জুটি: রবিবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জাডেজা, কুলদীপের ঘূর্ণিকে অস্ত্র করে এগোতে চায় ভারত। —ফাইল চিত্র।
দৃশ্য ১: গলি-ঘুপচির মতো এক হাজারের কাছাকাছি পথ। ৪৮৯টি অবিকল একই রকম দরজা। কোনটা দিয়ে ঢুকেছেন, কোনটা দিয়ে বেরোবেন, কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই।
লখনউয়ে দাঁড়িয়ে এমন বর্ণনা একটা জিনিসেরই তো হতে পারে। একদম ঠিক ধরেছেন। ভুলভুলাইয়ার কথাই বলছি।
দৃশ্য ২: এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘাস। নিজেদের দেশের কোচ এসে প্রথমে সে দিকে এগোলেন। হন্তদন্ত হয়ে যিনি ছুটে এলেন, বুঝতে বাকি রইল না ওই আয়তক্ষেত্রের তিনিই প্রধান রক্ষক। এ বার ভারতীয় কোচ কিছু বললেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গ্রাস কাটারের আবির্ভাব এবং সবুজ ওড়ানো শুরু।
লখনউয়ের ভারতরত্ন শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী একানা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপের বাজারে আর কিসের বর্ণনা হতে পারে? একদম ঠিকই ধরেছেন। বাইশ গজের কথাই বলছি।
একটু আগে লখনউয়ের বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর সময় দেখা গেল, বাইরেটায় বেশ ভিড়। দুপুর-দুপুর এত মানুষ কীসের অপেক্ষায়? জিজ্ঞেস করায় জবাব এল, ‘‘টিম আ রহা হ্যায় টিম।’’ টিম? ভারতীয় দল তো আগেই এসে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে অনুশীলনও শুরু করে দিয়েছে। রোহিত, বিরাটদের নেটে বল করতে দেখে তীব্র চর্চাও শুরু হয়েছে যে, হার্দিক পাণ্ড্যর অভাবে এ বার কি তা হলে ওঁরাও ম্যাচেও হাত ঘোরাবেন? তা হলে জনতা কার অপেক্ষায়? উত্তর এল, ইংল্যান্ড।
বিস্মিত হওয়ার মতোই ব্যাপার। ইংল্যান্ড? যারা কি না পাঁচটার মধ্যে চারটেতে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের মুখে? তাদের জন্য দাঁড়িয়ে জনতা? অক্টোবরের শেষের দিকে এখানে ঠান্ডার পরশ লেগেছে এমনও নয়। বরং উড়ান নামতেই পাইলটের ঘোষণা, বাইরের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (যদিও রাতের দিকের আবহাওয়া বেশ মনোরম)। আইসিসি প্রত্যেক কেন্দ্রে টিকিট কাউন্টারের নাম দিয়েছে বক্সঅফিস। সেখানে বিদেশি দলগুলির মধ্যে সব চেয়ে হিট হওয়ার কথা ছিল ইংল্যান্ডের। যাদের মনে করা হচ্ছিল, এই মুহূর্তে সাদা বলের অবিসংবাদী শাসক। ২০১৯ পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিজয়ী। এ বারেও প্রচণ্ড শক্তিশালী দল নিয়ে এসেছিল। কী দুর্ধর্ষ ব্যাটিং! জস বাটলার, দাভিদ মালান, জো রুট, জনি বেয়ারস্টো, বেন স্টোকস, লিয়াম লিভিংস্টোন, মইন আলি! সবাই বলছিল, কাপ নিয়ে যাবে। তারা যে বিশ্বকাপের চৌকাঠেই এমন মুখ থুবড়ে পড়বে, কে জানত। বিবিসি দেখলাম শ্রীলঙ্কা ম্যাচ হারার পরে লিখে দিয়েছে, ‘‘ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ স্বপ্ন মৃত্যুমুখী। অতীতের দুর্ধর্ষ এক দলের মাথার উপরে শকুনদের ঘুরতে দেখা যাচ্ছে।’’ মনে করিয়ে দেবে সেই অমর উক্তি। যার থেকে অ্যাশেজ় ক্রিকেট যুদ্ধের উৎপত্তি। ১৮৮২-তে ইংল্যান্ডের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্ট জয়ের পর ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘স্পোর্টিং টাইমস’ লিখেছিল, ‘‘মৃতদেহ এখানে কবর দেওয়া হবে, চিতাভস্ম নিয়ে যাওয়া হবে অস্ট্রেলিয়ায়।’’ ১৪১ বছর পরে যেন সেই অপমান, যন্ত্রণা ফিরে এসেছে।
এমনিতে চলতি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের কোচ কে, প্রশ্ন করে যদি ঘোষণা করা হয় সঠিক উত্তরদাতাকে ইডেনে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের টিকিট উপহার দেওয়া হবে, তা হলেও কেউ বলতে পারবে না। ম্যাথু মটের ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতা বলতে ৬৬টি প্রথম শ্রেণি এবং ২৪টি ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচ। কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচে নামেননি। খেলেছেন কোন কোন দলের হয়ে? নেদারল্যান্ডস, কুইন্সল্যান্ড, ভিক্টোরিয়া। অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেট দলের সঙ্গে ছিলেন সাত বছর। কেকেআরে সহকারী হয়ে এসেছিলেন দু’বছরের জন্য। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ইংল্যান্ড ক্রিকেটের উপরে এমন বজ্রপাতের পরে মটের চাকরি ‘নট’ না হলে বিশ্বকাপের সেরা অঘটন হবে। শেষবেলায় তিনি যেটা করতে পারেন, টিমকে ভুলভুলাইয়া ঘোরাতে নিয়ে যেতে পারেন। তা দেখে যদি বাটলার, স্টোকসদের মনে হয়, কুলদীপ যাদবের থেকেও বড় গোলকধাঁধা এই পৃথিবীতে আছে। আর তাতে যদি লড়াই করার মনোবল সম্যক ফেরত আসে।
শুরুতে বলা দৃশ্য নম্বর দুই মনে পড়ায় আবার মনে হচ্ছে, মটের অত কষ্ট করার দরকার নেই। দ্রাবিড়ের নির্দেশে যে ভাবে পিচ নিয়ে কারুকাজ শুরু হল, তাতে লখনউয়ের বাইশ গজেই ভুলভুলাইয়া দেখা হয়ে যেতে পারে ইংল্যান্ডের। এখানে দু’টি ম্যাচ হয়েছে এখনও পর্যন্ত। একটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা তিনশোর উপরে তুলেছে। দারুণ কিছু ঘুর্ণিঝড় উঠতে দেখা যায়নি। কিন্তু অন্য ম্যাচ আর ভারত খেলার মধ্যে বিস্তর তফাত রয়েছে। কুলদীপ যাদবকে আইপিএলে খেলে অভ্যস্ত হতে পারেন বাটলারেরা। কিন্তু তাঁদের সেই ছন্দই তো দেখা যাচ্ছে না। এখানে কুলদীপকে তাঁরা খেলতে নামছেন অনেক কম্পমান অবস্থায়।
শুভমন গিলকে শুক্রবার ভারতীয় অনুশীলনে দেখে মনে হল, ততটাই চেগে আছেন। ডেঙ্গি যে শুরুর দিকটা কেড়ে নিয়েছে, তা সুদে-আসলে বুঝে নিতে চান। দীর্ঘক্ষণ নেটে ব্যাট করলেন। এক নাগাড়ে শর্ট বলের বিরুদ্ধে অনুশীলন করে গেলেন। ইংরেজ পেসারদের জন্য মনে-মনে যেন স্টান্স নিয়েই ফেলেছেন। কিন্তু আরও এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষ আছে তাঁর— ডেঙ্গির মশা!
জোর আলোচনা শুরু হয়েছে, রোহিতদের তিন স্পিনারে নামা উচিত কি না। ভারতের পনেরো জনের দল যখন ঘোষণা করা হল আর অশ্বিন তাতে জায়গা পেলেন, এক প্রভাবশালী ব্যক্তির পূর্বাভাস ছিল, ‘‘আর কোথাও না হোক, দু’টো ম্যাচে অশ্বিনকে খেলানো হবেই। সেই কারণেই ওকে নেওয়া। চেন্নাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আর লখনউয়ে ইংল্যান্ড।’’ সমস্যা হচ্ছে, তখন জানা ছিল না হার্দিক পাণ্ড্য এমন ভাবে চোট পেয়ে ছিটকে যেতে পারেন আর তাতে প্রথম একাদশের পুরো নকশাটাই এত পাল্টে যেতে পারে। এখন যা পরিস্থিতি, সূর্যকুমার যাদব বা ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান খেলাতেই হবে। মহম্মদ শামি পাঁচ উইকেট নেওয়ার পরে তাঁকে বসানো হলে বুঝতে হবে বর্তমান টিম ম্যানেজমেন্ট শাইলকের চেয়েও বেশি নির্মম, নির্দয়। তা হলে? একমাত্র সমাধান হতে পারে, মহম্মদ সিরাজকে বসিয়ে অশ্বিনকে নিয়ে আসা। সে ক্ষেত্রে তিন স্পিনার, দুই পেসারে খেলবে দল। লখনউয়ে এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপের তিনটি ম্যাচ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই স্পিনার কেশব মহারাজ ও তাবরেজ় শামসি দু’টি করে উইকেট নেন। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জ়াম্পার ঘূর্ণিতে ভেঙে পড়েছিল শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং। চারটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের স্পিনার আরিয়ান দত্ত তিনটি উইকেট নিয়েছিলেন। যদিও ভারতের স্পিন শক্তির সঙ্গে বাকি দলগুলির গুণগত মানের অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে।
কারও কারও মনে হচ্ছে, তাতে ক্ষতি কী? মহম্মদ শামি বা অশ্বিনকে যদি মুখের উপরে বলা যায়, তুমি কাল খেলছ না, তা হলে সিরাজকে বলা যায় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy