Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Qatar World Cup 2022

মরক্কোর এই চমক চালু থাকলে আমি অবাক হব না

মরক্কো ফের সকলকে চমকে দিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আর পর্তুগালকে ছিটকে দিয়ে। ওদের দলটায় বড় কোনও তারকা না থাকতে পারে।

বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়ার উল্লাস মরক্কোর ফুটবলারদের। ফাইল চিত্র

বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়ার উল্লাস মরক্কোর ফুটবলারদের। ফাইল চিত্র

জিকো
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:০৪
Share: Save:

আগেই বলেছি, অঘটন শব্দটায় আমার আপত্তি আছে। বরং বলি, এই বিশ্বকাপে একের পর এক অপ্রত্যাশিত ফল দেখতে পাচ্ছি আমরা। সম্ভবত এর কারণ হচ্ছে, সারা বছর ধরে ক্লাব ফুটবলে একসঙ্গে খেলে চলা ফুটবলারেরাই বিশ্বকাপে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলছে। সকলে সকলের শক্তি-দুর্বলতা সম্পর্কে জানে।

মরক্কো ফের সকলকে চমকে দিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আর পর্তুগালকে ছিটকে দিয়ে। ওদের দলটায় বড় কোনও তারকা না থাকতে পারে। কিন্তু দলগত ভাবে টগবগে ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে। পর্তুগালের বিরুদ্ধে শেষের দিকে আরও একটা গোল দিতে পারত ওরা। জানি, সেমিফাইনালে ওদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। কিন্তু শেষ আটের মতো শেষ চারেও মরক্কো ফের চমক দিলে অবাক হব না।

তেমনই ইংল্যান্ড-ফ্রান্স ম্যাচেও কিন্তু চমকের অভাব ছিল না। শনিবারের দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যাচের বেশিটাই ছিল ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে। হ্যারি কেনদের বেশি আগ্রাসী মনে হয়েছে। কিন্তু ফিনিশিংয়ে অসাধারণ ফ্রান্স। পরপর কয়েকটা দিন গোলকিপাররাই নায়ক হল। ফ্রান্সের হুগো লরিসও দারুণ খেলল। লরিসের রক্ষণাত্মক গুণ অসাধারণ। দারুণ কয়েকটা ‘সেভ’ করে ও ফ্রান্সকে সেমিফাইনালে তুলে দিল। সেই সঙ্গে জিহুর হেড। এমবাপে-জিহু-গ্রিজ়ম্যান অপ্রতিরোধ্য জুটি হয়ে উঠেছে এই বিশ্বকাপে। এই ত্রিফলায় অনেকেই বিদ্ধ হচ্ছে, হবেও।

ইংল্যান্ডের দুর্ভাগ্য, হ্যারি কেনের মতো খেলোয়াড় পেনাল্টি উড়িয়ে দিল পোস্টের উপর দিয়ে। বিশ্বকাপের মতো চাপের প্রতিযোগিতায় এ রকম কিন্তু হয়েই থাকে। অনেক বড় বড় তারকা

পেনাল্টি থেকে গোল করতে পারেনি। আমিও মিস করেছি। ফুটবল খেলাটাই এমন। ঠিক তার আগেই পেনাল্টি থেকে হেলায় গোল করে গিয়েছে হ্যারি। আমার মনে হয়, দ্বিতীয় পেনাল্টির ক্ষেত্রে বেশি জোরে শট নিতে গিয়েছিল ও। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ড যে রকম খেলেছে, ড্র হলে সঠিক ফল হত। আর ম্যাচ যদি অতিরিক্ত সময়ে যেত, কেউ বলতে পারে না কী হত। যা-ই হোক, ইংল্যান্ড-ফ্রান্স আমার মতে, এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত সেরা ম্যাচ।

মরক্কোর সেমিফাইনালে ওঠাকে নিশ্চয়ই সকলে সব চেয়ে অপ্রত্যাশিত ফল বলবেন। কয়েক দিন আগেই কাতারে গিয়েছিলাম আমি। তখন একটা টেলিভিশন ইন্টারভিউয়ে বলেছিলাম, প্রাথমিক পর্বে মরক্কোর খেলা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। এই মরক্কো দলটার অনেক ফুটবলার ইউরোপের বড় বড় প্রতিযোগিতায় খেলে বলে অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায় কারও থেকে পিছিয়ে নেই। নিখুঁত রণনীতি ও পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ওরা। দেখে মনে হচ্ছে, ফুটবলারেরাও খুব বাধ্য ছাত্রের মতো আচরণ করছে। কোচ, সহকারীদের কথা শুনে খেলছে। টিমটা কাউন্টার অ্যাটাকে দুর্ধর্ষ। ওরা আরবি ভাষায় কথা বলে, তাই প্রবল স্থানীয় সমর্থনও পাচ্ছে। বিশ্বকাপে গ্যালারির এই এনার্জিটা কিন্তু একটা দলকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে।

এই বিশ্বকাপে সব চেয়ে নজর করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির উত্থান। আমি স্বপ্ন দেখি, এক দিন আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনও দল বিশ্বকাপ জিতছে। নিজে জাপানে বহু দিন কোচিং করেছি। এই বিশ্বকাপে জাপান যে রকম ফুটবল খেলেছে, তাতে গর্বে বুক ফুলে উঠেছে আমার। ওদের গ্রুপটাও ভাবুন। দু’টো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল ছিল। জার্মানি, স্পেন। আর জাপান কি না দু’টো হেভিওয়েট দলকেই হারিয়ে দিল। আমি যখন জাপানে কোচিং করাতাম, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিলাম। ইউরোপের দলগুলি খুব একটা এশিয়ার দলের সঙ্গে খেলে না। তাই গতির ঝড় তুলতে পারলেই ওরা সমস্যায় পড়ে যায়। ২০১৮ বিশ্বকাপে গতির মন্ত্রেই কোরিয়া হারিয়ে দিয়েছিল জার্মানিকে। এ বার জাপানও একই জিনিস করল।

জানি, সকলেই অপেক্ষা করছেন ব্রাজিল নিয়ে আমি কী বলি, তা জানার জন্য। আমার মনে হয় ব্রাজিল খুব কঠিন একটা ম্যাচ পেয়েছিল, খুব কঠিন প্রতিপক্ষ পেয়েছিল। আসুন, আমরা ক্রোয়েশিয়াকেও কৃতিত্ব দিই। ব্রাজিল অনেকগুলো গোলের সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছিল পোস্টের নীচে। তবু দারুণ একটা মুভ থেকে নেমার গোলটা পেয়ে যায়। তার পরেও যে গোলটা ধরে রাখতে পারল না, তার জন্য কিন্তু ব্রাজিলের ভুল রণনীতি দায়ী।

গোলটা পেয়ে গিয়েও বাড়তি ঝুঁকি নিতে যাওয়া সবচেয়ে বড় ভুল হল। যেখানে ম্যাচের শেষ দিকে ওদের উচিত ছিল ছ’সাত জন মিলে রক্ষণ সামলানো, সেখানে ওরা হুড়মুড়িয়ে আক্রমণে উঠতে থাকল। কোথায় ওদের নিজেদের ডিফেন্সে সাত জন থাকবে, তা না, অবাক হয়ে দেখলাম, সাত জন মিলে ক্রোয়েশিয়ার বক্সে ভিড় করে রয়েছে। ক্রোয়েশিয়া কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করে দিতে পারে, এটা কি জানা ছিল না? একটাই ভুল আর সেটাই ব্রাজিলের স্বপ্ন শেষ করে দিয়ে গেল।

টাইব্রেকারেও ঠিক মতো ঘুঁটি সাজাতে পারেনি ব্রাজিল। আমি সব সময়ে সেরা খেলোয়াড়দের আগে শট মারতে পাঠানোর পক্ষপাতী। রদ্রিগোকে যদি প্রথমে পাঠিয়েও থাকি, যখন দেখলাম ও গোল করতে পারল না, দ্বিতীয় শটটা মারতে কেন নেমারকে পাঠাব না? আচ্ছা, তা-ও বুঝলাম। মারকুইনহোসের জায়গায় তো অন্তত নেমারকে পাঠানো যেত। তা হলে ক্রোয়েশিয়ার উপরে কিছুটা চাপ তৈরি হত।

ব্রাজিলের নাচকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে আমি খুব একটা মাথা ঘামাতে চাইনি। প্রত্যেকটা দেশেরই নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে, ধরন থাকে। ব্রাজিলেও গোল করে উৎসব করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। নাচ করে ব্রাজিলের খেলোয়াড়েরা কাউকে অসম্মান করতে চেয়েছিল, এটা বিশ্বাস করি না। তবে বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতায় এত আশা নিয়ে এসে না পারলে কথা উঠবেই। ব্রাজিলকে নিয়েও উঠছে। তবে আমি মনে করি, তিতে খুব ভাল কোচ। দারুণ ভাবে এই দলটাকে সাজিয়েছিল। কিন্তু হেরে গেলে অনেক কিছুই অন্য রকম হয়ে যায়। তাই কেউ বলবে না, কী দারুণ ভাবে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যকে মিশিয়েছিল তিতে। ক্ষণিকের ভুলের জন্য হেরেছে ওরা। তার জন্য আর যা-ই হোক, কোচের গর্দান যেন চাওয়া না হয়। অবশ্য তিতে সেই সুযোগটাই তো দিল না। নিজেই সরে গেল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE