শেষ হয়ে গেল সেরিনা যুগ। ইউএস ওপেনে বিদায়ের সঙ্গেই টেনিসকেও বিদায় জানালেন তিনি। ছবি: রয়টার্স
আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসেছিল চার বছরের অলিম্পিয়া। মাথার চুলে সাদা বি়ডসের বাহার। তখনও কোর্টে আসেননি সেরিনা উইলিয়ামস।
ইউএস ওপেনের প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ। অলিম্পিয়াকে দেখে উপস্থিত অনেকেই ২০২২ থেকে ফিরে গেলেন সোজা ১৯৯৯ সালে। সে বারের ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন সেরিনার চুলে ছিল এমনই সাদা বি়ডস।
গত ২৩ বছরে একটা থেকে ২৩টা গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালকিন হয়েছেন সেরিনা। বদলে গিয়েছে বিশ্বের অনেক কিছু। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ভাবনা— সব। বদলে গিয়েছে প্রজন্ম। বহু বদলের বেশ কিছুরই অনুঘটক সেরিনা। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ক্রীড়াবিদের মধ্যে এখানেই আলাদা তিনি।
সেরিনার র্যাকেটে আমূল বদলে গিয়েছে মহিলাদের টেনিস। এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা পথ। বদলে গিয়েছে যুগ। আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে সেরিনার প্রতিটি সার্ভিস, ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড শাসন করেছে মহিলা টেনিসকে। জবাব দিয়েছে পুরুষদের টেনিসকেও। আধুনিক পাওয়ার টেনিস যে মহিলারাও খেলতে পারেন, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন সেরিনা। প্রমাণ করেছে তাঁর দুরন্ত গতির শট, মুহূর্তে কোর্টের অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষিপ্রতা। সেরিনার শক্তিশালী টেনিস প্রতিপক্ষের বুকে ভয় ধরিয়েছে। তার থেকেও অনেক বেশি মেয়েকে বল যুগিয়েছে। সাহসী করেছে কালো চামড়ার মানুষদের। টেনিসে আকৃষ্ট করেছে। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই সেরিনাকে অনুসরণ করে টেনিস কোর্টে পা রেখেছে অসংখ্য কিশোর-কিশোরী। যার ফল দেখা গিয়েছে দু’বছর আগের ইউএস ওপেনে। অ্যাফ্রো-আমেরিকান খেলোয়াড়ের সংখ্যা সে বার ছিল ১২। সেরিনার আগে অ্যাফ্রো-আমেরিকান হিসাবে গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে উঠেছিলেন জিনা গারিসন। গত পাঁচ বছরে কোকো গফ, স্লোয়েন স্টিফেন্স এবং ম্যাডিসন কিসদের নাম উঠেছে সেই তালিকায়। সেরিনা এক বার বলেছিলেন, ‘‘এক জন কালো টেনিস খেলোয়া়ড় হিসাবে আমি দেখতে অন্য রকম। আমার কণ্ঠস্বর অন্য রকম। আমি পোশাক পরি অন্য রকম। আমার সার্ভিসও অন্য রকম। কিন্তু কোর্টে নামলে যে কারও চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারি।’’
আমেরিকার সমাজে সাদা চামড়া-কালো চামড়ার বিভেদ নতুন নয়। টেনিস কোর্টে বরাবরই একছত্র দাপট সাদা চামড়ার মানুষদের। যেন খেলাটা তাদেরই। সেই ভাবনায় ধাক্কা দিয়েছেন সেরিনা এবং তাঁর দিদি ভিনাস উইলিয়ামস। সমাজ বদলের ‘কারিগর’ রাজনীতিকদের আগেই পরিবর্তনের আবহ তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁরা। বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসের দখল নেওয়ার আগেই ১০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা হয়ে গিয়েছিল সেরিনার। তাঁর নামের পাশে ‘১০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ শব্দবন্ধ বেমানান। তার জন্য দায়ী এক এবং এক মাত্র সেরিনা! এমনই উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
১০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম (সিঙ্গলস) রয়েছে এমন টেনিস খেলোয়াড়ের সংখ্যা বিশ্বে মাত্র ১৫। সেরিনা নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বের সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে আসবেন। শুধু টেনিস নয়, বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদদের তালিকা তৈরি হলে সেরিনা কত নম্বরে থাকবেন তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু তাঁকে তালিকায় রাখা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। ইউএস ওপেন শুরুর আগেই রাফায়েল নাদাল বলেছিলেন, “সেরিনা শুধু টেনিস খেলোয়াড়ই নয়, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ক্রীড়াবিদ।” দানিল মেদভেদেভ বলেছিলেন, “আগামী ১০০ বছর সেরিনাকে নিয়ে কথা হবে।” সেরিনা শুধু মহিলাদের টেনিসেই নয়, পুরুষ খেলোয়াড়দের থেকেও সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। দিনে দিনে মহিলাদের সমান অধিকারের দাবি বা লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছেন। ইউনিসেফ তাঁকে মনোনীত করেছে সমাজ কল্যাণের দূত হিসাবে। বিশ্বের পিছিয়ে থাকা অংশের শিশুদের নানা সমস্যা সমাধানে সব সময় অগ্রণী ভূমিকায় দেখা গিয়েছে সেরিনাকে। হয়ে উঠেছেন সমাজ-সভ্যতার প্রতিনিধি।
সেরিনা শুধু আধুনিক টেনিসের উজ্জ্বল দূত নন, আধুনিক আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারিগরও। আরবি ভাষায় সেরিনা শব্দের অর্থ আনন্দ বা শান্তিপূর্ণ আনন্দ। সেরিনা বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের সেই শান্তিপূর্ণ আনন্দ দিয়েছেন দু’দশকের বেশি সময় ধরে।
সেরিনা সমাজের উচ্চবিত্ত অংশের প্রতিনিধি নন। উচ্চ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত অংশেরও প্রতিনিধি নন। উইলিয়ামস বোনেরা নিম্নবিত্ত অংশের প্রতিনিধি। অর্থবানদের খেলা বলে পরিচিত টেনিসেও থাবা বসিয়েছেন তাঁরা। ভিনাস মহিলাদের টেনিসে যে নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন, তাকেই সেরিনা পূর্ণতা দেন ১৯৯৯ সালে ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে। যা নেহাত একটা খেতাব নয়। মহিলাদের টেনিসের ভরকেন্দ্র পরিবর্তনের সূচনা।
কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে সেরিনার প্রভাব সম্পর্কে প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় মার্টিন ব্ল্যাকম্যান বলেছেন, ‘‘একটা দরিদ্র পরিবারে বড় হয়ে উঠেছিল সেরিনা আর ভিনাস। টেনিস খেলার মতো টাকাও ছিল না। তার উপর বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকান সমাজে খেলাটা ছিল মূলত শ্বেতাঙ্গদের। সেই কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে আসা ওদের উত্থানের প্রথম ধাপ। নিজে অ্যাফ্রো-আমেরিকান হয়ে ওদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতাম। ওদের আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হয়ে যেতাম। বাকিরাও অবাক চোখে দেখত।” গফ বলেছেন, “সেরিনার আগে টেনিসে এমন কোনও খেলোয়াড় ছিল না যাঁর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেতাম। টেনিস খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠার সময় কোনও দিন সমস্যা হয়নি। কারণ জানতাম, বিশ্বের এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড়কে অনেকটা আমার মতোই দেখতে। এই বিশ্বে কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে জন্মালে একটু কমেই খুশি থাকতে হয়। সেরিনা শিখিয়েছে, ও কম পেয়ে থেমে যেতে রাজি নয়।” কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে সেরিনার প্রভাব এমনই। বছর পাঁচেক আগে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, আমেরিকার সব থেকে প্রভাবশালী ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব সেরিনাই।
