সাজঘরে শামিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন মোদী। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল এই ছবিই। ছবি: টুইটার।
সোমবার দেশের এক ক্রিকেট ইতিহাসবিদ রসিকতা করে বলেছেন, ‘‘রবিবার আমদাবাদে অস্ট্রেলিয়া ভারতীয় গণতন্ত্রের হয়ে ব্যাট করেছে!’’
প্রাথমিক ভাবে শুনে মনে হতে পারে, রসিকতা! আসলে রসিকতাও নয়। বিশ্বকাপ ফাইনালের চিত্রনাট্য তৈরি ছিল। ম্যাচের আগে মোতেরার আকাশে ভারতীয় বায়ুসেনার ‘সূর্যকিরণ’ দলের প্রদর্শনী। দুই ইনিংসের মাঝে নামীদামি বলিউডি গায়কদের গান, আতশবাজি আর লেজ়ারের ঝলকানি। শেষ প্রহরে তাঁর আগমন এবং বিজয়ী দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়া। কারও কোনও সন্দেহ ছিল না যে, ভারতই ট্রফি নিয়ে যাবে। গোটা দেশ তো বটেই, তাঁরও নয়। তাঁর নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে তাঁরই সামনে ট্রফি নিয়ে যাবে অন্য দেশ, এমনটা আবার হয় নাকি!
আগামী বছর লোকসভা ভোট। যে ভোটে তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন তিনি। তার আগে তাঁর কাছে ‘তুরুপের তাস’ ছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এশিয়াডে ১০০ পদক আনার লক্ষ্য সফল। সঙ্গে চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযানের সফল অবতরণ। দেশের মাটিতে আয়োজিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্য। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া, উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির উদ্দেশে কড়া বার্তা রাখার সুযোগ। তাঁর শাসনাধীন ভারত ক্রিকেটদুনিয়া শাসন করলে অবিসংবাদিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হত নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর। প্রশাসক হিসেবে তিনি আরও বেশ কয়েক কদম এগিয়ে যেতেন লোকসভা ভোটের আগে।
ধুরন্ধর রাজনীতিক মোদী বিলক্ষণ জানেন, ক্রিকেট এ দেশে ধর্মের মতো। ক্রিকেটারেরা পূজিত হন ঈশ্বররূপে। ক্রিকেটবিশ্বে ভারতীয় বোর্ড আর্থিক ভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী। বিশ্বক্রিকেটের মোট লাভের ৮০ শতাংশ আসে ভারত থেকেই। কোটি কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি হয় আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব। যে ক্রোড়পতি লিগে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকেন পৃথিবীর তাবড় ক্রিকেটারেরা। ক্রিকেটের সঙ্গে, ক্রিকেটকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে-থাকা আবেগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ মোদী সরকার হাতছাড়া করতে চায়নি। প্রতিযোগিতার সবচেয়ে সেরা দু’টি ম্যাচ রাখা হয়েছিল আমদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে। ভারত-পাকিস্তান এবং ফাইনাল। পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দিয়ে চিত্রনাট্যের প্রথম ভাগ সফল করেছিল ‘টিম ইন্ডিয়া’। টানা ১০টি ম্যাচ জিতে গোটা দেশের প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে ফাইনালে উঠেছিল রোহিতের ভারত। গোটা দেশ ধরে নিয়েছিল, বিশ্বকাপ আসছেই। আর সেই কাপ ভারতীয় অধিনায়কের হাতে তুলে দেবেন ‘দেশের সর্বাধিনায়ক’। বিজেপি তাল ঠুকে বলবে, ‘‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়!’’ মোদী থাকলে সবই সম্ভব!
নীল জার্সির দলের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেবেন বলে প্রধানমন্ত্রী পরিচিত চুড়িদার-কুর্তার উপরে চাপিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় দলের জার্সির নীল রঙে রাঙানো হাতকাটা জ্যাকেট। গলায় সেই নীল রঙেরই উত্তরীয়। তাতে গেরুয়া পাড় (মোদীকে যাঁরা ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন, তাঁরা জানেন, পোশাকের রঙের বিষয়ে তাঁর যেমন খুঁতখুঁতানি আছে, তেমনই আছে নিজস্ব মতামতও। অনুষ্ঠানের মেজাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পোশাকের রং নির্বাচন করে থাকেন তিনি)। এক ঝলকে দেখলে ভারতের বিশ্বকাপ জার্সির সঙ্গে অদ্ভুত মিল! বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো মহামঞ্চে বিশ্বজয়ী দেশজ ক্রিকেটারদের হাতে ট্রফি তুলে দিয়ে তাঁদের এবং গ্যালারির নীল তরঙ্গের সঙ্গে নীল সমুদ্রে মিশে যাওয়ার অপেক্ষা শুধু।
চিত্রনাট্য মেলেনি।
প্রায় ফাঁকা নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে মোদীকে ট্রফি তুলে দিতে হল হলুদ জার্সিধারীদের অধিনায়কের হাতে। সঙ্গী অস্ট্রেলিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী রিচার্ড মার্লেস। অসি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ট্রফি তুলে দেওয়ার পরেই মার্লেসকে নিয়ে দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ফাঁকা মঞ্চে বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সদ্য বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কামিন্স।
রবিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী মোদী স্টেডিয়ামে পৌঁছন। কিছু ক্ষণ পরেই দর্শকাসনে তিনি। তবে কর্পোরেট বক্সে নয়, সাধারণ দর্শকাসনে। এক পাশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অন্য পাশে অমিত-তনয় তথা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি জয় শাহ। তবে মোদী স্টেডিয়ামে ঢোকার আগেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু বাকি ছিল, তা-ও শেষ হয়ে গেল দ্রুত। ভারতের হার নিশ্চিত— এমন উৎকণ্ঠা এবং হতাশার সময়েও দর্শকদের দিকে হাত নেড়েছেন মোদী।
পুরস্কার বিতরণের পালা মেটার পর সটান ভারতীয় দলের মুহ্যমান সাজঘরে চলে যান মোদী। তার আগেই তাঁর ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডল থেকে পোস্ট করা হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে বলবর্ধক মন্তব্য। দৃশ্যতই ভেঙে-পড়া ক্রিকেটারদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। একে একে তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান। আর বুকে জড়িয়ে ধরেন বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সফলতম বোলার মহম্মদ শামিকে। ভারতের জোরে বোলার মুখ গুঁজে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বুকে আর প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিঠে রাখছেন সান্ত্বনার বরহস্ত— ছবি উঠল ঝপাঝপ।
সোমবার যে ছবিটি পোস্ট করে শামি তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, “রবিবার দিনটা আমাদের ছিল না। গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে আমাদের পাশে থেকে সমর্থন করার জন্যে সমস্ত ভারতবাসীকে ধন্যবাদ। সাজঘরে এসে আমাদের চাঙ্গা করে তোলার জন্যে আলাদা করে ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। আমরা ঘুরে দাঁড়াবই।” প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি পোস্ট করেছেন রবীন্দ্র জাডেজাও। ঘটনাচক্রে, যাঁর স্ত্রী রিভাবা মোদীর রাজ্য গুজরাতে মোদীর দল বিজেপির বিধায়ক।
কিন্তু যাবতীয় মনোযোগ এবং নজর কাড়ছে মোদীর বুকে শামির ছবি। দুষ্টু লোকেরা বলছেন, মুসলিম ধর্মাবলম্বী শামিকে ওই ভাবে জড়িয়ে ধরে মোদী কি আলাদা কোনও ‘বার্তা’ দিতে চাইলেন? তবে সে কটাক্ষ উড়িয়ে দিচ্ছেন বিজেপির লোকজন। তাঁদের কথায়, শামি এ বার ভারতের হয়ে দুর্ধর্ষ পারফর্ম করেছেন। প্রথম চারটি ম্যাচ না-খেলেও এ বারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তিনিই। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাপ অধরাই থেকে গেল তাঁর। শামির সেই অপ্রাপ্তি অনুভব করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই তাঁকেই সবচেয়ে বেশি সান্ত্বনা দিয়েছেন। এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন এবং হাস্যকর।
চিত্রনাট্য অযাচিত মোচড়ে ঘুরে যাওয়ায় মোদীই কি ব্যাট হাতে নামলেন? ক্রিকেট ইতিহাসবিদ কী বলবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy