সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মুম্বইয়ে মঙ্গলবার। পিটিআই।
পুজোর ঢাকের বাজনার মধ্যে থেমে গিয়েছিল তাঁর ক্রিকেটজীবন। মহানবমীতে সেই অবসর ঘোষণা বাঙালি মনে আগাম বিসর্জনের বিষাদ এনে দিয়েছিল।
সেটা ছিল ২০০৮। চোদ্দো বছর পরে পুজোর রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ফের সেই বিষাদের সানাই। সে দিন বিদায় নিচ্ছিলেন ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ১১ অক্টোবর, ২০২২— বোর্ডের ড্রেসিংরুম থেকে বিদায় নেওয়ার পথে প্রশাসক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ক্রিকেট জীবনের মতো মহারাজকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটাবেন, এমন আশাও ক্ষীণ।
মঙ্গলবার আরব সাগরের পারে বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের বৈঠকে পদাধিকারীদের নাম চূড়ান্ত হয়ে গেল। পুরনো কর্তারা প্রায় প্রত্যেকেই রয়েছেন। কারও কারও হাতে পদোন্নতির চিঠিও উঠল। ‘উইকেট’ গেল শুধু সৌরভের। আর যেহেতু সৌরভ, দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রশ্ন, বঙ্গসন্তান কি রাজনৈতিক গুগলিতে বোল্ড হলেন? কে বলবে, তিনি সৌরভ কুইজ়মাস্টার বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন ‘গুগলি রাউন্ড’ পরিচালনার জন্য!
বোর্ড সচিব হিসেবে থাকছেন অমিত শাহ-পুত্র জয়। অনুরাগ ঠাকুরের ভাই অরুণ ধুমাল আর কোষাধ্যক্ষ থাকতে চাননি। তাঁকে আইপিএল চেয়ারম্যান করা হচ্ছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট রাজীব শুক্ল। কিন্তু সৌরভের জন্য যেন অপেক্ষা করছিল গ্রেগ চ্যাপেলের বিধান। তিনি সটান বাদ। তাঁর জায়গায় নতুন প্রেসিডেন্ট করে আনা হচ্ছে কপিল দেবের বিশ্বকাপজয়ী তিরাশি দলের সতীর্থ বোলার রজার বিন্নীকে।
ক্রিকেটারকে সরিয়ে ক্রিকেটার নিয়ে আসা। কিন্তু কেউ যদি বলেন, বিন্নী বোর্ড চালাবেন আর অমিত-পুত্র পার্শ্বচরিত্র হিসেবে সঙ্গত করবেন, তা হলে মানতে হবে সৌরভের ভাল বন্ধু ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল!
প্রেসিডেন্ট পদের জন্য পুনর্নিবাচিত না হওয়া সৌরভকে আচমকা আইপিএল চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রাক্তন অধিনায়ক এবং এ দিনই কার্যত সদ্য প্রাক্তন হয়ে পড়া বোর্ড প্রেসিডেন্ট বিনীত সুরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, তিনি বলে দেন, বোর্ড প্রেসিডেন্ট থাকার পরে আইপিএলের মতো সাব-কমিটির চেয়ারম্যান কী করে হবেন? মুখে না বললেও তাঁর তো বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, এর অর্থ হল ভারত অধিনায়ককে বলা হচ্ছে, যাও গিয়ে ‘এ’ দলের ক্যাপ্টেন্সি করো।
সৌরভের একমাত্র আশা হিসেবে টিমটিম করে বেঁচে রয়েছে আইসিসি চেয়ারম্যানের পদ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন সেই নির্বাচন হবে। কিন্তু বোর্ড প্রেসিডেন্ট পদ থেকে যে ভাবে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল, তার পরে আর আইসিসি মসনদের জন্যও খুব আশা দেখছেন না অনেকে। সেখানেও বোর্ড অন্য কোনও নামকে সমর্থন করলে অবাক হওয়ার থাকবে না। বোর্ড প্রশাসনে অভিজ্ঞ এক জনের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সৌরভকে সরানো তো হলই, সম্মানজনক বিদায়ের রাস্তাও দেওয়া হল না। ওঁর মতো তারকাকে এটুকুও বলার সুযোগ দেওয়া হল না যে, আমি সরে যাচ্ছি। তাতে সম্মান কিছুটা অন্তত বাঁচত।’’ তাই এর পরে আইসিসি চেয়ারম্যান পদের জন্য সহানুভূতির ঢেউ উঠবে, গ্যারান্টি কে দেবে!
যে-হেতু সৌরভ, ফের রাজনীতির রং লাগতে শুরু করেছে তাঁর অপসারণ নিয়ে। কলকাতায় বিজেপি বনাম তৃণমূল যুযুধান পার্টির তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। সারা ভারতের ক্রিকেটমহলেও কারও কারও মত, সৌরভ রাজনীতির শিকার। যে-হেতু তাঁর বঙ্গ বিজেপিতে যোগদানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, পরে তিনি নিজে রাজনীতির ময়দানে আর নামতে চাননি, সেই কারণে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হল— এমন থিয়োরি বাজারে ঘুরছে। দেশের ক্রীড়া প্রশাসনে ‘ওপেন সিক্রেট’ হচ্ছে, বিজেপি হাইকম্যান্ডের বরাভয় না পেলে সর্বোচ্চ মসনদে বসার উপায় নেই।
এ বারের বোর্ড পদাধিকারীদের মধ্যে অমিত-পুত্র জয় শাহ তো আছেনই, অসমের মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থনে যুগ্ম-সচিব হচ্ছেন দেবজিৎ শইকিয়া। নতুন কোষাধ্যক্ষ হচ্ছেন মহারাষ্ট্র বিজেপির প্রভাবশালী সদস্য আশিস শেলার। বিজেপির মুম্বই শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, মহারাষ্ট্র বিধানসভারও সদস্য হয়েছেন। লোঢা কমিটির সুপারিশকে পাল্টে দিয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, প্রেসিডেন্ট এবং সচিব টানা দু’টি মেয়াদ থাকতে পারবেন বোর্ডে। সেই রায়ের পরেও চেয়ার খালি করে দিতে হচ্ছে সৌরভকে।
২০১৯-এ যখন সৌরভ বোর্ড প্রেসিডেন্ট হন, তার আগে দেখা করেছিলেন অমিত শাহের সঙ্গে। যত চর্চা সেই বৈঠক নিয়ে। এর পরেই বাড়তে থাকে সৌরভকে নিয়ে জল্পনা এবং বলা হচ্ছিল, ‘ডিল’ হয়েছে। সৌরভ বোর্ড প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, বিনিময়ে তিনি হবেন বঙ্গ বিজেপির মুখ। যদিও সৌরভের ঘনিষ্ঠমহল দাবি করে এসেছে, এমন কোনও ‘প্রতিশ্রুতি’ তিনি বিজেপি হাইকম্যান্ড বা পার্টি সুপ্রিমোকে দেননি। খুব জোর বলে থাকতে পারেন, রাজনীতিতে যোগদানের কথা যথাসময়ে ‘ভেবে দেখবেন।’ সেই ‘ভেবে দেখা’ হারিয়ে গিয়েছে। ক্রিকেট বোর্ড প্রশাসনে তিনিও কি তাই তলিয়ে গেলেন?
সৌরভকে যদিও বোর্ড কর্তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, পর-পর দু’টি মেয়াদ কখনও কোনও প্রেসিডেন্টই পাননি। এ রকম নজির বোর্ডের ইতিহাসে নেই। পরিস্থিতির পাকে পড়ে সেই বিধান মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই তাঁর। তবে খোলাখুলি মত প্রকাশ করতে পারলে নিশ্চয়ই বলে উঠতেন, ‘‘এ তো সেই শ্বেতাঙ্গ ম্যাচ রেফারিদের মতো বিচার হল। দোষ করত সবাই, শাস্তি পেতাম আমি।’’ সে দিনের মতো আজ তাঁকে রক্ষা করার জন্য কোনও জগমোহন ডালমিয়াও আর বেঁচে নেই! যে ওয়াংখেড়ে এক সময় তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিত, সেখানেই লেখা হয়ে থাকল বোর্ড প্রশাসনের বিদায়গাথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy