স্বপ্না বর্মন। —ফাইল চিত্র
পাঁচ বছর আগে এশিয়ান গেমসের হেপ্টাথলনে দাঁতের অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করে সোনা ছিনিয়ে এনেছিলেন জলপাইগুড়ির রাজবংশী পরিবারের এই মেয়ে। জাকার্তায় তুলে ধরেছিলেন ভারতের জাতীয় পতাকা। চলতি এশিয়ান গেমসে একটুর জন্য পদক হাতছাড়া হল স্বপ্না বর্মনের। চোট সারিয়ে ফিরে আগের ছন্দ এখনও পাননি। শেষ পর্যন্ত লড়ে মাত্র ৪ পয়েন্টের জন্য ব্রোঞ্জ জিততে পারলেন না তিনি। চতুর্থ স্থানে শেষ করতে হল তাঁকে। অথচ তিন বছর আগে খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন স্বপ্না। মানসিক অবসাদ গ্রাস করেছিল তাঁকে।
তিন বছর আগে একটি সাক্ষাৎকারে স্বপ্না বলেছিলেন, ‘‘আমার শরীর আর সায় দিচ্ছে না। মানসিক ভাবেও আমি বিপর্যস্ত। মোটামুটি ঠিক করে নিয়েছি আমি আর খেলব না। তবে কিছুটা দোলাচলে রয়েছি। কলকাতায় ফিরে সিদ্ধান্ত জানাব।’’ শুধু চোট নয়, কোভিডের কারণে অনুশীলন করতে না পারায় অবসাদে ভুগছিলেন স্বপ্না। কিন্তু ছাত্রীকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেননি কোচ সুভাষ সরকার। আগলে রেখেছেন স্বপ্নাকে। ছাত্রীর অবসরের কথা শুনে কোচ বলেছিলেন, ‘‘ও খুব আবেগপ্রবণ মেয়ে। আবেগে কিছু বলে ফেলেছে। ও খেলা ছাড়ছে না। গত দু'বছরে ঠিক করে অনুশীলন করতে পারেনি। সেই কারণে কিছুটা হতাশা গ্রাস করেছে। সঙ্গে চোটের সমস্যা অবশ্যই রয়েছে। তবে খেলা ছাড়ার ব্যাপারটা ঠিক নয়। আমি কথা বলেছি ওর সঙ্গে। কলকাতায় ফিরলে আবার কথা হবে।’’ নিজের কথা রেখেছেন সুভাষ।
স্বপ্নার বাবা রিকশা চালাতেন। তিনি স্ট্রোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় মা চা-বাগানে কাজ করে চালাতেন সংসার। অ্যাথলিট হয়ে ওঠার পথে পেরতে হয়েছে অজস্র বাধা। আর্থিক সমস্যা বার বার সামনে ছুড়ে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ। তা পার করে এশিয়াডের হেপ্টাথলন ইভেন্টে প্রথম ভারতীয় হিসেবে জিতেছিলেন সোনা। গড়েছিলেন নজির। হেপ্টাথলনের সাতটি ইভেন্টের মধ্যে দৌড়ের ইভেন্টগুলিতে সমস্যা হত স্বপ্নার। কারণ, তাঁর দু’পায়ে ছ’টি করে ১২টি আঙুল রয়েছে। সেই সমস্যার মোকাবিলা করেই সোনা জিতেছিলেন তিনি। জাকার্তা এশিয়াডের পরে জার্মানির একটি খেলার সরঞ্জাম তৈরির সংস্থা স্বপ্নার জন্য বিশেষ জুতো তৈরি করেছে। সেটা পরে অনেক সুবিধা হয়েছে তাঁর।
গত বার সোনা জেতার পরে বাড়ি ফিরে জলপাইগুড়ির পাতকাটার ঘোষপাড়ায় নিজের এলাকাতেই স্বপ্নাকে শুনতে হয়েছে কটূক্তি। সহ্য করতে হচ্ছে অপমান। দেশের হয়ে গৌরব আনার পর এটাই কি প্রাপ্য, স্বপ্না প্রশ্ন করছেন নিজেকেই। আনন্দবাজার অনলাইনকে সোনার মেয়ে বলেছিলেন, “আমাকে এখানে তো অনেকে এটাও বলেছে যে, এ সব মেডেল-ফেডেল তো কিনেও আনা যায়! ভাবা যায়!” খানিকটা হাসিই ভেসে এসেছিল। তবে তা যে যন্ত্রণার, সেটা বোঝা গিয়েছিল পরের কথায়, “আমি শুধু ভাবলাম, এগুলোও নাকি কেনা যায়। এতই সোজা! আদৌ আমি কলকাতায় প্র্যাকটিস করছি কিনা, সেটা নিয়েও বলছে কেউ কেউ। আমি তাঁদের নাম জানাতে চাইছি না। কিন্তু এগুলো বলা হচ্ছে। এই কথাটা কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে, আপনারাই ভাবুন।” সেই কটূক্তির বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে স্বপ্নাকে।
এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী এই হেপ্টাথলিট ২০২০ সালের মার্চ মাসে লকডাউনের আগে কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গের বাড়িতে ফিরেছিলেন। ভেবেছিলেন সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তখন অনুশীলনের জন্য কলকাতায় ফিরবেন। কিন্তু তা হয়নি। তাই জলপাইগুড়ির বাড়িতেই আটকে পড়েন স্বপ্না। বাড়ি থেকেই তিনি বলেন, ‘‘একে ভাইরাসের সংক্রমণ। তার উপরে বৃষ্টি হওয়ায় এলাকার মাঠ জলে ভাসছে। ফলে অনুশীলনটাও ঠিক করে হচ্ছে না।’’ যোগ করেন, ‘‘আরও একটা এশিয়ান গেমসের সোনা পেতে চাই হেপ্টাথলনে। জানি না সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না। আগামী বছর এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড-সহ কয়েকটি বড় প্রতিযোগিতা রয়েছে। এখন তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাড়ার মাঠ শুকনো থাকলে সেখানে দৌড়, ফিজিক্যাল ট্রেনিং করছি।’’ এশিয়াডে পদক পাননি স্বপ্না। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাঁর। কিন্তু তার মধ্যেই আবার নতুন করে লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy