ভারতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড়। —ফাইল চিত্র।
দেড় বছরের মধ্যে রাহুল দ্রাবিড়ের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছে। বড় প্রতিযোগিতাগুলিতে ভারতীয় দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরে প্রশ্ন উঠেছে দ্রাবিড়ের আর ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হিসাবে থাকা উচিত কিনা। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলির মতো তারকাখচিত দলে আদৌ কি কোনও প্রথাগত কোচ দরকার? তিনি কি একই সাজঘরে থাকা একগুচ্ছ তারকাকে সামলাতে পারবেন?
শেন ওয়ার্নকে এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ভারতীয় দলের কোচ হিসাবে কে সবথেকে উপযুক্ত হতে পারেন? জবাবে প্রয়াত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার বলেছিলেন, “ভারতীয় ক্রিকেটারদের অসংখ্য ভক্ত। তাঁরা সেই সব ক্রিকেটারদের ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে পুজো করেন। এমন তারকাখচিত দলের কোচ হয়ে সাফল্য পাওয়া কঠিন। এই দলের কোচ হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম এক জন। তিনি গ্রেগ চ্যাপেল।’’ সেই গ্রেগেরও কী হাল হয়েছিল, সবার জানা।
সাফল্য তো পানইনি, বরং তিনি কোচ থাকার সময় ভারতীয় দলের নানা সমস্যা তৈরি হয়। দল থেকে বাদ পড়ে শুধু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ই নন, আরও অনেক ক্রিকেটারই তাঁর সম্পর্কে নানা কথা বলেন। সচিন তেন্ডুলকর চ্যাপেল সম্পর্কে বলেছিলেন, “সিনিয়র ক্রিকেটারেরা মেনে নিতে পারছিল না চ্যাপেলের নীতি। বিশ্বকাপের (২০০৭) ঠিক এক মাস আগে দলে একাধিক বদল করে চ্যাপেল। যা দরকার ছিল না। কিন্তু প্রত্যেক খেলোয়াড়ের উপর তার প্রভাব পড়ে। অন্য দলগুলো বিশ্বকাপের জন্য অনুশীলন করছে, পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ভারতীয় দলে চ্যাপেল তখন দল নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে যাচ্ছেন।”
শুধু সচিন নন, চ্যাপেলকে নিয়ে মুখ খুলেছিলেন বীরেন্দ্র সহবাগ, ভিভিএস লক্ষ্মণ, হরভজন সিংহেরাও। সহবাগ সম্প্রতি বলেছেন, “বিদেশী কোচদেরও দলে পছন্দের ক্রিকেটার থাকে। চ্যাপেল এসে প্রথমেই বলল সহবাগ অধিনায়ক হবে। দু’মাসের মধ্যে দল থেকেই বাদ পড়ে গেলাম আমি।” লক্ষ্মণকে একবার মাঠ ছাড়তে বারণ করেছিলেন চ্যাপেল। জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে আঙুলে চোট লাগায় মাঠের বাইরে এসেছিলেন লক্ষ্মণ। বরফ লাগানোর জন্য। সেই সময় লক্ষ্মণের পরিবর্তে নামা ক্রিকেটার একটি ক্যাচ ফেলেছিলেন। তাতেই রেগে গিয়েছিলেন চ্যাপেল। তিনি বলেছিলেন, “তুমি কি মরে যাচ্ছিলে ওই চোটের কারণে? যদি তা না হয়, তাহলে মাঠ থেকে বাইরে এস না।” লক্ষ্মণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এই ঘটনায়। তিনি নিজে এই ব্যাপারে যদিও কিছু বলেননি। চ্যাপেলের সময়টিকে ভারতীয় ক্রিকেটের সব থেকে খারাপ দিন ছিল বলে মনে করেন হরভজন। তিনি বলেন, “চ্যাপেল আমাদের কোচ হওয়ার পর পুরো দলটাকেই ঘেঁটে দিয়েছিল। কী পরিকল্পনা নিয়ে ও এসেছিল জানি না। একটা শক্তিশালী দলকে নষ্ট করার জন্য চ্যাপেল যথেষ্ট। সাংবাদিকদের নিজের মতো ব্যবহার করত চ্যাপেল। যা বলত তাই লিখত। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ আমার কাছে সব থেকে খারাপ সময়। আমার মনে হয়েছিল, ওই সময় ভারতের হয়ে খেলাই ঠিক হচ্ছে না। ভুল লোকের হাতে ছিল ভারতীয় ক্রিকেট। পুরো দলটা নষ্ট করে দিয়েছিল চ্যাপেল।”
‘কোচিং’ করাতে গিয়ে চাকরি খুইয়েছিলেন অনিল কুম্বলেও। ভারতের প্রাক্তন স্পিনার কোচ থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে তৎকালীন অধিনায়ক বিরাটের মতান্তর প্রকাশ্যে আসে। কুম্বলে দায়িত্ব ছাড়ার পর বলেছিলেন, “দলের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখা, পেশাদারিত্ব আনা— এগুলো কোচের কাজ। কোচের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ক্রিকেটারদের মানিয়ে নেওয়া উচিত। অধিনায়ক বা দলের অন্য কোনও ক্রিকেটারকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়।” তাঁর সঙ্গে কাজ করে চূড়ান্ত অখুশি থাকা বিরাট পাল্টা বলেছিলেন, “দলের কোনও ক্রিকেটার এত নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে খেলতে পারছে না। তরুণ ক্রিকেটারেরা ভয় পেয়ে রয়েছে।”
আইপিএল খেলার সময় ওয়ার্ন বলেছিলেন, একটা পর্যায়ের পর ক্রিকেটে কোচের প্রয়োজন হয় না। তিনি রাজস্থান রয়্যালসের কোচ এবং অধিনায়ক ছিলেন। বলেছিলেন, “আমি রাজস্থান দলের কোচ, কারণ এই দলে কোনও কোচ নেই। আমার দু’জন সহকারী আছে ড্যারেন বেরি এবং জেরেমি স্নেপ। তারা খুব ভাল কাজ করে।”
ওয়ার্ন মনে করতেন আন্তর্জাতিক স্তরে যাঁরা খেলেন, তাঁরা ক্রিকেট খেলাটা শিখেই এসেছেন। তাই শেখানোর কিছু নেই। সত্যিই তো! কী ভাবে ব্যাট বা বল করতে হবে, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামিদের সেটা তো রাহুল দ্রাবিড় শেখান না। এক জন কোচের কাজ পরিকল্পনা তৈরি করা। বিপক্ষ অনুযায়ী প্রথম একাদশ বেছে নেওয়া। দলকে ‘ম্যানেজ’ করা। সেটা করতেই কি ব্যর্থ হচ্ছেন দ্রাবিড়?
এই ম্যানেজ করার দিকটাই তুলে ধরলেন বাংলার সহকারী কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী। বাংলা দলে খেলেন রাজ্যের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারি। অনুশীলনে সময়ের আগে চলে আসতে দেখা যায় তাঁকে। সেই সময় নিরাপত্তারক্ষীদের নেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন তিনি। সৌরাশিস বলেন, “বড়দের ক্রিকেটে অনেক বেশি করে ক্রিকেটারদের মানসিকতা বুঝতে হয়। তাদের সমস্যার কথা শুনতে হয়। হয়তো পারিবারিক সমস্যার কারণে মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা হচ্ছে কোনও ক্রিকেটারের। সেটাও এক জন কোচের শোনা উচিত, বোঝা উচিত। না হলে দল পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে যায়।”
পাশাপাশি তিনি এটাও বললেন, সফল কোচ হতে গেলে যেমন ভাল ম্যানেজার হতে হবে, তেমনই ভাল ভাবে ক্রিকেটের টেকনিক্যাল দিকও বুঝতে হবে। সৌরাশিসের বক্তব্য, “ছোটদের ক্রিকেট শেখানোর সময় অবশ্যই টেকনিক্যাল বিষয়ের দিকে বেশি নজর দিতে হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে খেলা এক জন ক্রিকেটারকে সামলাতে কোচেদের ভাল ম্যানেজার হতেই হয়।”
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর জানানো হয়েছিল ভারতীয় দলের কোচ হচ্ছেন দ্রাবিড়। সেই সময় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, “দ্রাবিড়ের দুর্দান্ত একটা ক্রিকেট কেরিয়ার রয়েছে। অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ও। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে থাকাকালীন দ্রাবিড় খুব ভাল কাজ করেছে। তরুণ ক্রিকেটারদের ও তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক স্তরে ভাল খেলার জন্য। আশা করি সেটা ও সিনিয়র দলের হয়েও করবে এবং ভারতকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।”
২০১৯ সালে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান হয়েছিলেন দ্রাবিড়। সেই সময় থেকেই তিনি তরুণ ক্রিকেটারদের তুলে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেন। যুব দলের কোচ হিসাবে তাঁর সাফল্য নজর কেড়েছিল। দ্রাবিড়ের মতো ক্রিকেটার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন তরুণদের জন্য। কিন্তু গত দু’বছরে রোহিত, বিরাটদের কোচ হওয়ার পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও ব্যর্থ হয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দ্রাবিড়ের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও।
প্রশ্ন ১: ঋদ্ধিমান সাহাকে বাদ দিয়ে কেন শ্রীকর ভরত?
বাংলার উইকেটরক্ষককে বাদ দেওয়া হয় তাঁর বয়সের কারণে। অথচ ঋদ্ধির থেকে মাত্র দু’এক বছরের ছোট ক্রিকেটারেরা ভারতীয় দলে এখনও দাপিয়ে খেলছেন। ভরত ঘরোয়া ক্রিকেটেও তেমন সাফল্য পাননি। ভারতের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রান পাননি। অথচ তাঁকেই নিয়ে যাওয়া হল ইংল্যান্ডে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলার জন্য। অজিঙ্ক রাহানেকে ফেরানো হলে ঋদ্ধিও তো ফিরতে পারতেন।
প্রশ্ন ২: রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে কেন রাখা হল না?
টেস্টের ক্রমতালিকায় এক নম্বর বোলার অশ্বিন। ভারতীয়দের মধ্যে সব থেকে বেশি উইকেট নেওয়ার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে তিনি। অথচ কয়েক ঘণ্টার মেঘলা আকাশ দেখেই পাঁচ দিনের টেস্টে বাদ দিয়ে দেওয়া হল অশ্বিনকে। বিপক্ষে পাঁচ জন বাঁহাতি ব্যাটার থাকার পরেও ভারতীয় অফস্পিনারকে বসিয়ে রাখলেন রাহুলরা।
প্রশ্ন ৩: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল বাছাইয়ে পরিকল্পনা ছিল কি?
ভারতীয় দল জানিয়েছিল কিছু ক্রিকেটারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে থেকেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল বেছে নেওয়া হবে। কিন্তু যশপ্রীত বুমরা চোট সারিয়ে ফিরতে পারবেন না বোঝার পর তৈরি হতে বলা হয় মহম্মদ শামিকে। তিনি সে ভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগই পেলেন না বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতার আগে। তার আগে শামিকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকেই প্রায় ছেঁটে ফেলেছিল ভারত। অথচ আইপিএলে ধারাবাহিক ভাবে সফল শামি। যে আইপিএলে ভাল খেলার জন্য দীনেশ কার্তিক দলে জায়গা পান, সেই আইপিএলেই ভাল খেলেও জায়গা হয় না অন্যদের। একেক জন ক্রিকেটারদের জন্য একেক রকম নিয়ম।
এমন নানা ধরনের প্রশ্ন থেকে একটা জিনিসই পরিষ্কার করছে যে, দলের এই সিদ্ধান্তগুলো সবই পরিকল্পনাগত ভুল। অর্থাৎ ক্রিকেটারেরা ভুল খেলছেন, এমন নয়। সে ক্ষেত্রে আদৌ কোচের কোনও ভূমিকা কি রয়েছে? ফুটবলে কোচের বদলে ম্যানেজার শব্দটি প্রচলিত। অর্থাৎ যে ব্যক্তি দল পরিচালনা করেন। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড দলে যেমন ছিলেন অ্যালেক্স ফার্গুসন। একই দলে ডেভিড বেকহ্যাম, রিয়ো ফার্দিনান্দ, রায়ান গিগস, পল স্কোলসরা খেলেছিলেন। তাঁর হাত ধরে তারকা হয়ে উঠেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। এত সব তারকাকে সামলে একের পর এক ট্রফি জিতেছিলেন ফার্গুসন। তারকা ফুটবলারদের মান, অভিমান সামলাতে হয়েছে। অনেকের মধ্যে অহং বোধ কাজ করে। সেই সব সামলে দলের মধ্যে থেকে সেরাটা বার করে নিতে হয়। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে যেমন করেছিলেন জিনেদিন জিদান।
ম্যাঞ্চেস্টারে খেলার সময় বেকহ্যামকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন ফার্গুসন। যে ফুটবলার দলের বিজ্ঞাপনের মুখ, তাঁর জন্য ব্যবসার দিকে লাভ হচ্ছে, সেই ফুটবলারকেও কড়া হাতে সামলাতেন অভিজ্ঞ কোচ। এক বার অনুশীলনে আসতে পারেননি। তাঁর বাচ্চার শরীর খারাপ ছিল। মা ভিক্টোরিয়াও তখন দেশে নেই। এর পরেও শাস্তি পেতে হয়েছিল বেকহ্যামকে। এক ম্যাচ নির্বাসিত করেছিলেন ফার্গুসন। দলের মুখ হয়ে ওঠা বেকহ্যামের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কথা কাটাকাটি হত ফার্গুসনের। তিনি যে বেকহ্যামকে নিয়ে খুশি নন, সে কথা বোর্ডকে জানিয়ে ছিলেন। ফার্গুসন বলেন, “আমি বোর্ডকে বলে দিয়েছিলাম যে, বেকহ্যামকে চাই না।” ফার্গুসনের কাছে সব ফুটবলার সমান ছিলেন। বাড়তি গুরুত্ব কাউকে দিতে চাইতেন না। সে তিনি বেকহ্যাম হন বা রোনাল্ডো।
ভারতীয় ক্রিকেটেও এমন কাউকে প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় দলের একাধিক তারকা ক্রিকেটার রয়েছেন। তাঁদের সামলাতে হলে শুধু ভাল কোচ হলেই চলবে না, প্রয়োজন এক জন পরিচালক। সেটা কি দ্রাবিড় করতে পারছেন? ২০২৩ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দ্রাবিড়কে। তার পর কি বদলে যাবে কোচ? সেই জায়গায় কাকে আনা হবে? সেই সব প্রশ্নের থেকেও জরুরি আদৌ দলের কোচ প্রয়োজন কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy