দুরন্ত: অপ্রতিরোধ্য বুলডোজ়ার। ‘সুভাষিত’ ময়দান। ফাইল চিত্র
বাংলা কেন, ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসেই হাতে গোনা এমন কিছু চরিত্র পাওয়া যাবে, যাঁদের শোকগাথা লিখতে বসে দ্বিধায় পড়তে হয়েছে, কাকে এগিয়ে রাখব? ফুটবলার তিনি? না কোচ তিনি?
সুভাষ ‘ভোম্বলদা’ ভৌমিক সে রকমই এক নাম। ফুটবলার হিসেবে যাঁর আত্মপ্রকাশ কিংবদন্তি ইন্দর সিংহের লিডার্স ক্লাবকে উড়িয়ে দিয়ে। জালন্ধরের লিডার্স ক্লাব তখন দেশের অন্যতম সেরা। ডিসিএম, রোভার্সে দুর্ধর্ষ খেলছে। পটনায় শ্রীকৃষ্ণ গোল্ড কাপে তারাই আটকে গেল কলকাতার রাজস্থান ক্লাবের এক উনিশ বছরের যুবকের আগ্রাসনের সামনে। ইন্দরের লিডার্সকে ৪-২ হারিয়ে দিল রাজস্থান। আর সকলকে চমকে দিল ওই শক্তিশালী শরীর, দুরন্ত গতি, নদীর পার্বত্য রূপের মতো সব কিছু ভেঙেচুরে নিয়ে যাওয়ার তোড়।
ছেলেটা কে? জানা গেল, নাম তাঁর সুভাষ। দেরি না করে পরের বছরেই ইস্টবেঙ্গল তাঁকে তুলে নিল। ময়দানি ফুটবলের সেই ‘সুভাষিত’ হওয়া শুরু। নামকরণই হয়ে যাবে ‘বুলডোজ়ার’। ১৯৭০ থেকেই নিয়মিত ভাবে ভারতীয় দলের সদস্য। সে বছরেই ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জজয়ী দলের সেরা তারকাদের এক জন।
ফুটবলার হিসেবে সুভাষ ভৌমিক কেন সেরাদের মধ্যে থাকবেন? একটাই উত্তর। বড় ম্যাচে দুর্ধর্ষ সব পারফরম্যান্সের জন্য। ১৯৭০-এ জাকার্তায় মারডেকা ফুটবলে ভারত তৃতীয়। নায়ক? সুভাষ ভৌমিক। পরের বছর ফিলিপিন্সকে ৫-১ উড়িয়ে দেওয়া। নায়ক? হ্যাটট্রিক করা সুভাষ ভৌমিক। রাইট উইঙ্গার হিসেবে কাট করে ভিতরে ঢুকে এসে গোলার মতো শট নিতে পারা ছিল তাঁর বিশেষত্ব। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নেদারল্যান্ডসের আরয়েন রবেন যে ভঙ্গির জন্য খুব বিখ্যাত ছিলেন। দুরন্ত গতি, শক্তিশালী শরীর, সব কিছু ভেঙেচুরে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা (যে কারণে বুলডোজ়ার নামকরণ) আর বুলেটের মতো শট তাঁকে বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারে পরিণত করেছিল। তবু এ সব নয়। তিনি ছিলেন বড় ম্যাচের ওস্তাদ। অন্যদের যখন গলা শুকিয়ে আসছে, মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামছে, সেই সব স্নায়ুযুদ্ধে জেতানো ভয়ডরহীন নানা পারফরম্যান্সই তাঁর আসল ইউএসপি।
যার মধ্যে সর্বসেরা ১৯৭৩-এর আইএফএ শিল্ড ফাইনাল। উল্টো দিকে সে দিন উত্তর কোরিয়ার পিয়ং ইয়ং ক্লাব। তাদের দলে পাঁচ জন বিশ্বকাপার ছিল। শুধু ফুটবল কেন, ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসেই অন্যতম সেরা অঘটন ঘটিয়ে পিকের লাল-হলুদ জেতে ৩-১। নায়ক? সেই সুভাষ ভৌমিক। একক দক্ষতায় করা তাঁর একটি বিস্ময় গোল আজও বাংলার প্রবীণ ফুটবলভক্তদের মনে গেঁথে রয়েছে। আকবরের করা বাকি দু’টি গোলেও মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর।
সে বছরেই ডিসিএম ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের প্রতিপক্ষ উত্তর কোরিয়ারই ডোক রো গ্যাং। দলে ছ’সাত জন বিশ্বকাপার। পিয়ং ইয়ংয়ের চেয়েও শক্তিশালী, আগ্রাসী দল ছিল তারা। ডিসিএম কোয়ার্টার ফাইনাল লিগে ইন্দর সিংহের লিডার্সকে ৭-০ উড়িয়ে দিয়েছিল তারা। শোনা যায়, এই ফাইনালের আগেই সেই বিখ্যাত ঘটনাটি ঘটান পিকে। দরিয়াগঞ্জের হোটেলের ছাদে চলত তাঁর ভোকাল টনিকের ক্লাস। কাচের চুড়ি কিনে এনে আতঙ্কিত হয়ে থাকা হাবিব-আকবরদের হাতে তুলে দিয়ে পিকে বলেন, ‘‘লড়াই করার তো দরকার নেই। মাঠেও নামতে হবে না। এগুলো পরে ঘরের মধ্যে বসে থাকো।’’
স্রোতাদের দলে ছিলেন সুভাষও। তাঁর দম্ভে সবচেয়ে আঘাত লেগেছিল। ওদিকে পিকে জালন্ধরের লিডার্স দলের সমর্থকদের কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘তোমরা ওদের কাছে হেরে গিয়েছ। আমরা শোধ তুলব। মাঠে এসে শুধু আমাদের জন্য গলা ফাটাও।’’ লিডার্স সমর্থকেরা নিরাশ করেনি পিকে-কে। তাদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে অভাবনীয় অঘটন ঘটিয়ে দেয় ইস্টবেঙ্গল। পর-পর দু’দিন ম্যাচ ড্র হওয়ার পরে ডোক রো গ্যাং আর খেলতে চায়নি। ইস্টবেঙ্গলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ভাগ্য সহায় থাকলে সে দিন জিতেও যেতে পারত ইস্টবেঙ্গল। সুভাষ গোলের দরজা খুলে দিয়েছিলেন আকবরের জন্য। তাঁর ফাইনাল পাস দাঁড় করিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ রক্ষণকে। উত্তর কোরিয়ার গোলরক্ষক এগিয়ে আসেন মরিয়া হয়ে। আকবর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি, শট বাইরে মারেন। ইস্টবেঙ্গলের খেলায় মুগ্ধ ডোক রো গ্যাং টিম ম্যানেজমেন্ট তাদের জাতীয় দলকে সাবধান করে দেয়। এর পরেই ’৭৪ এশিয়ান গেমস ছিল। ডোক রো গ্যাং কর্তারা তাঁদের জাতীয় দলের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ছ’সাত জন ফুটবলারকে নিয়ে তৈরি ভারতীয় দল খুব বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে গেমসে। সেই সময়ে একাধিক বিশ্বকাপার নিয়ে ভারতে খেলতে আসা উত্তর কোরিয়ার দুই দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের অবিশ্বাস্য সাফল্য ভারতীয় ফুটবলের রূপকথায় স্থান করে নিয়েছে।
১৯৭৫-এর আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের সেই ঐতিহাসিক ৫-০ জয়ের আসল ইঞ্জিন ছিলেন তিনি, সে দিনের প্রতিপক্ষরা এখনও স্বীকার করেন। শুধু লাল-হলুদ নয়, সবুজ-মেরুন জার্সিতেও দারুণ ঝলমলে সব মুহূর্ত উপহার দিয়ে গিয়েছেন তিনি। দু’টো ম্যাচ মোহনবাগানের চিরকালীন সংগ্রহশালায় ঢুকে রয়েছে। ১৯৭১-এ ভাস্কোর বিরুদ্ধে রোভার্স কাপ ফাইনাল আর ১৯৭৭-এ জেসিটির বিরুদ্ধে ডুরান্ড ফাইনাল। সুভাষ ভৌমিককে ছাড়া এই দু’টি ট্রফি মোহনবাগানের ঘরে ঢুকত কি না, সন্দেহ। বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি দিয়েছেন একাধিক বার। মাঠের বাইরেও বাকিদের চেয়ে আলাদা। সেই সময়ে যখন পাবলিক বাস ধরে প্র্যাক্টিসে আসতেন বেশির ভাগ ফুটবলার, তিনি আসতেন বিলাসবহুল গাড়ি চালিয়ে। ব্র্যান্ডেড ড্রেস পরতেন, হাতে ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট। সেই কোন সত্তরের দশকের ময়দানেই তাঁর সব সময়ের সঙ্গী দামি সব বিদেশি পারফিউম!
তেমনই বিতর্কে জড়িয়েছেন বার বার। ২০০৫-এ ঘুষ কেলেঙ্কারির দায়ে গ্রেফতার হন। সন্তোষ ট্রফিতে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েও জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ায় পুরস্কার অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করেন ফেডারেশন কর্তাদের। সেই যে ‘ব্যাড বুক’-এ নাম ওঠালেন, আর বেরোতে পারেননি। দ্বিতীয় ইনিংসে কোচ হিসেবেও দারুণ সফল। ২০০৩-এ তাঁর কোচিংয়ে জাকার্তায় ইস্টবেঙ্গলের আসিয়ান কাপ জয় কলকাতায় এমন আবেগের বিস্ফোরণ ঘটায় যে, জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা পর্যন্ত সামিল হয়ে পড়েন। একমাত্র কোচ যিনি দু’টি দলের হয়ে জাতীয় লিগ জিতেছেন। ইস্টবেঙ্গল ও চার্চিল ব্রাদার্সের হয়ে। তবু লাইসেন্স না থাকার জন্য কোচিং থেকে সরে যেতে হয়েছে। বিয়র্ন বর্গ যেমন মাত্র ২৬ বছর বয়সেই সকলকে বিস্মিত করে টেনিস থেকে সন্ন্যাস নিয়ে ফেলেছিলেন, সুভাষও তেমনই ৩০ হওয়ার আগেই ফুটবল থেকে বিদায় নেন।
মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭২। কে জানত, দ্রুত সব কিছু থেকে বিদায় নিতেই পছন্দ করেন
সুভাষ ‘ভোম্বলদা’ ভৌমিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy