম আলাপ ১১ জুন। এলগিন রোডের একটি শপিং মলে দেখা করতে এসেছিল। আমি অবশ্য ওকে তখনও জানাইনি যে, সুব্রত ভট্টাচার্য আমার বাবা। তা হলে হয়তো দেখাই করত না। কারণ, মোহনবাগানে আমার বাবাই ছিলেন তখন কোচ। সত্যিটা অবশ্য কিছু দিনের মধ্যে প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। বাবার মোবাইল ফোন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সারিয়ে আনার দায়িত্ব সুনীলকেই দিয়েছিল। বাবার মোবাইলে আমার নম্বর সেভ করা ছিল মেম (আমার ডাকনাম) নামে। কিন্তু নম্বর দেখে সুনীলের সন্দেহ হয়। আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম তো সোনম? এই নম্বরে ফোন করেই তোমার সঙ্গে রোজ কথা বলি। তা হলে মেম কে? ওকে সত্যিটা বলতেই তিন মাস আমার সঙ্গে দেখা করেনি ভয়ে। বলত, ‘‘আমার ফুটবলজীবন শেষ হয়ে যাবে। আমি আর তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারব না।’’ ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলায়। তখন হোয়াট্সঅ্যাপ ছিল না। জেসিটি-তে চলে যাওয়ার পরে এসটিডি কলে কথা হত। আমাদের সম্পর্ক শুরুর এক বছরের মধ্যেই ভারতীয় দলে ডাক পায় সুনীল। পাকিস্তানে প্রথম সফরে যাওয়ার আগের দিন ফোন করে বলল, আগামী কয়েক দিন কথা বলতে পারবে না। খুব মনখারাপ হয়েছিল। পাশাপাশি আনন্দও হচ্ছিল জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায়। এর পরে বিয়ে হল, ধ্রুব এল আমাদের জীবনে। সেই জুন মাসকেই সুনীল বেছে নিল জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার জন্য।
সুনীলের জীবন জুড়ে শুধুই ফুটবল। ১৯ বছর ধরে ওকে বেশি খুশি হতে দেখেছি জাতীয় দলের হয়ে কোনও ট্রফি জিতলে এবং পরবর্তী কালে ধ্রুবের জন্মের সময়। এই কারণেই বৃহস্পতিবার যুবভারতীতে ছেলেকে নিয়ে যেতে চাই। বাবার অবসর নেওয়ার দিনে মাঠে থাকতে না পারার দুঃখ এখনও আমি ও দাদা ভুলতে পারিনি। আমি চাই না, ধ্রুবেরও একই অভিজ্ঞতা হোক। বড় হয়ে ও যখন শুনবে জাতীয় দলের জার্সিতে বাবার শেষ ম্যাচের দিন কলকাতায় থাকা সত্ত্বেও মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়নি, আমাদের উপরে প্রচণ্ড রেগে যাবে। আমি চাই ধ্রুবকে কোলে নিয়েই সুনীল বৃহস্পতিবার কুয়েত ম্যাচের আগে মাঠে নামুক।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন: শুভজিৎ মজুমদার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy