ম্যাঞ্চেস্টারে ১৯৯৮ সালে পেলে। রয়টার্সের ফাইল চিত্র
দর্শক ভর্তি ইডেন গার্ডেন্সে পেলের নিউ ইয়র্ক কসমসের বিরুদ্ধে গোল করার পরেই মনে হয়েছিল, ফুটবলার হিসেবে জীবনের সেরা প্রাপ্তি। তখনও ভাবিনি আসল পুরস্কার পাওয়া এখনও বাকি রয়েছে।
ম্যাচের পরে গ্র্যান্ড হোটেলে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল মোহনবাগানের তরফে। আমাদের সকলেরই একমাত্র লক্ষ্য ছিল, ফুটবল সম্রাটের সঙ্গে ছবি তোলার। হোটেলে গিয়ে বুঝলাম বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে গোল করার চেয়েও কঠিন ফুটবল সম্রাটের কাছে পৌঁছনো। ক্লাব কর্তারা ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন স্তরের গণ্যমান্য অতিথিরা নিমন্ত্রিত ছিলেন নৈশভোজে। অতি কষ্টে পেলের কাছে পৌঁছে বললাম, আমি একটা গোল করেছি ম্যাচে। শুনেই ফুটবল সম্রাটের মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিল তখন। পেলে যদি বিরক্ত হয়ে চলে যান? ছবি তুলতে রাজি না হন?
ফুটবল সম্রাট গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘তুমি গোল করেছিলে আমাদের বিরুদ্ধে? তোমার সঙ্গে কথা বলব না।’’ জীবনে প্রথম বার গোল করার পরেও নিজের উপরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, গোল করলাম বলেই পেলে আমার উপরে রেগে গিয়েছেন। হঠাৎ হো হো করে হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ফুটবল সম্রাট। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘দারুণ গোল করেছ তুমি। এ ভাবেই খেলা চালিয়ে যেও। এসো, আমরা একটা ছবি তুলি।’’
পেলের প্রয়াণের খবর পাওয়ার পর থেকেই সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছি। ভাবতেও পারছি না ফুটবল সম্রাট আর নেই। জানতাম পেলে প্রচণ্ড অসুস্থ। যে কোনও দিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। তা সত্ত্বেও মানতে পারছি না ওঁর চলে যাওয়া।
সেই সময়ে টেলিভিশনে এত খেলা দেখাত না। বিভিন্ন পত্রিকায় পেলের খেলার ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। বিদেশে খেলতে গেলে ওঁর খেলার ভিডিয়ো ক্যাসেট কিনে আনতাম। পেলের মতো বাইসাইকেল কিক, সাইড ভলি করার অনুশীলন করতাম একা একা। সেই পেলের সঙ্গে খেলব জানার পর থেকেই আমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে আমি মোহনবাগানে গিয়েছিলাম তো ফুটবল সম্রাটের সঙ্গে খেলার টানেই।
ইস্টবেঙ্গলেই খেলব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। হঠাৎ এক দিন কিংবদন্তি মোহনবাগান কর্তা ধীরেন দে আমাকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘‘মোহনবাগানের সঙ্গে খেলার জন্য পেলে-সহ পুরো নিউ ইয়র্ক কসমস দল কলকাতায় আসছে। কথাবার্তা চূড়ান্ত পর্যায়ে। এখন কাউকে বোলো না। আমি চাই তুমি মোহনবাগানের হয়ে খেলো। তোমার কত টাকা চাই বিনা দ্বিধায় বলে ফেলো।’’ পেলের বিরুদ্ধে খেলব শোনার পরে আর অন্য কিছু ভাবার মতো মনের অবস্থা ছিল না। বলে দিলাম, আপনি যদি নিশ্চিত করেন পেলে আসছেন, তবেই আমি মোহনবাগানে খেলব। ধীরেনদা হেসে বলেছিলেন, ‘‘ফুটবল সম্রাট আসছেন। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।’’ পরের দিন থেকেই আমি প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম পেলের সামনে যে কোনও মূল্যে একটা গোল করতে। সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছে। এখনও কানে বাজে ফুটবল সম্রাটের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘‘দারুণ গোল করেছ...।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy