কোথায় রইল পড়ে ব্রহ্মপুত্র, পাহাড়, আহোম রাজ্য! আর কোথায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে, অসম্পূর্ণ এক কেল্লার মাঝখানে, ‘অপয়া’ অপবাদের ওড়না জড়িয়ে শুয়ে রইল অভিমানী এক কবর! সেখানেই তিন শতকের উপেক্ষা, অন্ধকার বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। ঢাকার পরি, ওরফে অসমের হারানো রাজকন্যা নাং সেং, ওরফে রমণী গাভরু। মোগল বাদশা অওরঙ্গজ়েবের বৌমা। যাঁকে ভারত, বাংলাদেশ— দুই দেশই আপন বলে মানে। কিন্তু বেঁচে থাকতে কার্যত কারও আপন হয়ে বেশি দিন থাকা কপালে সয়নি সে রাজকন্যের।
ভারতের ইতিহাসে বিখ্যাত নারীর তুলনায় উপেক্ষিতার সংখ্যাই বেশি। ব্যতিক্রম নয় অসমও। সেই উপেক্ষিতাদের মধ্যেই উপর দিকে থাকবে রমণী গাভরুর নাম।
ঢাকা বেড়াতে গেলে পুরনো ঢাকায় লালবাগের কেল্লা তো সকলেই ঘুরে আসেন। ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বেশি দূরেও নয়। চার পাশের দেওয়াল আর চারটি ভবন বাদে, কেল্লা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই প্রায় নেই। লালবাগ কেল্লা মোগল আমলের বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেখানে একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টিপাথর, শ্বেতপাথর আর রংবেরঙের টালি। মাজারের ন’টি কক্ষের ছাদগুলিও করবেল পদ্ধতিতে কষ্টিপাথরে তৈরি। মূল সমাধিসৌধের উপরে থাকা গম্বুজ তামার পাতে মোড়া। শোনা যায়, আগে তা সোনার পাতে মোড়া ছিল। ভিতরে সমাধিবেদির সামনে স্পষ্ট লেখা ‘পরি বিবির সমাধি’, সঙ্গে বন্ধনীর মধ্যে লিখে দেওয়া আছে ‘শায়েস্তা খাঁর কন্যা’।
কিন্তু সত্যিই কি পরি শায়েস্তা খাঁর কন্যা? ঔরসজাত না হলেও যে মমতায়, সুরক্ষায় ছোট্ট এক অসমিয়া শিশুকন্যাকে আগলে রেখে শেষ পর্যন্ত শাহজাদি করেছিলেন শায়েস্তা খাঁ, তাতে পিতার আসন তিনি পেতেই পারেন।
কিন্তু কে এই রহমত বানু, ওরফে পরি বিবি? তার সঙ্গে কী যোগ অসমের?
ফিরে দেখা যাক, রমণীর ছোট্ট জীবনের মোড়-ঘোরানো বছরটার দিকে।
দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর অওরঙ্গজেব বাংলার সুবাদার মির জুমলাকে অসম আক্রমণ করে মোগল প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেন। ১৬৬২ সালের ৪ জানুয়ারি মির জুমলা ১২ হাজার অশ্বারোহী এবং ৩০ হাজার পদাতিক বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন। তাঁদের সঙ্গে জলপথে চলল তিন শতাধিক রণতরীর বিশাল বহর। তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ওলন্দাজদের জাহাজ ‘ঘুরাব’, যেগুলিতে ছিল ১৪টি করে কামান, ৫০-৬০ জন নৌসেনা। এ ছাড়াও নৌবহরে ছিল পর্তুগিজ এবং কয়েক জন ইংরেজ নাবিকও।
মির জুমলার বিশাল সৈন্যদল ও নৌবহরের সামনে আহোমরা প্রতিরোধ গড়তেই পারেনি। উচ্চপদস্থ আহোম আধিকারিকদের মধ্যেও রাজার প্রতি অসন্তোষ বাড়ছিল। সেই সুযোগে কার্যত বিনা বাধায় কাজলিমুখ, সমধারা, শিমলাগড়ের দুর্গগুলি দখল করে নেয় মোগলরা।
১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ মির জুমলার বাহিনী গড়গাঁওয়ে প্রবেশ করে এবং প্রাসাদ দখল করে। ইতিহাসবিদ সূর্যকুমার ভুঁইঞা ও এন এন আচার্যের লেখা অসমের ইতিহাস বলছে, মোগল সেনাপতি মির জুমলার হাতে আহোমদের পরাজয়ের পরে ঘিলাধারী (ইংরাজিতে ঘিলাঝারি) ঘাটের সন্ধি হল। চুক্তি সই করতে আসেন খোদ মির জুমলা। চুক্তির চরম অপমানকর শর্ত দেওয়া হল, আহোমরাজ জয়ধ্বজ সিংহের একমাত্র কন্যা, মাত্র ছ’বছর বয়সি নাং সেং (তাই, আহোম ভাষায় নাং মানে মেয়ে; সেং মানে সুন্দর) ওরফে রমণী গাভরুকে পাঠাতে হবে মোগল হারেমে। রমণী ছিল সম্পর্কে আহোম সেনাপতি লাচিত বরফুকনের ভাগনিও। যে লাচিত পরে মোগলদের সরাইঘাটের যুদ্ধে হারাবেন। লাচিতের আপত্তি থাকলেও আহোমরাজ ছিলেন নিরুপায়। ১৬৬৩ সালের ৫ জানুয়ারি, ২০০ জন পরিচারিকা-সহ রাজকুমারী রমণী, টিপম রাজার কন্যা ও সম্ভ্রান্ত আহোমদের আরও চার পুত্র যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে মির জুমলাকে হস্তান্তরিত করা হল।
৫ দিনের মাথায় মির জুমলার বাহিনী বাংলা থেকে প্রত্যাবর্তন শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে সেনাবাহিনী বরইতলি পর্যন্ত স্থলপথে দক্ষিণ দিকে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইটাখুলিতে মির জুমলা জামানত হিসেবে আনা সম্ভ্রান্তদের চার সন্তান ও অন্যান্য আহোমদের রেখে যান। কিন্তু রমণী ও টিপম রাজকন্যাকে ছাড়া হয়নি। ফুটফুটে রমণী ইতিমধ্যেই ৭২ বছর বয়সি মির জুমলার মন জয় করে নিয়েছিলেন। পথেই প্লুরিসি এবং জ্বরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন মির। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় পৌঁছনোর পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু ফেরা আর হয়নি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পেরিয়ে মার্চে অসম-মেঘালয়ের সীমানায় গারো পাহাড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পশ্চিম গারো পাহাড় ও অসমের মানকাচরের মিলনস্থলে ঠাকুরবাড়ি গ্রামে, টিলার মাথায় রয়েছে তাঁর সমাধি।
মির জুমলার মৃত্যুতে বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব নেন শায়েস্তা খাঁ। রাজকুমারী রমণীকে শায়েস্তা খাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। রমণীকে দেখে মির জুমলার মতোই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ঠিক করে ফেলেন, ওই মেয়েকে নিজের পালিতা কন্যা হিসেবে নিজের কাছে রাখবেন, বড় করে তুলবেন। প্রথমে ঢাকা ও পরে দিল্লি পৌঁছে মোগল অন্দরমহলে, মোগলাই আদব-কায়দায় বড় হয়ে উঠতে থাকেন রমণী। আদরের ডাকনাম পরি।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ অওরঙ্গজ়েবের পুত্রবধূ হওয়ার জন্য তখন পাত্রীর লাইন। কিন্তু আমাদের পরির নাম তো আর এমনিই পরি নয়! তাই শায়েস্তা খাঁয়ের কন্যার কপালে শিকে ছিঁড়ল অনায়াসেই।
অওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র যুবরাজ মুহম্মদ আজম শাহের সঙ্গে ধুমধাম করেই রহমত বানুর বিয়ে হয়ে গেল। বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের লেখা ‘গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা’ অনুযায়ী, ১৬৬৮ সালের ২ মে, এক লাখ আশি হাজার টাকা যৌতুক নিয়ে যুবরাজ আজমকে বিয়ে করেন রমণী। আজম তখন গুজরাতের শাসক। ধর্ম আর নাম বিয়ের সময় বদলেছিল না আগেই, তা নিয়ে মতান্তর থাকলেও, তৈফুরের লেখা অনুযায়ী অওরঙ্গজেব রমণীকে ধর্মান্তরিত করে নাম দেন ইরান দুখত রহমত বানু বেগম। কিন্তু অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য রহমত ‘বিবি পরি’ নামেই পরিচিত হন। শায়েস্তা খাঁর মেয়ে হিসেবে পরিচিতা পরিই যে রমণী সে বিষয়ে সূর্যকুমার ভুঁইঞা, লক্ষ্মীনাথ তামুলি, গিরীণ ফুকন, রাজেন সইকিয়া, বাংলাদেশের তৈফুর-সহ সিংহভাগ ইতিহাসবিদই একমত। লুৎফুন্নেসা হাবিবুল্লার লেখাতেও পরিবিবিকেই রমণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আজমের চার স্ত্রীর মধ্যে রমণী প্রথমা ছিলেন না দ্বিতীয়া, তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। পরি তাঁর চোখের মণি হলেও জেঠা দারা শিকোর কন্যা জাহানবেজ বানু ছিলেন প্রধান বেগম, কারণ তিনি ছিলেন মোগল রাজরক্তের বাহক। আজমের সাত ছেলে ও তিন মেয়ে থাকলেও পরি ও আজমের কোনও সন্তান ছিল না।
বয়স কম হলে কী হবে, যুবরাজ আজমের প্রেয়সী এবং সম্রাট অওরঙ্গজেবের পুত্রবধূ হিসেবে দিল্লির রাজপরিবারে রমণী ওরফে রহমতের প্রভাব ছিল ভালই। ইতিহাসবিদ রাজেন সইকিয়া-সহ অসমের অনেকেরই মতে, ১৬৭১ সালে সরাইঘাটের যুদ্ধে মোগলদের হারাতে আহোম সেনাপতি লাচিত বরফুকনের পাশাপাশি যে ইসমাইল সিদ্দিকি ওরফে ‘বাঘ হাজারিকা’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন, তাঁকেও ১৬৬৮ সালে দিল্লি থেকে স্বামীকে বলে অসমে পাঠানোর ব্যবস্থা রমণীই করেছিলেন। ইসমাইলের সঙ্গেই অসমে পাড়ি দিলেন মুসলিম কারিগর, দর্জি, সেনসুয়া (ঘুড়ি প্রশিক্ষক) এবং পারসি অনুবাদকদের দল। প্রচলিত ইতিহাস মতে, ১৬৬৮ সালে ইসমাইল এসে পৌঁছন গড়গাঁওতে। তত দিনে রমণীর বাবা জয়ধ্বজ সিংহের মৃত্যু হয়েছে। সিংহাসনে বসেছেন সুপুংমুং বা চক্রধ্বজ সিংহ। ইসমাইলের উত্তরপুরুষরা এই গল্প বললেও লক্ষ্মীনাথ তামুলির মতো কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মনে করেন, ইসমাইল এক কারিগর পরিবারের বংশধর ছিলেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষরা মির জুমলার আক্রমণের আগেই অসমে এসেছিলেন।
একাই তলোয়ার হাতে বাঘ মারায় ইসমাইলকে বাঘ উপাধি ও হাজার সেনার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেন রাজা। ফলে ইসমাইলের নতুন পরিচয় দাঁড়ায় ‘বাঘ হাজারিকা’। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয় আহোম সেনার কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন।
সরাইঘাটের যুদ্ধ প্রসঙ্গে কথিত আছে, ইটাখুলিতে মোতায়েন করা মোগল কামানের জন্য আহোম বাহিনী উত্তর-গুয়াহাটি দখল করতে পারছিল না। বাঘ জানতেন, মোগল গোলন্দাজেরা ফজ়রের নমাজ পড়ার সময় কামান ছেড়ে একজোট হয়ে নমাজ পড়বেই। তাই কয়েক জন সঙ্গীকে নিয়ে গোপনে বাঘ ইটাখুলির দিকে বাঁধের তলায় অপেক্ষা করতে থাকেন। নমাজ শুরু হতেই উঁচু বাঁধে উঠে তাঁরা মোগল কামানের ভিতরে জল ঢেলে অকেজো করে আসেন। এর পর আহোমরা আচমকা হানা দিলে মোগলরা কামান দাগতে ব্যর্থ হয়। ফলে আহোম বাহিনী উত্তর পার দখল করে নেয়। অসুস্থ হয়েও লাচিত যে ভাবে মোগল বাহিনীকে কৌশল ও বীরত্বে পরাস্ত করেন, তা এখন কিংবদন্তি।
১৬৭৬ সালে রাজা রাম সিংহ ফের অসম আক্রমণ করলেও আবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে যান। অওরঙ্গজেব ছেলে আজমকে গুজরাত থেকে সরিয়ে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। ১৬৭৭ সালে রহমতকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় হাজির হলেন আজম। বাবা জয়ধ্বজের মৃত্যুর পরে মা পাখোরি নতুন রাজা চক্রধ্বজ সিংহকে বিয়ে করেছেন। এত দিনের মধ্যে এক বারও রমণীর খবর নেননি কেউ! কিন্তু রমণীর স্বামী বাংলার সুবাদার হয়েছেন এবং রমণী ও আজম ঢাকা এসেছে, খবর পেয়েই দরদ উথলে ওঠে তাঁর মামা লালুক শোলা বরফুকনের। দাদা লাচিত সরাইঘাট যুদ্ধের পরের বছরই মারা যাওয়ায় গুয়াহাটির ভার তত দিনে ভাই লালুকের হাতে। ক্ষমতাশালী রাজমন্ত্রী আতন বুঢ়াগোহাঁইয়ের প্রতিপত্তি খর্ব করতে ও নিজে রাজা হওয়ার আশায় ঢাকায় আজমদের জন্য মাহুত-সহ চারটি হাতি ও নানা দামি উপহার-সহ দূত পাঠান লালুক। সেই সঙ্গে গোপন আর্জি জানালেন ভাগনির কাছে, তাঁকে অসমের রাজা করে দিতে হবে। রমণী যেন আজমের সঙ্গে কথা বলে সেই ব্যবস্থা করে দেয়! যোগাযোগ না থাকলেও আমৃত্যু পিতৃভূমির প্রতি টান হারাননি রমণী। পালন করেছেন তাঁর কর্তব্য। যে পিতৃভূমি তাঁর খবর রাখার প্রয়োজন অনুভব করেনি কখনও।
সূর্যকুমার ভুঁইঞার লেখা ইতিহাস অনুযায়ী, মামার মতলব জানতে পেরে পরি পাল্টা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রথমে শুভেচ্ছাবার্তা, তার পর— “আশা করি ঈশ্বরের আশীর্বাদে আপনার যশ ও প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি হবে, যে সেই প্রতিপত্তির দৌলতে আপনি সব কেশ শুভ্র হওয়া পর্যন্ত শান্তির বিছানায় নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করতে পারবেন।” তার পরেই ক্ষোভের সুর। বাদশাহবাড়ির বৌমা হলেও খাঁচার ভিতরে বন্দি অচিন পাখির মতোই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেই হাহাকার মামাকে লেখা চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে— “মাত্র ৬ বছর বয়সে উপহার হিসেবে মোগলদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল আমায়। এখন আমার বয়স ১৯। এতগুলো বছরের দুঃসহ জীবনে কখনও, একটি বারও, কোনও উপলক্ষেই আপনি আমার খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।”
পরের লাইনগুলিতে অভিমান সামলে নিয়ে, রমণী মামাকে সাবধান করে দেন, নিজে রাজা হওয়ার লোভে গুয়াহাটি-কামরূপ মোগলদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত বিপজ্জনক হবে। ভুলেও যেন তা না করেন লালুক। সেই সঙ্গে জানান, মামার পাঠানো দূতকে বন্দি করে রেখেছেন পাদশাহজ়াদা। কিন্তু তিনি পাদশাহজ়াদাকে বলে দূতের মুক্তির ব্যবস্থা করছেন। দূতের সঙ্গে রমণীর বিশ্বস্ত পরিচারিকা ময়নাকে যেন যে কোনও উপায়ে ফেরানোর ব্যবস্থা করেন লালুক। তাঁদের মুখে বাস্তব পরিস্থিতির কথা জানার পরেই যেন সিদ্ধান্ত নেন মামা। কিন্তু দূরদর্শী ও দেশপ্রেমী রমণীর কথায় পাত্তা দেননি ক্ষমতালোভী লালুক। ১৬৭৯ সালে গুয়াহাটি ও কামরূপের ভার আজম শাহর প্রতিনিধি নবাব মনসুর খানের হাতে তুলে দেন তিনি। বদলে লালুক হলেন রাজমন্ত্রী। চুদৈফাকে সরিয়ে তিনি চুলিকফাকে রাজা করেন। রাজবংশের কোঁয়রদের ক্ষমতা কেড়ে নেন। বিদ্রোহ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১৬৮০ সালে নৈশ-শয্যাতেই তিন ছেলে-সহ লালুককে হত্যা করা হয়।
আহোম ইতিহাস বলছে, ১৬৮১ সালে স্বর্গদেও গঙ্গাধর সিংহ সিংহাসনে বসে প্রথম দু’টি কাজ করলেন। এক হল গুয়াহাটি পুনরুদ্ধারের জন্য সেনা শক্তিশালী করা। দ্বিতীয়ত শিমালুগুড়ি থেকে ধোদর অলি পর্যন্ত রাস্তার নাম বদলে রমণীর নামে রাখা। ঢাকায় বসে সেই সম্মানের খবর পেয়ে রমণীর অভিমানে মলম লেগেছিল কি না, তা জানা যায়নি।
১৬৮২ সাল। আহোমরা গুয়াহাটি দখলে মরণপণ আক্রমণ চালাল তিনটি দলে ভাগ হয়ে। ছত্রভঙ্গ মোগল বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠতে হয়। শুধু গুয়াহাটি থেকে বার করাই নয়, মোগলদের নামনির মানস নদী পর্যন্ত খেদিয়ে দেয় আহোমরা। পরবর্তী কালে ব্রিটিশদের অসম দখলের আগে পর্যন্ত মানস নদীই ছিল মোগল সাম্রাজ্য ও আহোম সাম্রাজ্যের সীমানা। পিতৃভূমিকে মোগলমুক্ত দেখার পরম তৃপ্তির খবর পৌঁছল ঢাকায় রমণীর কানে। জুড়াল মনও।
ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। মনে রমণী আর বহিরঙ্গে পাদশাহজাদার বেগম ইরান দুখতের দু’মুখী চেহারা ‘বাখুবি’ বজায় রেখেছিলেন রহমত। ১৬৭৮ সালে ঢাকার অওরঙ্গাবাদে স্ত্রীর পরিকল্পনাতেই কেল্লা তৈরি শুরু করেন আজম। তখন কেল্লার নামও ছিল অওরঙ্গাবাদের কেল্লা। কিন্তু ঢাকা-বাসের পনেরো মাসের মাথায় মরাঠা বিদ্রোহ দমনে অওরঙ্গজ়েব তাঁকে ডেকে পাঠান। ১৬৮০ সালে পালক পিতা শায়েস্তা খাঁ আবার সুবেদারি নিয়ে ঢাকায় ফিরলেন। ফের শুরু হয় দুর্গের কাজ। কিন্তু ১৬৮৪ সালে দুর্গের মধ্যেই মৃত্যু হয় পরির। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে। ১৭০৭ সালে স্বামী আজমের মোগল সম্রাট হওয়া দেখা হল না তাঁর।
মেয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে শায়েস্তা ওই অপয়া দুর্গ তৈরির কাজ বন্ধই করে দেন। তত দিনে দু’টি বিরাট ফটক, দেওয়ান-ই-আম, হাম্মাম, মসজিদ, বিরাট পাঁচটি বুরুজ, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন, জলাধার, ফোয়ারা, ছাদ-বাগান, সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শেষ হয়েছিল। শায়েস্তা পরম মমতায় স্নেহের পরির জন্য মাজার তৈরি করেন অওরঙ্গাবাদের ভিতরে। সমাধি তৈরির কাজ শেষ হয় ১৬৮৮ সালে। মাজার তৈরির জন্য শায়েস্তা খাঁ ভারতের বিভিন্ন এলাকা নির্মাণ উপকরণ এনেছিলেন। তৈফুরের মতে, ইরান দুখত রহমতের আসল পরিচয়ের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতেই মাজারে হিন্দু রীতির ছোঁয়া ছিল।
ভিতরে আরও একটি কবর রয়েছে শায়েস্তা খাঁর ‘কথিত’ ছোট মেয়ে সামশাদ বানুর। অবশ্য অন্য এক মত বলে, মৃত্যুর সময় গর্ভবতী ছিলেন পরি। ওই ছোট কবর সেই মৃত কন্যারই। বাংলাদেশ সরকারের কাটরা ওয়াকফ পরিদফতরে সংরক্ষিত শায়েস্তা খাঁর ওয়াসিয়তনামায় মৃত্যুর সময় ঢাকায় বড় মেয়ে হিসেবে ইরান দুখত ওরফে বিবি পরি ও ছোট মেয়ে হিসেবে তুরান বানু ওরফে বিবি বিবানের হাজির থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। লালবাগে আরও আছে, শায়েস্তা খাঁর বিশ্বস্ত সহ-সেনা অধিনায়ক মির্জা বাঙালি ও দুই অজ্ঞাতপরিচয় শিশুর কবর।
শায়েস্তা খাঁর মৃত্যু ও পরে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ায় অওরঙ্গাবাদের কেল্লা অবহেলায় পড়ে ছিল। ঢেকে ছিল আগাছায়। ভেঙে যায় অনেক অংশ। ১৮৪৪ সালে ওই এলাকার নাম অওরঙ্গাবাদের বদলে লালবাগ করা হয়। দুর্গের নামও বদলে হয় লালবাগ কেল্লা। গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের ভারনেয় সরকার। সংস্কারের পরে তা দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
মোগল ও আহোমদের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত উল্লেখ থেকে রমণীর ছোট্ট জীবনের মোটামুটি একটা খতিয়ান মিললেও, তাঁর সঙ্গেই মোগলদের হাতে তুলে দেওয়া টিপমরাজের ছোট্ট মেয়ের আর কোনও খবর মেলে না কোথাও। হয়তো সে পরির মতো রাজরানি হতে পারেনি বলেই।
কিন্তু রানি হয়েও রমণী এক হাঘর জীবন কাটিয়ে গেলেন মনে মনে। আসলে আমাদের পরির জীবন তো ব্রহ্মপুত্রের মতোই। আহোমদের মতো বাইরে থেকে এসে সেই নদী গোটা অসম পেরিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে যায় যমুনা নামে। তার পর মিশে যায় পদ্মা-মেঘনায়। ইতিহাস-গল্প, তথ্য-গুজব, স্মৃতি-বিস্মৃতি, সত্য-কিংবদন্তির মধ্যে খেলে বেড়ানো পরি ঢাকা তথা বাংলাদেশের মানুষের গল্পকথায় এখনও বেঁচে। সেখানে অবশ্য দেশপ্রেম নয়, বিবি পরির নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ভয়, অতৃপ্ত আত্মা, অপয়া শক্তির লোককথা। তাই অসমের হারিয়ে যাওয়া নাং সেং, ৩৪০ বছর ধরে লালবাগের মাজারে, তাঁর নিজের শখের কেল্লায়, আঁধারে ঘুরে বেড়ানো জিন পরি হয়ে থেকে গিয়েছে। রাত নামলে, সেই ভিটেহারা জিনের দীর্ঘশ্বাস উজানি অসমের ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে নীরবে মিশে যায় কালচে বুড়িগঙ্গার জলে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)