Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Yuvraj Singh

Yuvraj Singh Birthday: হার না মানা জেদের নাম যুবরাজ সিংহ, জন্মদিনে বার বার জন্ম নিক সেই জেদও

লড়লেন, জিতলেন এবং ফিরে এলেন। ২০১২ সালের মার্চে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন যুবরাজ। ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নামলেন সেই বছরের সেপ্টেম্বরে।

এক জেদের জন্মদিন, যুবরাজ সিংহের জন্মদিন।

এক জেদের জন্মদিন, যুবরাজ সিংহের জন্মদিন। —ফাইল চিত্র

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:২৭
Share: Save:

জ্বর, কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত, রাতে ঘুম না আসা, হাঁপানি, এইগুলি সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল ২০১১ বিশ্বকাপ জেতা নায়কের। দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়ে যে হাজার আলো জ্বলে উঠেছিল তাঁর চারপাশে, কিছু দিনের মধ্যেই সেই সব কেমন ঝাপসা হতে শুরু করল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বিশ্বকাপ জেতানো ছয়ের পর তাঁর কোলে লাফিয়ে ওঠা যুবরাজ সিংহের স্থান হল হাসপাতালের বিছানায়। ক্যানসার।

“যুবরাজের কেরিয়ারটা বোধ হয় শেষ হয়ে গেল।” ভারত তখন সদ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ৩৬২ রান এবং ১৫টি উইকেট নিয়ে সেই বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার যুবরাজ। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘গ্ল্যামার বয়’। তাঁকে নিয়েই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ক্রিকেট ভক্তদের মনে। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছেন যুবরাজ। আর তাঁকে ব্যাট হাতে দেখা যাবে কি না সেই নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কিন্তু যুবরাজ কী ভাবছেন? বাঁহাতি অলরাউন্ডার বললেন, “আমি একবারই ক্যানসারকে মেনে নিয়েছিলাম, যখন বিশ্বাস করলাম একে হারাতে পারব। জীবন যখন তোমাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, তখন একটাই পথ খোলা থাকে— উঠে দাঁড়ানো। তাই নিজেকে বললাম— ওঠো, আবার লড়তে হবে।”

লড়লেন, জিতলেন এবং ফিরে এলেন। ২০১২ সালের মার্চ মাসে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন যুবরাজ। ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নেমে পড়লেন সেই বছরের সেপ্টেম্বরে। এটাই জেদ, কলার তোলা আগ্রাসন। এটাই যুবরাজ সিংহ।

আরও পড়ুন:
ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্ত।

ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্ত। —ফাইল চিত্র

ছোটবেলায় টেনিস, রোলার স্কেটিং নিয়েই মেতে থাকত যোগরাজ সিংহের ছেলে। অনূর্ধ্ব-১৪ রোলার স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় স্তরে পদকও জিতেছিল ছেলেটা। কিন্তু বাবার তা পছন্দ হল না। সমস্ত পদক ফেলে দিলেন ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা যোগরাজ। ছেলেকে বলে দিলেন স্কেটিং ছেড়ে ক্রিকেটে মন দিতে। তাঁর ছেলেকে যে ক্রিকেটার হতেই হবে। ভারতের হয়ে খেলতেই হবে। প্রতি দিন ছেলেকে নিয়ে যেতেন ক্রিকেট শেখাতে। ছেলের একমাত্র কাজ ক্রিকেট খেলা, সেটা বুঝিয়ে দিলেন যোগরাজ। কিন্তু ছেলের প্রতি তাঁর এই ‘অত্যাচার’ মেনে নিতে পারলেন না স্ত্রী শবনাম সিংহ। বিবাহবিচ্ছেদ করলেন তিনি। ছেলে যুবরাজ ‘অত্যাচারী’ বাবাকে ছেড়ে মায়ের সঙ্গেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

বাবাকে ছাড়লেও ক্রিকেট ছাড়েননি যুবরাজ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পঞ্জাবের হয়ে নেমে পড়লেন রঞ্জি খেলতে। তবে ওড়িশার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে ওপেন করতে নেমে শূন্য করেছিলেন তিনি। প্রথম নজর কেড়েছিলেন ১৯৯৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ কোচবিহার ট্রফিতে। বিহার ৩৫৭ রান করেছিল সেই ম্যাচে। জবাবে পঞ্জাবের হয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে যুবরাজ একাই ৩৫৮ রান করেছিলেন। প্রসঙ্গত, সেই ম্যাচে বিহারের হয়ে ৮৪ রান করেছিলেন কোনও এক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। যুবরাজের ইনিংস ঢেকে দিয়েছিল তাঁকে। পরের বছরই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতীয় দলে ডাক পেয়ে গেলেন যুবরাজ। তৈরি হল দুই বাঁহাতির ‘দাদা-ভাই’ সম্পর্ক। এক আগ্রাসী অধিনায়ক খুঁজে নিল ১৯ বছরের আগ্রাসী ব্যাটারকে।

এক আগ্রাসী অধিনায়ক খুঁজে নিল ১৯ বছরের আগ্রাসী ব্যাটারকে।

এক আগ্রাসী অধিনায়ক খুঁজে নিল ১৯ বছরের আগ্রাসী ব্যাটারকে। ছবি: টুইটার থেকে

লর্ডসের বারান্দায় সৌরভ যে দিন জামা উড়িয়েছিলেন (ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল, ২০০২), মাঠে সেই দিন ৬৩ বলে ৬৯ করেছিলেন যুবরাজ। ওপেন করতে নেমে সৌরভ যে লড়াই শুরু করেছিলেন, মহম্মদ কইফের সঙ্গে সেটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এই বাঁহাতি। দাদার সম্মান রেখেছিলেন ভাই।

রবিবার ৪০ বছরে পা রাখা যুবরাজকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাঁর জীবনের সেরা কিছু ঘটনার কথা, সেই তালিকায় ন্যাটওয়েস্ট জয় যেমন থাকবে, তেমনই থাকবে ছয় ছক্কার ইনিংস। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সেই ম্যাচ ভুলতে পারবেন না যুবরাজ। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ কিছু বললেন পঞ্জাবতনয়কে। রেগে গেলেন বাঁহাতি ব্যাটার। সেই রাগ বার করলেন স্টুয়ার্ট ব্রডের উপর। একের পর এক বল উড়ে গেল মাঠের বাইরে। তাঁর খেলা দেখে মনে হল ছয় মারা কত সোজা। ওভারের শুরুতে রাগে কঠিন হয়ে যাওয়া মুখ সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেল হাসিতে। উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করলেন ধোনি। সে বারের বিশ্ব জয়ের পিছনেও বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন যুবরাজ।

এমন ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর জীবনে বসন্তের বাতাস যে দোলা দেবে তা আর আশ্চর্যের কী। প্রেম এল যুবরাজের জীবনে। এক নয় একাধিক। সেই তালিকায় ছিলেন দীপিকা পাড়ুকোনও। ২০০৭ সালে যুবরাজের ক্যারিশমা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি বলিউড সুন্দরী। নিজেও খেলার জগতের মানুষ ছিলেন। তাঁদের প্রেমও জমে উঠেছিল কিছু দিনের মধ্যেই। যুবরাজের খেলা দেখতে মাঠে উপস্থিত থাকতেন দীপিকা। যুবরাজের জন্মদিনে পার্টিও দিয়েছিলেন তিনি। সেই সম্পর্ক যদিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দীপিকার সঙ্গে কখনও নাম জড়িয়েছে ধোনির, কখনও রনবীর কপূরের। ভেঙে যায় দীপিকা-যুবরাজের জুটি।

যুবরাজের ক্যারিশমা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি বলিউড সুন্দরী।

যুবরাজের ক্যারিশমা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি বলিউড সুন্দরী। —ফাইল চিত্র

এরপর কখনও প্রীতি ঝাঙ্গিয়ানি, কখনও মিনিশা লাম্বা, কখনও আবার রিয়া সেনের নাম উঠে এসেছে যুবরাজের প্রেমিকা হিসেবে। তবে কোনও প্রেমই বেশি দিন টেকেনি। তাঁর জীবনের পথ যে বাঁধা ছিল হেজেল কিচের সঙ্গেই। ২০১১ সালে প্রথম দেখা হয় যুবরাজ এবং অভিনেত্রী হেজেলের। এক সাক্ষাৎকারে যুবরাজ বলেন, “২০১১ সালে এক বন্ধুর জন্মদিনে প্রথম হেজেলকে দেখি। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ওর হাসিতে। সন্ধ্যেবেলা ওর সঙ্গে কথা বলি। বডিগার্ড ছবিতে ওর অভিনয়ের প্রশংসা করি।”

সেই প্রশংসা যদিও তখন গায়ে মাখেননি হেজেল। যুবরাজ বার বার তাঁর সঙ্গে কফি খেতে যেতে বললেও রাজি হননি। যুবরাজ বলেন, “সাত-আট বার কফি খেতে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। এক বারও পাত্তা দেয়নি। আমাকে আগেও অনেকে নাকচ করেছে, কিন্তু এত বার কেউ না করেনি।” মাঠ ক্রিকেটের হোক বা প্রেমের, যুবরাজের জেদের কাছে হার মানতে হয় বিপক্ষকে। হেজেলকে কফি খেতে যেতে রাজি করাতে যুবরাজের সময় লেগেছিল তিন বছর তিন মাস।

২০১৪ সালে ফেসবুকে ফের বন্ধুত্ব হয় দু’জনের। বন্ধু অঙ্গদ বেদীর বন্ধু-তালিকায় দেখতে পান হেজেলকে। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্বের আহ্বান পাঠান যুবরাজ। তিন মাস অপেক্ষা করানোর পর বন্ধুত্বে সম্মতি দেন হেজেল। তত দিনে ক্যানসারকে হারিয়ে দিয়েছেন যুবরাজ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। সেই লড়াকু যুবরাজের সঙ্গে কফি খেতে যেতে রাজি হলেন হেজেল। শুরু হয় প্রেম। ২০১৬ সালের নভেম্বরে যা পরিণত হয় বিয়েতে।

২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রেম পরিণত হয় বিয়েতে।

২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রেম পরিণত হয় বিয়েতে। —ফাইল চিত্র

‘২৫ বছর পর আমি ঠিক করলাম এগিয়ে যেতে হবে। ক্রিকেট আমাকে সব কিছু দিয়েছে। এই যাত্রা পথের সঙ্গী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এই খেলা আমাকে শিখিয়েছে কী ভাবে লড়তে হয়, পড়ে গেলে উঠে ধুলো ঝেড়ে এগিয়ে যেতে হয়। দুর্দান্ত একটা সফর। দেখা হবে অন্য কোনও পথে।’ ২০১৯ সালের ১০ জুন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে টুইট করলেন যুবরাজ। ভারতীয় ক্রিকেটের আগ্রাসী ছেলেটাকে দেখা গেল ভারতীয় দলের ১২ নম্বর জার্সিটাকে শেষ বারের মতো ছুঁয়ে বিদায় নিতে।

কষ্ট রয়ে গেল? কিছু খারাপ লাগা রয়ে গেল? ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের দলে জায়গা হয়নি যুবরাজের। বাবা যোগরাজ আঙুল তুলেছিলেন ধোনির দিকে। বলেছিলেন, “যুবরাজকে বিশ্বকাপের দলে না দেখে আমি অবাক। ধোনির যদি আমার ছেলের সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনও ঝামেলা থেকে থাকে তা হলে আমি কিছু করব না, ঈশ্বর বুঝে নেবেন। ধোনি নির্বাচকদের বলেছে যে যুবরাজকে দলে প্রয়োজন নেই।” সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজের টুইট। তিনি লেখেন, ‘আমার বিষয়ে বাবা একটু বেশিই আবেগতাড়িত। সেই জন্যই এমন কথা বলেছেন। ধোনির নেতৃত্বে খেলতে ভালবাসি, ভবিষ্যতেও খেলব।’ মাছ ঢাকা দিলেও গন্ধ কিছুটা রয়েই গেল ভারতীয় ক্রিকেটে।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে ৪০টি টেস্ট, ৩০৪টি এক দিনের ম্যাচ এবং ৫৮টি টি২০ খেলা যুবরাজ ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে ছিলেন সমান পারদর্শী। তিনি মাঠে থাকা মানেই ভারতের জয়ের আশা বেঁচে থাকা। রেকর্ড বুক বলবে যুবরাজের খাতায় রয়েছে ১১,৭৭৮ আন্তর্জাতিক রান এবং ১৪৮টি উইকেট। কিন্তু বলবে না ক্রিজে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু কব্জির মোচড়ে মারা ছয়গুলি ছিল জেদের বিস্ফোরণ। ‘বোকা’ স্কোরবোর্ড বলবে না হাজার হাজার ক্যানসার আক্রান্তদের লড়াইয়ের শক্তির নাম যুবরাজ সিংহ, তাঁদের জীবনের হার না মানা জেদের নাম যুবরাজ সিংহ। এমনই এক জেদ এই যুবরাজ যে, ক্যানসার থেকে ফিরে আসার পর আইপিএল-এর নিলামে তাঁকে কেনার জন্য কোনও দল দেয় ১৪ কোটি টাকা। আবার পরের নিলামে তাঁকে ১৬ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেয় অন্য কোনও দল। ২০২১ সালের নিলামের আগে যুবরাজই ছিলেন আইপিএল-এর ইতিহাসে সব চেয়ে দামী ক্রিকেটার।

গত বছরের জন্মদিনে তিনি চেয়েছিলেন তিন কৃষি আইন নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কেন্দ্রের বিরোধ মিটে যাক। তাঁর সেই আশাপূরণ হয়েছে। রবিবার আরও একটা জন্মদিন। এক জেদের জন্মদিন, যুবরাজ সিংহের জন্মদিন।

অন্য বিষয়গুলি:

Yuvraj Singh yograj singh MS Dhoni 2011 world cup
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy