Advertisement
E-Paper

শিল্পের ছোঁয়ায় বশ মানছে বল, দেশও

অন্যরা যেমন বলের পিছনে ছোটেন, তিনি তা করেন না। অন্যরা যেমন পা দিয়ে নির্মম ভাবে, উগ্রতার সঙ্গে বলকে থামানোর চেষ্টা করেন, তিনি তা করেন না।

আকর্ষণ: কাতারে মেসির জাদুতে সম্মোহিত ফুটবল বিশ্ব। ফাইল চিত্র

আকর্ষণ: কাতারে মেসির জাদুতে সম্মোহিত ফুটবল বিশ্ব। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:০৭
Share
Save

ক্রিকেটের ডনের পায়ের মধ্যে দিয়ে বোল্ড করার দুঃসাহস দেখাতেন না প্রতিপক্ষ বোলারেরা। ফুটবলের ডন অস্ট্রেলীয় ডিফেন্ডারের পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁ পায়ের শটে তাদের শেষ করে দিলেন। সম্মোহিত বিশ্ব! ঘড়ির কাঁটায় মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। ফুটবল নয়, ব্যালে প্রদর্শনী ঘটে গেল।

অন্যরা যেমন বলের পিছনে ছোটেন, তিনি তা করেন না। অন্যরা যেমন পা দিয়ে নির্মম ভাবে, উগ্রতার সঙ্গে বলকে থামানোর চেষ্টা করেন, তিনি তা করেন না। উল্টে বলই যেন গড়িয়ে-গড়িয়ে আসে লিয়োনেল মেসির কাছে। ঠিক যে ভাবে পোষ্য বেড়াল এসে আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়ে প্রিয় মাস্টারের পায়ে।

চোখ বন্ধ রেখে এই বিশ্বকাপে তাঁর দু’টি গোল রিওয়াইন্ড করা যাক। ফুটবলার নয়, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ছবি ভেসে উঠবে। শিল্পী ব্যস্ত অমর সৃষ্টিতে। বাঁ পায়ের শটে তিনি যে গোল করবেন, তা নিয়ে অবাক হওয়ার কী আছে! সে তো আট-ন’বছর থেকেই করে আসছেন! যখন ছোট্ট লিয়ো চকোলেট কুকিজ় খেতে ভালবাসত আর ছোটবেলার কোচ টোপ দিতেন— গোল করলেই চকোলেট কুকিজ় পাবে। কয়েক দিনের মধ্যেই কোচকে ফতুর করে দেওয়ার জোগাড় করলেন মেসি। কিন্তু কাতারে দু’টি গোলের চেয়েও জাদুকর মেসি লুকিয়ে রয়েছেন দু’টি গোলের মঞ্চ সাজানোর মায়াবি ভঙ্গিতে। আরব্য রজনীর দেশে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় যেন অলৌকিক ঘটিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি!

হায়, অস্ট্রেলীয় ডিফেন্স! কেউ কি তাদের বলে দেয়নি, ভুলেও মেসির সামনাসামনি দৌড়ে আসতে নেই? বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়ে থাকতে হবে! তাঁকে ধরার একমাত্র উপায়, পাশ থেকে আক্রমণ করা। তা-ও যদি সেদিন জাদুকরের কোনও কারণে মনে-টনে হয়, ধুর, আজ আর খেলা দেখাতে ভাল লাগছে না!

আর কেউ কখনও একার পায়ে এ ভাবে ফুটবল ম্যাচের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পেরেছে? এক-এক সময় সত্যিই মনে হয়, মাঠে তাঁর উপস্থিতি যেন ঐশ্বরিক। সবাই জানে সামান্যতম জায়গা দিলেই সব্বোনাশ! কম্পিউটার অ্যানালিস্টরা জানেন, বক্সের সামনে বাঁ পায়ে বল পড়লে তিনি কী করতে পারেন। সবাই সব কিছু জানে। তবু কারও হাতে রিমোট নেই, সেই চলমান পদ্য থামানোর।

এমন মনে করার কোনও কারণ নেই যে, তিনি শুধুই বাঁ পা দিয়ে ফুটবল খেলেন। ফেলুদার মগজাস্ত্রও ভীষণ ভাবেই রয়েছে মেসির সাফল্যের নেপথ্যে। আমেরিকায় বিজ্ঞানীদের গবেষণায় একবার ধরা পড়েছিল, অন্য ফুটবলারেরা পায়ে বল পাওয়ার পরে গোলের রাস্তা খোঁজেন। মেসি বল আসা পর্যন্তও অপেক্ষা করেন না। প্রতিপক্ষ বল হারাতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখতে পেলেই পাখির চোখ তাক করা শুরু করেন তিনি। কম্পিউটার মস্তিষ্কে পর-পর সাজিয়ে ফেলেন গোলের গতিবিধি। ওই যে ওই ডিফেন্ডারটা আমাকে আটকাতে আসবে, তাকে এই ভাবে কাটাব। এর পর অন্য কেউ আসবে, কোমর দুলিয়ে বেরিয়ে যাব। গোলকিপার ভাববে উঁচুতে মারব, আমি মারব মাটি কামড়ানো শট...।

মেসির স্রষ্টা হিসেবে ধরা হয় বর্তমান ম্যাঞ্চেস্টার সিটি কোচ পেপ গুয়ার্দিওলাকে। বার্সেলোনায় ফল্‌স নাইন হিসেবে খেলিয়ে তিনিই পাল্টে দেন মেসির পৃথিবী। পেপের ফুটবল মানে দাবার বোর্ড। ধুরন্ধর চাণক্যের চালে মাত করেন তিনি। একবার থিয়েরি অঁরিকে কিছুতেই নকশা বোঝাতে পারছিলেন না পেপ। শেষ পর্যন্ত অঁরিকে বলেন, ‘‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। মাঠের এই জায়গাটা দ্যাখো, আমি চিহ্নিত করে দিচ্ছি। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, বল তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।’’ পরে বিস্মিত অঁরি বলেন, ‘‘জীবনে এমন কোচিং দেখিনি। যে জায়গায় আমাকে পেপ দাঁড়াতে বলেছিল, ঠিক সেখানেই বল এসেছিল আমার কাছে।’’ সেই পেপ পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘‘মেসিকে নকশা বোঝানো ছিল সব চেয়ে সহজ। সব কিছু যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেত।’’

দেশের জার্সিতে যাঁকে শুধু গোল করলেই চলে না, গলার শিরা ফুলিয়ে জোরে জোরে জাতীয় সঙ্গীতও গাইতে হয়! যেমন গাইছিলেন শনিবার রাতে। না হলে যে নিজের দেশের ওই লোকগুলোই আবার চেঁচাবে, ‘‘মেসি বিশ্বের সেরা ফুটবলার হতে পারে। কিন্তু আমরা ওকে চিনি না। ও আর্জেন্টিনার নয়, স্পেনের।’’ সৌদি আরবের কাছে প্রথম ম্যাচে অপ্রত্যাশিত হারের পরে যাঁকে গোল করে দলকে কয়েদখানা থেকে মুক্তি দিলেই চলে না। সারা ক্ষণ লড়ে যেতে হয় মারাদোনার অদৃশ্য ছায়ার সঙ্গে। আর্জেন্টিনায় ভিয়া ফিয়োরিতার বস্তিতে বড় হওয়া দিয়েগোই যে বরাবর সুয়োরানির সন্তান। তিনি— রোসারিয়োর ভদ্রসভ্য, মধ্যবিত্ত পাড়ায় জন্ম নিয়েও লিয়োনেল মেসি দুয়োরানির পুত্র।

কাতারের আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়াম এই কারণেই মেসির ফুটবল মানচিত্রে অনন্য স্টেশন হয়ে রইল। অতীতের সব তিক্ততা, দূরত্ব ভুলে আকাশি নীলের স্রোত বুকে টেনে নিল তাঁকে। আর দু’হাত তুলে তাঁদের কাছে ধরা দিতে ছুটলেন মেসিও। গ্যালারিতে উপস্থিত দেশের সমর্থকদের সঙ্গে গাইলেন, লাফালেন, ডানা মেলে উড়লেন। শিল্পের ছোঁয়ায় বলের সঙ্গে বশ মানাচ্ছেন নিজের দেশের বিরূপ জনতাকেও।

এতকালের ‘পরদেশি’ আখ্যা কি তা হলে ঘোচাতে পারবেন বিশ্বকাপ জিতে? এখনও অনেক পরীক্ষা বাকি। এর পরের প্রতিপক্ষ ছন্দে থাকা নেদারল্যান্ডস। সেমিফাইনাল পড়তে পারে ব্রাজিলের সঙ্গে। চার বছর পরে আমেরিকা বিশ্বকাপের সময় তাঁর বয়স হবে ৩৯। এটাই শেষ সুযোগ অধরা কাপ জয়ের।

কাতারে ফুটবল নয়, রাশিয়ান রুলে খেলছেন লিয়োনেল মেসি। ট্রিগারে চাপ আর শ্বাসরুদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করা— বেঁচে আছি তো?

FIFA World Cup 2022 Lionel Messi Qatar

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।