আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর সূযশ শর্মাকে দেখা যায় বলে থুতু লাগাতে। করোনা অতিমারির পর যা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ বারের আইপিএলে আবার সেই অনুমতি দেওয়া হয়েছে বোলারদের। এখন বোলারেরা বলে থুতু লাগাতে পারেন। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসে বল বদলানোর সুযোগও পাচ্ছেন তাঁরা। এতে লাভ হচ্ছে কি?
বোর্ডের নতুন নিয়ম
এ বারের আইপিএলে বোলারদের কিছুটা সাহায্য করতে চেয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বিভিন্ন নিয়মের কারণে ক্রিকেট এখন অনেকটাই ব্যাটারদের খেলা। তার মাঝেই ভারতীয় বোর্ড কিছুটা শিথিল হয়েছে। চালু হয়েছে দু’টি নিয়ম। একটি, বলে থুতু লাগাতে দেওয়া। দ্বিতীয় নিয়মটি আনা হয়েছে শিশিরের মোকাবিলা করার জন্য। আইপিএল যে সময় হয়, তখন ভারতের বিভিন্ন মাঠে শিশির পড়ে। সেটা মাথায় রেখে টসে জেতা দলের অধিনায়ক আগে বল করার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিকে শিশির পড়লে বোলারদের বল করতে অসুবিধা হয়। সমস্যা হয় ফিল্ডিংয়েও। সেই কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে দু’টি বল ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম হয়েছে, দ্বিতীয় ইনিংসের ১১তম ওভারের পর আম্পায়ারেরা বল পরীক্ষা করবেন। যদি অত্যধিক শিশির থাকে, তা হলেই বোলিং করা দল নতুন বল ব্যবহারের অনুমতি পাবে। সেই বল অবশ্য চকচকে পালিশ করা বল নয়। পুরনো বলই দেওয়া হবে। শুধু সেই বলটি হবে শুকনো। গত ২৬ মার্চ কলকাতা নাইট রাইডার্স বনাম রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচে প্রথম বার সেই নিয়ম কাজে লাগানো হয়।
প্রথম আবেদন শামির
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর জোরে বোলার মহম্মদ শামি বলেছিলেন, “আমরা রিভার্স সুইং করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেটা করতে গেলে বলে থুতু লাগাতে হবে। তার জন্য আইসিসির কাছে বার বার আর্জি জানাচ্ছি। রিভার্স সুইং বোলারদের একটা বড় অস্ত্র। এটা না থাকলে পুরনো বলে আউট করা কঠিন।” শামির সেই আবেদন বোর্ডের কানে পৌঁছেছে। আইসিসি এখনও কোনও অনুমতি না দিলেও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আইপিএলে বলে থুতু লাগানোর অনুমতি দিয়েছে।
আইপিএলের আগে সব দলের অধিনায়কের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। শামিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন বেশির ভাগ অধিনায়কই। কেউ কেউ মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু সেটা ধোপে টেকেনি।
আদৌ লাভ হচ্ছে?
বলে থুতু লাগানোর মূল উদ্দেশ্য রিভার্স সুইং করানো। সাদা বলে রিভার্স সুইং করানো কঠিন। ফলে আইপিএলে বোলারেরা থুতু লাগানোর সুযোগ পেলেও তাতে খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে করা হচ্ছে না। নতুন সাদা বল কিছুটা হালকা। সেখানে থুতু না লাগিয়ে ক্রিকেটারেরা ঘাম ব্যবহার করেন। আইপিএলের শেষ কয়েকটি মরসুমে ইনিংসে বহু বার ২০০-র বেশি রান উঠেছে। ব্যাটারেরা এখন শুরু থেকেই মারার লাইসেন্স নিয়ে নামেন। তার উপর পিচ ক্রমশ পাটা হচ্ছে, রয়েছে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নিয়ম। সাদা বলে পেসারেরা বার বার বিপদে পড়ছেন। শিশিরের কারণে বিপদে পড়ছেন স্পিনারেরাও। থুতু লাগানোর সুযোগ পেয়ে কি আদৌ লাভ হল পেসারদের? বাংলার প্রাক্তন পেসার শিবশঙ্কর পাল আনন্দবাজার ডট কমকে বললেন, “এখনই বলা মুশকিল। সবে কয়েকটা ম্যাচ হয়েছে। যত প্রতিযোগিতা এগোবে, তত বোঝা যাবে।” দেশের হয়ে দু’টি টি-টোয়েন্টি খেলা পারবিন্দর আওয়ানা বলেন, “বল পুরনো হলে এক দিক চকচকে করতে হয়। তাতে রিভার্স সুইং পাওয়া যায়। থুতু ব্যবহার করে বলের একটা দিক পালিশ করা হয়। লাল বলের চামড়া কিছুটা নরম। তাই থুতু লাগিয়ে পালিশ করা হলে বেশি চকচক করে। সাদা বলের চামড়া শক্ত। তাই চকচকে ভাব বেশি ক্ষণ থাকে না। শুরুর দিকে সুইং করলেও পরের দিকে সেটা কমে যায়। থুতু ব্যবহার করে সেটা কিছুটা ধরে রাখা সম্ভব।”

বলের এক দিক পালিশ করা চলছে। —ফাইল চিত্র।
শিবশঙ্কর মনে করেন রিভার্স সুইং করানোর জন্য শুধু থুতু নয়, প্রয়োজন পুরো দলের সাহায্য। তিনি বলেন, “সাদা বল এবং লাল বলের মধ্যে তফাত রয়েছে। থুতু দিয়ে পালিশ করলে লাল বল যতটা চকচক করে, সাদা বল ততটা করে না। তবে শুধু থুতু লাগালেই বল রিভার্স সুইং করবে, এমন নয়। কোন ওভার থেকে রিভার্স সুইং করানো যাবে সেটাও নির্ভর করছে দলের উপর। রিভার্স সুইংয়ের জন্য বলের এক দিকে চকচকে থাকতে হয়, অন্য দিকটা হবে খসখসে। পুরো দল মিলে বলের এক দিক পালিশ করে। তবে রিভার্স সুইং আসে। ২০ ওভারের ক্রিকেটে সেটা আনতে আনতে ম্যাচ শেষ হয়ে যেতে পারে, আবার ঠিকমতো করতে পারলে প্রথম ১০ ওভারের মধ্যেই বল রিভার্স সুইং করতে পারে। সেটা দল কী চাইছে তার উপর নির্ভর করে। থুতু লাগালে বল ভারী হয়। ঘামের সাহায্যে সেটা করা কঠিন। তাই থুতু লাগানোর অনুমতি পাওয়ায় বোলারদের সুবিধাই হয়েছে।”
কতটা তফাত গড়ছে?
সাদা বলের ক্রিকেটে থুতু লাগানোর সুযোগ কতটা তফাত গড়বে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে বল পরিবর্তনের সুযোগ অনেক বেশি সাহায্য করবে বোলারদের। কলকাতার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ইনিংসে রাজস্থান বল পরিবর্তন করেছিল। মাঠে শিশির পড়ছিল বলে বল ভিজে গিয়েছিল। স্পিনারদের অসুবিধা হচ্ছিল বল গ্রিপ করতে। ১৬তম ওভারে বল পরিবর্তন করে রাজস্থান। কিন্তু তখন ম্যাচ হাত থেকে প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল। ২৪ বলে বাকি ছিল ২৭ রান। যা করতে অসুবিধা হয়নি কলকাতার। বল বদলে স্পিনার মাহিশ থিকসানাকে বল করতে পাঠিয়েছিলেন রিয়ান পরাগ। তিনি সেই ওভারে ১০ রান দিয়েছিলেন। লেগ স্টাম্পের বাইরে এমন বল করেছিলেন যে, চার হয়ে যায়। শুকনো বলেও এমন কাণ্ড করলে বল বদলে আর কী লাভ?
ব্যাট এবং বলের লড়াইয়ে কিছুটা ভারসাম্য আনার জন্যই নিয়ম বদল করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বোলারদের সুবিধা পেতে দেখা যাচ্ছে না। বরং বেশির ভাগ ম্যাচে ২০০-র উপরে রান উঠছে অনায়াসে। কোনও দল আবার ২৫০ রান করেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না। শিবশঙ্কর বললেন, “যে ধরনের পিচ তৈরি করা হচ্ছে, তাতে ব্যাটারেরা অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছে। ফলে রানও উঠছে। শুধু থুতু লাগানোর অনুমতি পেলেই বোলারেরা ভয়ঙ্কর হয়ে যাবেন, সেটা সম্ভব নয়। নতুন বল স্পিনারদের গ্রিপ করতে সমস্যা হয়। তাই স্পিন সহায়ক পিচ হলে পেসারেরা প্রথম দিকে বলের পালিশ তোলার চেষ্টা করে। পেস সহায়ক পিচ হলে আবার অন্য পরিকল্পনা নিতে হয়। এগুলো মূলত নির্ভর করছে, কোন মাঠে খেলা হচ্ছে তার উপর। আইপিএলের পরের দিকের ম্যাচে হয়তো বলের পালিশ তাড়াতাড়ি উঠবে, কারণ তখন মাঠের ঘাস একটু পুরনো হয়ে যাবে। বল সেই সব জায়গায় পড়লে চকচকে ভাবটা তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে। তখন স্পিনারেরা আরও বেশি সাহায্য পাবে।”
শামিদের দাবি মেনে আইপিএলে অন্তত ভারতীয় বোর্ড থুতু লাগানোর অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সেটা খুব সাহায্য করছে বলে দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আইপিএলের প্রথম দু’সপ্তাহে সেটা দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত শামিদের হয়তো থুতু গিলতেই হবে!