গলিতে টেনিস খেলে সেরিনা এবং ভিনাসের উঠে আসা। তাঁদের বাবা রিচার্ড উইলিয়ামসই তাঁদের প্রথম কোচ। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েদের বিশ্বের সেরা হিসাবে দেখতে। দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়েছেন দুই মেয়েকে। মাত্র চার বছর বয়সেই সেরিনাকে টেনিস র্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলেন রিচার্ড। বাবার ধরিয়ে দেওয়া সেই র্যাকেট তুলে রাখার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছেন সেরিনা। জানিয়ে ছিলেন, এ বারের ইউএস ওপেনই তাঁর জীবনের শেষ প্রতিযোগিতা। যে কোনও রাউন্ডে হেরে যেতে পারতেন। চ্যাম্পিয়ন হয়েও শেষ করতে পারতেন টেনিসজীবনের সফর। তা হলেই ছুঁয়ে ফেলতেন মার্গারেট কোর্টের ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ড। হয়নি। তাতে বিন্দুমাত্র কমেনি সেরিনার কৃতিত্ব। সেরিনার গরিমা।
টেনিস কোর্টে সেরিনার বিদায়লগ্ন স্মরণীয় করে রাখতে আগে থেকেই প্রস্তুতি সেরে রেখেছিলেন প্রতিযোগিতার আয়োজক, তাঁর ভক্তরা। সেরিনার ক্রীড়া সরঞ্জাম সরবরাহকারী সংস্থাও নিয়েছিল বিশেষ উদ্যোগ। সোনা, হিরের নকশার পোশাকে সাজিয়েছিল তাঁকে। মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। মন না মানলেও প্রস্তুত ছিলেন ভক্তরা। প্রস্তুত ছিল স্বয়ং সেরিনার মস্তিষ্কও। সেই মস্তিষ্ক যা কোর্টের বাইরে থাকে। প্রস্তুত ছিল না তাঁর কোর্টের ভিতরের মস্তিষ্ক। যা গত ৩৬ বছর ধরে শুধু লড়াই করতে শিখেছে। যে হাত শক্তিশালী সার্ভিসে প্রতিপক্ষের হাতের র্যাকেট ছিটকে দিতে শিখেছে। কোর্টের সেরিনা হারতে ঘৃণা করতেন। কোর্টের সেরিনা বিদায় মানতেন না। কোর্টের সেরিনা শেষ না হওয়ার আগে থামতেন না। তবু থামলেন। নিজের শর্তে। নিজেকে পর্বত সমান উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করার পর। যে উচ্চতায় পৌঁছনো কঠিন নয়, বেশ কঠিন। উইম্বলডনের প্রথম রাউন্ডে হারের পর সেরিনা বলেছিলেন, ‘‘বিদায়বেলায় কোনও রকম আবেগ বা আড়ম্বর আমার পছন্দ নয়। সাধারণ ভাবেই টেনিসকে বিদায় জানাতে চাই।’’
মা হওয়ার জন্য কিছু দিন টেনিস থেকে দূরে ছিলেন সেরিনা। সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ঘরের দেওয়ালে টেনিস র্যাকেটটা ঝুলছে, অথচ আমি হাত দিতে পারছি না। জীবনে কখনও এমন দিন আসবে ভাবিনি। খুব হতাশ লাগত। কিন্তু মা হয়ে সন্তানের জন্য এটুকু করতে পারব না! এটা ভেবেই নিজেকে সামলে রেখেছিলাম।’’ ২০১৭ সালে গর্ভে সন্তানকে নিয়েই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কোর্টে ফেরার পর চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালেই উঠেছিলেন। তবু কোর্টকে ছোঁয়া হয়নি। না, আক্ষেপ নেই তাঁর। নিজেই বলেছেন, ‘‘নাই বা পারলাম কোর্টকে ছুঁতে। ২৩টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম কম কী?’’
৪০ বছরের সেরিনা টেনিসকে বিদায় জানাতেই পারেন। নিজের হাতে গড়া একটা যুগের অবসান ঘটাতেই পারেন। কিন্তু টেনিস কি তাঁকে বিদায় জানাবে? অলিম্পিয়া যে তিন বছর বয়সেই হাতে তুলে নিয়েছে টেনিস র্যাকেট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy