রূপবদল: চড়ক বা গাজনে সঙের শোভাযাত্রায় নানা ছদ্মবেশের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল হরগৌরীর পরিচ্ছদ।
হাসি-মশকরা বা রঙ্গ-কৌতুক নির্মল আনন্দ পাওয়ার মাধ্যম। তবে তা যে প্রয়োজনে প্রতিবাদ হয়ে উঠতে পারে, উনিশ শতকের সঙের গান তার প্রমাণ। সে সময় সঙের মিছিলে এবং গানে রস-পরিহাসে, কমিক-কৌতুকে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা ছিল আসল উদ্দেশ্য।
সঙ তা হলে কী? বিভিন্ন পেশার নানা ধরনের মানুষের পোশাক পরে অঙ্গভঙ্গি করে গান, ছড়া কাটা এ সব দিয়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পরিহাস। রাশিয়ান নাট্যকার গেরাসিম লেবেদেভ যে দুটি নাটক এ দেশে অভিনয় করেন, তার মধ্যে ‘কাল্পনিক সংবদল’ প্রকৃতপক্ষে সঙবদল বা পরিচ্ছদ পরিবর্তন অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ। উৎসবে-পার্বণে এ-দেশে সঙ বেরনো বহু দিনের প্রথা। হুতোমি নক্শাতেও নানা কিসিমের সঙের বর্ণনা আছে। যাত্রার আসরেও সঙ আসত। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ লিখেছিলেন— ‘যাত্রায় বড় একটা কথাবার্তা ছিল না, দু-একটা কথার পর ‘তবে প্রকাশ করে বল দেখি?’ বলিয়া গান আরম্ভ হইত। সেই গানের কতক আদর ছিল, কিন্তু বিশেষ আদর সঙের। সঙ হালকা সুরে গাইত, অপেক্ষাকৃত ভারী অঙ্গের পালার সুর হইতে সঙের সুরের আদর অনেকের নিকট হইত। সঙ গালাগালি দিত। তাহা লোকের প্রিয় হইত।’
সে কালে চড়কে সন্ন্যাসী এবং সঙের মিছিলের একটি ছবি এঁকেছিলেন বিদেশি চিত্রকর স্যর চার্লস ডি’অয়লি। লন্ডনের ডিকিনসন অ্যান্ড কোম্পানি ছবিটি ছাপিয়েছিলেন। এ ছবিতে আছে সঙ, বসা সঙ অর্থাৎ মাটির পুতুল-সহ বিরাট শোভাযাত্রার দৃশ্য। সে কালে সঙের মিছিলে ইংরেজরাও যোগ দিতেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে কলকাতায় গাজনের দলের পথে পথে ঢাক ও কাঁসর বাজিয়ে ঘোরা এবং সঙ বেরনো ছিল স্বাভাবিক। তাদের শব্দভান্ডারে শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত শব্দ ছিল না। হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর, কলকাতার তালতলা, বেনেপুকুর, খিদিরপুর, কাঁসারিপাড়া আর জেলেপাড়া— এ সব নানা জায়গা থেকে সঙ বেরোত।
উত্তর কলকাতার বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট থেকে বেরোত কাঁসারিপাড়ার সঙ। এদের উৎসাহদাতা ছিলেন প্রখ্যাত ধনী তারকনাথ প্রামাণিক আর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল। বিশেষ ভাবে তৈরি ঘোড়ার গাড়ি করে কাঁসারিপাড়ার সঙ পথে পথে ঘুরত। সেই গাড়িকে বলা হত ‘কাটরা গাড়ি’। তা ছাড়া হার্ড ব্রাদার্স অথবা কুক কোম্পানির মোষে টানা ট্রাকেও সঙ বেরোত। চিৎপুর রোড এবং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ভিড় থাকত বেশি। সঙ বেরনোর আগেই রাস্তার দু’পাশের বাড়ির বারান্দা দর্শকদের ভাড়া দিয়ে গৃহস্বামীরা প্রচুর রোজগার করত। এক মাইল দীর্ঘ সঙের মিছিলে থাকত নাচ, গান, হাসি, মজা আরও কত কী! সঙযাত্রার দু’পাশে প্রায় সব বাড়িতে তৈরি হত শরবত, ব্যবস্থা থাকত পান ও তামাকের। শিশুদের দুধের ব্যবস্থা করা হত। আবার দর্শকদের জন্য অনেক বাড়ির সামনে শামিয়ানা টাঙানো হত। অমৃতবাজার পত্রিকা ১ বৈশাখ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে লিখেছিল, চৈত্রসংক্রান্তিতে নানা কার্টুন আর ব্যঙ্গচিত্রে সঙের মিছিল ছিল অভিনব। কার্টুনের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘গ্রাম উন্নয়ন’, ‘হাতুড়ে ডাক্তার’, ‘পশারহীন উকিল’, ‘আধুনিক যুবক’, ‘মোহন্ত আর তার বউ’ ইত্যাদি।
১৩৩২ বঙ্গাব্দে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য জেলেপাড়ার সঙ বেরোয়নি। ফকিরচাঁদ গড়াই নামে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির উঠানে সঙের অভিনয় ও ছড়া কাটা হয়েছিল। পরের বছর পুলিশ অনুমতি দিল বটে, তবে পথ বদল হল।
মকর সংক্রান্তির দিনে পুরনো আমলে আহিরীটোলা থেকে সঙ ও গানের মিছিল বেরত। জেলেপাড়ার সঙ ছিল খুব জনপ্রিয়, চৈত্র মাসে সংক্রান্তির দিনে জেলেপাড়ার সঙ বেরোত। অনেক দিন আগে থেকেই পালা ও গান লিখে সুর দিয়ে নিয়মিত মহলা চলত। গোড়ার দিকে যাঁরা গান ও পালা রচনা করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী, গুরুদাস দাস, নেপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ইত্যাদি। সঙেরা যে সব সমাজচেতনার গান গাইত তার আবেদন ছিল যথেষ্ট। আবার সঙের দল হাস্যকর অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে ছড়া বলতে শুরু করলে জনতার মধ্যে হাসির রোল উঠত। সঙ ছড়া কাটত, ‘হাসি হাসব না তো কি/ হাসির বায়না নিয়েছি/ হাসি ষোল টাকা পণ/ হাসি মাঝারি রকম/ হাসি বিবিয়ানা জানে/ হাসি গুড়ুক তামাক টানে/ হাসি প্যরা গুড়ের সেরা/ হাসি হুজুর করে জেরা।’
বাংলায় জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশ হয়েছিল প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। জেলেপাড়ার সঙ তাকে এড়িয়ে যায়নি। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা ১৪ এপ্রিল ১৯৩০ সংখ্যায় লিখেছিল, ‘জেলেপাড়ার সঙ সম্প্রদায় জাতীয় ভাবের প্রচারের প্রচেষ্টা করিয়াছেন দেখিয়া সকলেই যারপরনাই সুখী হইয়াছেন।’ ক্যাথরিন মেয়োর ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বইটিতে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা করা হলে, এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী পত্রিকার মতোই কড়া সমালোচনা করেছিল জেলেপাড়ার সঙের ছড়া— ‘সাগর পারের নাগর ধরা/ স্বেচ্ছাচারিণী/ তারাই হল ভারত নারী কেচ্ছাকারিণী।’ এক বার জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবসে বের হল জেলেপাড়ার সঙ। সে বার জেলেপাড়ার সঙের জন্য ছড়া লিখলেন দাদাঠাকুর অর্থাৎ শরৎ পণ্ডিত। এ ছাড়াও এখানে ছড়া, গান ও পালা লিখতেন অমৃতলাল বসু, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সজনীকান্ত দাস, রসময় লাহা, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, মনোমোহন গোস্বামী, নিত্যবোধ বিদ্যারত্ন প্রমুখ। জেলেপাড়ার সঙের গান উদ্যোক্তারা কখনও ছাপাতেন না, তা কেবল লোকের মুখে মুখে ফিরত। অবশ্য মাঝে মাঝে দু’এক জন ব্যবসাবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষ নিজেরাই দু’চারটে ছড়া লিখে তা বই আকারে ছেপে বিক্রি করতেন। ষোলো থেকে আটচল্লিশ পাতার এ সব পুস্তিকার দাম ছিল দুই থেকে পাঁচ পয়সা। এই সব ছোটখাটো বইতে সোডা লেমনেড কিংবা আয়ুর্বেদীয় ঔষধের বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। এই কাণ্ডকারখানা সঙের গানের চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
খিদিরপুরের সঙের মিছিলও জনপ্রিয় ছিল। বেরোত চৈত্র সংক্রান্তি, ১ বৈশাখ ও ২ বৈশাখ। ২ বৈশাখের সঙ ছিল বাসি সঙ। মুসলিম কোচোয়ান, গায়ক ও বাদকের দল যোগ দিত এখানে মনসাতলার সঙের মিছিলে। এদের একটি বিখ্যাত ছড়া ছিল— ‘বছরের শেষে গাও ভাই হেসে হেসে/ স্বরাজের গান হয়ে এক প্রাণ/ গোলামী আর সহনা।’ ঝাড়ুদার ছিল খিদিরপুর সঙের মুখ্য বিষয়। জমাদার এখানে সমাজের জঞ্জাল দূর করার প্রতীক। ঝাঁটা-বুরুশ, কোদাল-ঝুড়ি, ময়লা ফেলার গাড়ি সব ছিল সঙের নিজস্ব জিনিস। সঙের দল গাইত ‘ধাঙ্গড় মেথর আমরা মশাই থাকি শহরে,/ বাবুয়ানা করে মশাই আমাদের মেরে।’ এখানে ১ ও ২ বৈশাখ সঙ বেরোত সন্ধের পর আর চৈত্র সংক্রান্তির দিন দুপুরবেলায়। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে ওই অঞ্চলে লোকের মুখে মুখে ঘুরত—‘বউমা আমার সেয়ানা মেয়ে/ চরকা কিনেছে। ঘরের কোণে আপন মনে/ সুতো কেটেছে।’
১৮২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায়, সে বছর সরস্বতী পুজোর প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সঙের মূল বক্তব্য ছিল অন্যায়কারী, ক্ষমতাবানের ঔদ্ধত্য দেখানোর বিরুদ্ধে সাধারণের প্রতিবাদ। এই পত্রিকার খবর অনুযায়ী সঙের মিছিলের আয়োজককে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে তুললে বিচারকর্তা তাকে বলেন, ‘তুমি তোমার দেবতার সামনে এ রকম কদর্য সঙ করেছ তা অতি মন্দ কর্ম।’ ‘বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন’, ‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’, ‘মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কি উপায়’— সঙযাত্রায় এ সব নাম দেখলে বোঝা যেত বিদ্রুপের মুখ্য লক্ষ্যবস্তু কে বা কারা।
বিশ শতকের গোড়ায় কলকাতার তালতলা অঞ্চলের হাঁড়িপাড়া থেকে সঙ বেরোত। হাঁড়িপাড়া ছিল বিরাট এলাকা, সেখানে অনেক জায়গায় খোলার বস্তি, মাটির ঘর। হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলের এক সঙ্গে বাস। এই তালতলায় গাজনের সন্ন্যাসীরা নানা রকম সঙ সেজে ঘুরতেন, আবার বেনেপুকুরের সঙ বেরোত রাতে। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন। সঙ্গে হত লীলাবতীর গান। জোড়া গির্জার পর নোনাপুকুর ট্রামডিপোর পিছনে বেনেপুকুর পল্লি। হরগৌরীর সঙ্গে আরও বিচিত্র সঙ সেজে লোকে এখানে পথে নানা রঙ্গরসের অবতারণা করত। সেকেলে কলকাতার ভৌগোলিক পরিসর ছিল ছোট। বছরের শেষ দিন থেকে বহু বিচিত্র সঙের শোভাযাত্রায় হাসি, গানে, মজায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-শ্লেষে মুখর হয়ে উঠত শহর কলকাতা।
আঠারো শতকের শেষ থেকে পাক্কা একশো বছর বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহের মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। কোলাহলমুখর নানা বিতর্কে মুখর ছিল বাঙালি সমাজ। পশ্চিমি শিক্ষাদীক্ষায় প্রাণিত নব্য শিক্ষিত ভদ্রলোকরা সঙের গানে তথাকথিত অমার্জিত টিকা-টিপ্পনি মেনে নিতে পারেনি। তাই অনেক সংবাদপত্রে তা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি ওঠে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর টাউন হলে ভদ্রজন একত্র হয়ে ‘সোসাইটি ফর দ্য সাপ্রেশন অব পাবলিক অবসিনিটি’ প্রতিষ্ঠা করে। অশ্লীলতা নিবারণী সভা-র অনুরোধে সরকার এক সময়ে তারকনাথ প্রামাণিকের উৎসাহে প্রাণিত কাঁসারিপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করে। সামান্য লোকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে এ সভ্যতা দেখানোয় ‘বসন্তক’ পত্রিকা অবশ্য তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। তা ছাড়া কাঁসারিপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন হগসাহেব। সে দিন সঙের দল গান বেঁধেছিল ‘শহরে এক নূতন/ হুজুগ উঠেছে রে ভাই/ অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।/ বৎসরান্তে একটি দিন/ কাঁসারিরা যত/ নেচে কুঁদে বেড়ায় সুখে/ দেখে লোকে কত।/ যদি ইহা এত মন্দ/ মনে ভেবে থাকো/ নিজের মাগকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখো।’
‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ ধরনের নৈরাজ্যের এই অবস্থায় নিজস্ব ভঙ্গিতে, হাসি-হুল্লোড়ে, সঙের মতো লৌকিক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন অশিক্ষিত, গরিব মানুষের দল। ভণ্ডামি, নষ্টামি, দালাল, মাতাল, গুলিখোর-সঙের গানে উপহাসে বিদ্রুপে সবার বিরুদ্ধে অস্ত্র শানানো ছিল তাদের লক্ষ্য। এমনকি স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রী-স্বাধীনতাও এই লক্ষ্য থেকে বাদ দিল না। বুক চিতিয়ে মাথা উঁচু করে তারা বলতে পেরেছিল, ‘আমরা সবাই শিবের চেলা (আমরা) ভূত গাজনের সঙ/ বছর ভরে তা ধেই তা ধেই নাচছি জবর জং,/ (মোদের) এক চোখেতে মায়ার কান্না, এক চোখেতে হাসি। (আমরা) ঝগড়াঝাঁটি কুৎসা হুজুগ স্বার্থ ভালবাসি।’ মোক্ষম কথাটি আছে এই গানের শেষে: ‘সাহিত্য সমাজে ঘরে/ সং নাচে পুরো বহরে, / সংয়ের সং আজ এক নজরে, /দেখুন ডডং ডং॥’ সঙ নামের এই লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী বিদ্রুপের কৌতুকবাহী অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সঙের গান যেন সম্বৎসরের খতিয়ান। সালতামামির উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা দৃশ্য যেন আলোকিত হয়ে উঠত সঙের ছড়ায় আর গানে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy