১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে রুপোজয়ী এষা সিংহ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
এশিয়ান গেমসের আসরে শুটিংয়ে ভারতের সব থেকে ভাল ফল ছিল ২০০৬ সালে। সে বার ভারতের শুটারেরা তিনটি সোনা-সহ মোট ১৪টি পদক জিতেছিলেন। এ বারের গেমসে সেই নজিরকে ছাপিয়ে গিয়েছেন ভারতীয় শুটারেরা। বুধবার পর্যন্ত মোট ১৮টি পদক এসেছে ভারতীয়দের ঝুলিতে। তার মধ্যে সোনার সংখ্যা ছ’টি। অথচ ২০২০ সালের টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় শুটারদের ঝুলি ছিল শূন্য।
মাত্র তিন বছরে এই সাফল্য কী ভাবে? শুটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এর মধ্যে কোনও জাদু নেই। শুটিং এমন একটা খেলা, যাতে ফাইনালে উঠলে যে কেউ পদক জিততে পারে। আবার মাত্র একটা খারাপ শট এক জন প্রতিযোগীকে প্রথম থেকে শেষ স্থানে নামিয়ে দিতে পারে। ভারতীয়দের কাছে শুটিং অপরিচিত খেলা নয়। পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই। বলা যেতে পারে ক্রিকেট, ফুটবলের থেকেও শুটিংয়ের পরিচিতি এগিয়ে। শুনতে অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি। গ্রামে, মফস্বলে সারা বছর বিভিন্ন উৎসবের সময় যে মেলা বসে, সেখানে থাকে বেলুন ফাটানোর স্টল। ছোট বয়সে প্রায় সকলেই মেলায় গিয়ে এক দু’বার বেলুন ফাটায়। সেটাই শুটিংয়ের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়। সেখান থেকে শুটিং নিয়ে প্রাথমিক আগ্রহ তৈরিও হয় অনেকের।
মেলায় বেলুন ফাটানোর সঙ্গে এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক্স বা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে পদক জয়ের সম্পর্ক নেই। দুই ক্ষেত্রের আলোকবর্ষ দূরত্ব। ২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক্সে অভিনব বিন্দ্রার সোনা জয় শুটিং নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল আগ্রহ তৈরি করেছিল। এখনকার সাফল্যে সেই আগ্রহের কিছুটা সুফল নিশ্চই রয়েছে। বিন্দ্রার সাফল্যের বেশির ভাগটাই ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ। তবু তাঁর সাফল্য চোখ খুলে দিয়েছে সাধারণ মানুষের। কেন্দ্রীয় এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের। চোখ খুলে যাওয়াতেই ভারতীয় শুটারদের গুলি আরও বেশি করে পৌঁছাচ্ছে বুলস আইতে।
বিন্দ্রার আগে শুটিংয়ে ভারতীয়েরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক জিততেন না এমন নয়। ১৯৬২ সালে কার্নি সিংহ প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতেছিলেন। পয়েন্ট সমান হলেও তাঁকে রুপোর পদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা এশিয়ান গেমসেও পদক রয়েছে তাঁর। পাঁচটি অলিম্পিক্সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। কার্নি ছিলেন বিকানেরের মহারাজা। শুটিং একটা সময় পর্যন্ত রাজা-মহারাজাদের খেলা বলেই পরিচিত ছিল। কারণ শুটিংয়ের জন্য প্রয়োজন হয় বিপুল বিনিয়োগ। যে খরচ উচ্চবিত্ত পরিবার ছাড়়া বহন করা সম্ভব হয় না। তাই একটা সময় পর্যন্ত অসংখ্য প্রতিভা অজান্তেই হারিয়ে যেত।
বিন্দ্রার সোনা সেই ধারনার পরিবর্তন করেছে। শুটিং এখন প্রায় আমজনতার খেলা হয়ে উঠেছে। ক্রিকেট, ফুটবলের মতো পাড়ায় রাস্তায় বা পার্কে হয়তো খেলা যায় না। তবে খেলার জায়গার অভাবও নেই। খোঁজ করলেই পাওয়া যায়।
সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে গোটা দেশে কয়েকশো শুটিং অ্যাকাডেমি রয়েছে। যার ৯০ শতাংশই তৈরি হয়েছে গত ১৫-১৬ বছরে। যেগুলি ছড়িয়ে রয়েছে মাঝারি, ছোট শহরে। কিছু গ্রামাঞ্চলেও। এই অ্যাকাডেমিগুলি প্রতি বছর বহু নতুন প্রতিভার হদিশ দিচ্ছে। তাদের তুলে আনার খরচের একটা বড় অংশ বহন করছেন অ্যাকাডেমিগুলির কর্তারা। তাতে প্রাথমিক পর্বে খেলা শেখার খরচ কিছুটা কমেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও আসছে শুটিংয়ে। গত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছিল প্রায় ১৫ হাজার শুটার। দেশে এখন নথিভুক্ত শুটারের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। আর সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ।
বিন্দ্রার সাফল্য সাধারণ মানুষের চোখ যেমন খুলেছে, তেমনই সচেতন হয়েছে সরকারও। একটা সময় পর্যন্ত এয়ার গান এবং এয়ার পিস্তল আমদানি করা যেত না। কেন্দ্রীয় সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। দেশের সেরা ২৫ জন শুটার শুধু আমদামি করতে পারতেন অনুমতি পেলে। তাও নিশ্চিত ছিল না। বছর ১০ আগে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এখন জাতীয় সংস্থায় নথিভুক্ত যে কোনও খেলোয়াড় চাইলেই বিদেশ থেকে এয়ার গান এবং এয়ার পিস্তল আনাতে পারেন। আলাদা করে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এতে বিশ্বমানের বন্দুক সহজেই হাতে পাচ্ছেন শুটারেরা। পাশাপাশি, বিভিন্ন রাজ্য সরকার তৈরি করে দিয়েছে বিশ্বমানের শুটিং রেঞ্জ। মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলিতে সরকারের তৈরি করে দেওয়া রেঞ্জগুলিতে প্রায় বিনা খরচে অনুশীলনের সুযোগ পান খেলোয়াড়েরা।
শুটিং নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং সরকারি স্তরে আগ্রহ, সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিভা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে গিয়েছে অনেক। শুটিং কর্তারা বলছেন, গত পাঁচ-সাত বছরে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতাগুলি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। অলিম্পিক্স বা এশিয়ান গেমসে পদক জয়ী শুটারও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পদক তালিকায় নাও থাকতে পারেন। কারণ প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তীব্র। প্রতিটি ইভেন্টেই প্রথম ৮-১০ জনের পার্থক্য খুব সামান্য। যে কেউ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেন। যে কেউ সবার শেষে শেষ করে পারেন। কোনও শটে ০.১ পয়েন্ট কম হলেও পদকের সম্ভাবনা কমে যায় এক জন শুটারের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিভা উঠে আসাতেই এই সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
অবসর নেওয়ার পর অনেক সফল খেলোয়াড় কোচিংয়ে এসেছেন। তাতেও সুবিধা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। সর্বোচ্চ স্তরের অভিজ্ঞতা প্রথম থেকেই পাচ্ছে তারা। পরিকল্পনা তৈরি করতে সুবিধা হচ্ছে। বড় প্রতিযোগিতায় কিভাবে লড়াই করতে হয়, সেই তালিম মিলছে শুরু থেকেই। কয়েকশো অ্যাকাডেমি, সর্বাধুনিক মানের পরিকাঠামো, সরকারি সহযোগিতা, সরঞ্জাম সহজলভ্য হওয়ার মতো বিষয়গুলি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারতের শুটিংকে। বৃদ্ধি পাচ্ছে আন্তর্জাতিক পদক সংখ্যা। তা ছাড়া এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পোশাকও।
শুটিং এমন একটা খেলা, যেখানে কেউ এগিয়ে থেকে নামেন না। কেউ পিছিয়ে থেকে শুরু করেন না। সোনা জেতার দু’ঘণ্টা পরের ইভেন্টেই সবার শেষে শেষ করতে পারেন কোনও প্রতিযোগী। কারণ বন্দুক থেকে গুলি এক বার বেরিয়ে গেলে, আর কিছুই করার থাকে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এশিয়ান গেমসে সফল ভারতীয় দলই কয়েক দিন পর অন্য কোনও প্রতিযোগিতা থেকে পদকহীন অবস্থায় ফিরতে পারে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঠিক যেমন হয়েছিল গত টোকিয়ো অলিম্পিক্সে। আবার এশিয়ান গেমসে রেকর্ড সংখ্যক পদকে উচ্ছ্বাস থাকলেও বিস্ময় নেই।
সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমীরা উচ্ছ্বসিত হতেই পারেন। তার মানে এই নয় হঠাৎ করে উন্নত হয়েছে ভারতীয় শুটিং। গত ১৫-২০ বছর ধরে এগোতে শুরু করেছে। গত কয়েকটি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। উন্নতির এই ধারা বজায় রাখতে পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারত শুটিংয়ে বিশ্ব শাসন করবে। শুটিং কর্তারা আশাবাদী। খেলাটির প্রতি তাঁদের আন্তরিকতা, সদিচ্ছাই উন্নতির চালিকা শক্তি। যে কর্তাদের অনেকেই প্রাক্তন খেলোয়াড়। যাঁরা শুটিংকে ভালবাসেন। অলিম্পিক্স পদক জয়ী প্রাক্তন শুটার গগন নারাং বলেছেন, ‘‘আমাদের তরুণ ছেলে-মেয়েরা পদক জিতছে এশিয়ান গেমসে। ওদের দেখে দারুণ লাগছে। ভারতের পদকজয়ীদের গড় বয়স ক্রমাগত কমছে। ১৮-১৯ বছরের ছেলে-মেয়েরা পদক পাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্তরে। এটা ভীষণ ইতিবাচক দিক। সারা দেশ থেকে শুটার উঠে আসছে। এ বারের গেমসে কয়েক জনের পারফরম্যান্স কিছুটা হলেও অবাক করেছে। ওদের কাছে এতটা প্রত্যাশা ছিল না আমার। বড় প্রতিযোগিতার চাপ সামলাতেও শিখে গিয়েছে ওরা।’’ শুটিংয়ের নতুন প্রজন্ম নিয়ে আশাবাদী নারাং। তাঁর আশা, ভারত আগামী দিনেও প্রচুর পদক জিতবে। প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস পেয়ে গিয়েছে তরুণেরা।
তাঁর মতোই আশাবাদী জয়দীপ কর্মকার। খেলা ছাড়ার পর এক এক করে চারটি অ্যাকাডেমি তৈরি করেছেন তিনি। নিজে হাতে তৈরি করছেন খেলোয়াড়। তিনিও বিস্ময়ের কিছু দেখছেন না। ভারতীয় রাইফেল দলের প্রাক্তন কোচের বক্তব্য, ‘‘আমাদের খেলোয়াড়েরা সঠিক ভাবে কঠোর পরিশ্রম করেছে। ওদের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তার ফল পাচ্ছে। এশিয়াডে পাঁচ-ছ’জন চতুর্থ স্থানে শেষ করেছে। দু’টি বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ফল হচ্ছে। গত দু’টো অলিম্পিক্সে আমাদের ফল ভাল না হওয়ায় অনেক সমালোচনা হয়েছিল। তার পর সবাই ভাল করার চেষ্টা করেছে। এর পর প্যারিস অলিম্পিক্সেও আমরা ভাল কিছু আশা করতে পারি। যদিও এশিয়ান গেমসের থেকে অলিম্পিক্স অনেক কঠিন। বিশ্বের সব শক্তিশালী দেশ থাকবে। এশিয়ান গেমসেও চিন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ রয়েছে।’’
২০১৬ সালের অলিম্পিক্সেও শুটিংয়ে কোনও পদক জিততে পারেনি ভারত। ২০১২ সালে এসেছিল একটি রুপো, একটি ব্রোঞ্জ। ২০১৮ সালের এশিয়ান গেমসে এসেছিল দু’টি সোনা-সহ ন’টি পদক। ২০১৪ সালের গেমসে এসেছিল একটি সোনা-সহ ন’টি পদক। এ বারের সাফল্য আগের সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে। বলা যেতে পারে, এশিয়ার শুটিংয়ে ভারত এখন বড় শক্তি। বিশ্ব পর্যায়ের বড় শক্তি হওয়া আর কিছুটা সময়ের অপেক্ষা। অভিভাবকেরা সন্তানদের হাতে বন্দুক তুলে দিতেই পারেন। চলুক না কয়েক রাউন্ড গুলি! নিশানায় লাগলেই গর্বিত হবে দেশ। রাজ্য। জেলা। মহল্লা। পরিবার।
ক্রিকেট আহত হবে? বালাই ষাট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy