জেমস অ্যান্ডারসন। —ফাইল চিত্র।
লর্ডস। ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ২০০৩ সালের ২২ মে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল ২১ বছরের এক তরুণের। সেই মাঠেই ১২ জুলাই, ২০২৪ জীবনের শেষ টেস্ট খেললেন ৪১ বছরের সেই জোরে বোলার। জেমস অ্যান্ডারসনের ক্রিকেটজীবনের শুকনো এই তথ্যের আড়ালে রয়েছে ৭০৪টি উদ্যাপন।
প্রথম এবং শেষ টেস্ট একই মাঠে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, অ্যান্ডারসনের টেস্টজীবনের সরণ শূন্য। শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন প্রতিভাবান তরুণ। শেষও করবেন শূন্যতা তৈরি করে। ২১ বছরের যাত্রায় নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, তাঁর অভাব অনুভূত হতে বাধ্য। ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ হবে। ফাঁকা থাকা সম্ভব নয় বলে। আর একটা জেমস মাইকেল অ্যান্ডারসন তৈরি হবে না। ক্রিকেটের অভিমুখই হয়তো হতে দেবে না।
দ্বিতীয় কপিল দেব, ইমরান খান, ইয়ান বথাম, অ্যালান ডোনাল্ড যেমন তৈরি হয়নি, তেমনই হয়তো আর একটা অ্যান্ডারসন হবে না। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল ক্রিকেটকে বিশ্বজনীন করে তুলতে সাদা বলের ক্রিকেটকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে। সরাসরি বললে, ২০ ওভারের ক্রিকেটকে রংচঙে বিনোদনের মোড়কে পরিবেশন করা হচ্ছে বিশ্বের সামনে। টাকার থলি নিয়ে ক্রিকেটারদের পিছনে ছুটছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলি। টেস্টকে রাখা হয়েছে অনেকটা সংরক্ষণ করে। ক্রিকেটের কৌলীন্য বজায় রাখতে। প্রচার, অর্থ, জনপ্রিয়তা নেই। ছোট ছেলেমেয়েরাও এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার হতে চায়। ক্রিকেটজীবনের মধ্যগগনে সাদা বলের ক্রিকেটকে দূরে ঠেলে পাঁচ দিনের লাল বলের লড়াইকে আপন করে নেবে কে! তাই আর একটা অ্যান্ডারসন পাওয়া কঠিন।
ল্যাঙ্কাশায়ারের বার্নলের বাসিন্দা ৬ ফুট ২ ইঞ্চির অ্যান্ডারসন কেমন ক্রিকেটার? পরিসংখ্যান বলছে শেষ বার মাঠে নামার আগে ১৮৮টি টেস্ট, ১৯৪টি এক দিনের ম্যাচ এবং ১৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। যথাক্রমে উইকেট নিয়েছেন ৭০৪টি, ২৬৯টি এবং ১৮টি। মোট ৯৮৭ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত উইকেট আর কোনও জোরে বোলারের নেই। দ্বিতীয় স্থানে আছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন জোরে বোলার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়েছেন ৯৪৯টি উইকেট। শুধু টেস্ট ক্রিকেট ধরলে ম্যাকগ্রার উইকেট ৫৬৩। তিনিও লাল বলের ক্রিকেটকে অ্যান্ডারসনের মতো গুরুত্ব দেননি। গত মার্চে ধর্মশালায় ভারতের বিরুদ্ধে খেলা অ্যান্ডারসনের শেষ টেস্ট ছিল তাঁর জীবনের ৪০০তম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। দেশের হয়ে ৪০১টি ম্যাচ খেলে অবসর নিলেন জিমি। বিশ্বের প্রথম জোরে বোলার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে ৪০ হাজার বল করার মাইলফলকও স্পর্শ করেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটকে কেন এত গুরুত্ব দিয়েছেন অ্যান্ডারসন? তাঁর কথায়, ‘‘টেস্ট ক্রিকেট একজন ক্রিকেটারের দক্ষতার পরীক্ষা নেয় এবং তার প্রকৃত চরিত্রকে প্রকাশ করে।’’ তাঁর এই কথা থেকে পরিষ্কার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে পরীক্ষায় বসানোর সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিলেন। দেশের হয়ে শেষ বার সাদা বলের ক্রিকেট খেলেছেন ২০১৫ সালে। শেষ ন’টা বছর বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনের দ্বিতীয়ার্ধে কেবল পরীক্ষা দিয়েছেন। নিজের ক্রিকেটীয় দক্ষতার প্রতি নিখাদ বিশ্বাস, ভরসা না থাকলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়।
অ্যান্ডারসন সাহস দেখাতে পেরেছেন। সারা বিশ্বের সব দেশের ব্যাটারদের সমীহ আদায় করতে পেরেছেন। তবু ব্যক্তিগত অর্জন নিয়ে মাথা ঘামাননি কখনও। অ্যান্ডারসনের কথায়, ‘‘ব্যক্তিগত কীর্তি নিয়ে অবসরের আগে ভাবতে চাই না। যত দিন খেলব, দলই আমার কাছে প্রথম এবং শেষ। দলের সাফল্যই একমাত্র লক্ষ্য।’’ এই দর্শন না থাকলে দলগত খেলায় দলের মধ্যে থেকেও ব্যতিক্রম হওয়া যায় না।
অ্যান্ডারসন নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলার। অথচ ইংল্যান্ডের নির্বাচকেরা কখনও তাঁর নাম লিখে নিয়ে এসে দল নির্বাচন করতে বসেননি। ইংল্যান্ড দলে কখনও স্বাভাবিক পছন্দ ছিলেন না। হলে তাঁর ঝুলিতে আরও অন্তত ৫০-৬০টা আন্তর্জাতিক উইকেট থাকত। ফর্মে না থাকলে বাদ পড়েছেন। কাউন্টি ক্রিকেট (ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট) খেলে, দক্ষতায় শান দিয়ে আবার জাতীয় দলে ফিরেছেন। শুধু অ্যান্ডারসন বলেই ম্যাচের পর ম্যাচ খেলিয়ে তাঁর ফর্মে ফেরার জন্য অপেক্ষা করে থাকেনি ইংলিশ ক্রিকেট। ক্রিকেটজীবনে প্রশংসিত হয়েছেন। সমালোচিতও কম হননি।
২০০২ থেকে ২০২৪। প্রায় ২২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন একজন জোরে বোলারের! অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব। কী ভাবে সম্ভব? অ্যান্ডারসন এক বার বলেছিলেন, ‘‘ধারাবাহিক ভাবে নিজেকে ক্রিকেটার হিসাবে উন্নত করার চেষ্টা করি। বোলিংয়ের বৈচিত্রই বৃদ্ধির চেষ্টা করি। উন্নতির এই প্রক্রিয়া আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’ সচিন তেন্ডুলকর বলেছেন, ‘‘এক জন জোরে বোলার দু’দশক ধরে খেলছে এবং ৭০০ টেস্ট উইকেট নিয়েছে— বিষয়টা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু অ্যান্ডারসন এটাকে বাস্তব করে দেখিয়েছে।’’ অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেছেন, ‘‘সেরা ফর্মে না থাকা অ্যান্ডারসনও প্রতিপক্ষের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।’’ ঠিক এই জায়গাতেই বাকিদের থেকে আলাদা অ্যান্ডারসন। তিনি ২২ গজের লড়াইয়ে থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে নিয়ে গদগদ মতামত দেন না প্রতিপক্ষেরা। সমীহ করেন না, এমন প্রতিপক্ষ খুঁজে পাওয়াও কঠিন। কারণ বিশ্বের সব প্রান্তে লাল এবং সাদা বলের ক্রিকেটে সাফল্য পেয়েছেন তিনি।
অ্যান্ডারসন আসলে আধুনিক ক্রিকেটের একটি যুগের নাম। যে যুগে তুলির শেষ টানটাই শুধু বাকি ছিল। এই যুগে ইংরেজদের ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করা হয়নি ঠিকই। আবার হিসাবের বাইরেও রাখা যায়নি। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে কেভিন পিটারসেন, মন্টি পানেসর, মইন আলি, বেন স্টোকস, জোনাথন ট্রট, ম্যাট প্রায়র, অইন মরগ্যান, ফিল সল্ট, জোফ্রা আর্চারের মতো বিদেশি বংশোদ্ভূত ক্রিকেটারদের দাপটের যুগে অ্যান্ডারসন উজ্জ্বলতম ইংরেজ। তবু ৭০৪ উইকেটের মালিকের টেস্টজীবনের সরণ শূন্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy