প্রতিভাময়ী: ফ্রান্সেস মারিয়োন। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)
আমার এক অভিনেত্রী বন্ধু, তিনি মূলত নাটক করেন, অভিযোগ করছিলেন যে প্রায় সব নাটকই লেখা হয় পুরুষকেন্দ্রিক মডেলে, নারীদের কেন্দ্রীয় চরিত্র করে লেখা হয় না বললেই চলে। দেখা গেল কথাটা খুব ভুল নয়, হেনরিক ইবসেনের ‘ডলস হাউস’ বা ‘হেডা গ্যাবলার’ অথবা বার্নার্ড শ-এর ‘মিসেস ওয়ারেন’স প্রফেশন’ ছাড়া খুব বেশি নাটক পেলাম না আমার ওই বন্ধুর যুক্তি খণ্ডন করতে। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে লেডি ম্যাকবেথ যদিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা যায় কি? আমার বন্ধু এর পিছনে একটা তত্ত্ব খাড়া করে ফেললেন। সেটা হল, যে-হেতু মূলত নাট্যকার ও চিত্রনাট্যকারেরা পুরুষ, তাঁরা নারীকেন্দ্রিক লিখতে চান না ইত্যাদি। সে দিনের আলোচনার পর মনে হল, সত্যিই কি তা-ই? মহিলারা কি নাটক বা চিত্রনাট্য লেখেননি? বা লিখলেও সে ভাবে সাফল্য পাননি?
সেই সন্ধানেই বেরিয়ে পড়ল একটি নাম। মারিয়োন বেনসন ওয়েনস, যিনি পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সেস মারিয়োন নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ায়, ১৮৮৮ সালে। বয়স যখন দশ, তার বাবা মায়ের বিয়ে ভেঙে যায়। বয়স যখন বারো, তখন স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয় তাকে। সে একটা ঘোরতর অপরাধ করছিল। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষককে নিয়ে কমিক স্ট্রিপ আঁকছিল। এর পর অন্য স্কুল, ও তার পর বছর দুই সান ফ্রান্সিসকোর আর্ট ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ হয়েছিল মেয়েটির। প্রথমে এক চিত্রগ্রাহকের সহকারী, তার পরে ‘ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক রেলরোডস’-এর কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। এ সব করতে করতে সুযোগ এল লুই ওয়েবার ফিল্ম কোম্পানিতে সহযোগী চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করার। টুকটাক ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয়ও করতে হবে, এই ছিল শর্ত। এর পরেই সুযোগ এল ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেরি পিকফোর্ডের সূত্রে। ‘ফেমাস প্লেয়ারস ল্যাসকি’ তখন নামী চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা। সেখানে চাকরি পেলেন মারিয়োন।
তিনটি ছবির চিত্রনাট্য লেখায় সহযোগিতা করলেন, অভিনয়ও করলেন একটি ছবিতে। তার নাম ‘আ গার্ল অব ইয়েস্টারডে’। এ বার স্বাধীন ভাবে একটি চিত্রনাট্য রচনা করলেন, ছবির নাম ‘দ্য ফাউন্ডলিং’। ১২৫ ডলারে সেই চিত্রনাট্য বিক্রি করলেন এডলফ জুকোরকে। এই এডলফ জুকোর হলেন বিখ্যাত ‘প্যারামাউন্ট পিকচার্স’-এর তিন প্রতিষ্ঠাতার এক জন। ছবি তৈরি হল। নায়িকা মেরি পিকফোর্ড। মুক্তি পাওয়ার আগে বিশেষ প্রদর্শনে ছবিটি প্রশংসিত হল তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা ‘মুভিং পিকচার ওয়ার্ল্ড’-এ। কিন্তু এর পরেই মারাত্মক বিপর্যয়। ল্যাবরেটরিতে আগুন লেগে পুড়ে ছাই মাস্টার নেগেটিভ। রিলিজ় করার প্রিন্ট তৈরিই করা হয়নি তখনও।
মারিয়োন লস এঞ্জেলস-এ চলে এলেন। ওয়ার্ল্ড ফিল্ম সংস্থায় আবেদন জানালেন কাজের। তারা তাঁকে দু’সপ্তাহের জন্য বহাল করল বিনা বেতনে। কিছু একটা কাজ করে দেখাতে হবে। দু’সপ্তাহ সময়ে কাজ করে দেখানো তো অসম্ভব ব্যাপার! কিন্তু একটা রাস্তা বার করলেন মারিয়োন। স্টুডিয়োয় যত ছবি নির্মিত হয়, সব তো মুক্তি পায় না। অনেক ছবি তৈরির পর ‘মুক্তির অযোগ্য’ তকমা বুকে নিয়ে চলে যায় হিমঘরে। এ রকম একটি ছবি বেছে নিলেন মারিয়োন। তার জন্য নতুন করে লিখলেন ‘প্রোলগ’ আর ‘এপিলগ’। এক এডিটরের সাহায্যে নতুন করে এডিট করলেন। ফল যা দাঁড়াল, তা কিন্তু বেশ গ্রহণযোগ্য হল। ন’হাজার ডলারে ডিস্ট্রিবিউটর কিনে নিলেন সে ছবি, আর লেখার চাকরি পেয়ে গেলেন মারিয়োন। বেতন সপ্তাহে দু’শো ডলার।
অল্প দিনের মধ্যেই ওয়ার্ল্ড ফিল্মের চিত্রনাট্য বিভাগের প্রধান হলেন মারিয়োন। এই কোম্পানির সঙ্গে আড়াই বছর ছিলেন মারিয়োন, তার মধ্যে লিখে ফেলেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি ছবির চিত্রনাট্য। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অবশ্যই ‘দ্য পুয়োর রিচ গার্ল’। ১৯১৭ সালে আবার ফিরে আসেন ‘ফেমাস প্লেয়ারস ল্যাসকি’ সংস্থায়। এ বার চুক্তি বছরে পঞ্চাশ হাজার ডলার, আজকের হিসাবে যা দাঁড়াবে বছরে প্রায় ১২ লক্ষ ডলার!
তখন পৃথিবী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দীর্ণ। এই সময়ে চলচ্চিত্রের রঙিন ‘মেক বিলিভ’ জগতে নিজেকে আটকে রাখতে মন চাইল না মারিয়োনের। তিনি ‘ওয়ার করেসপন্ডেন্ট’ হিসাবে চলে এলেন ফ্রন্টে। যুদ্ধে প্রথম সারিতে মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে লিখতে লাগলেন। ১১ নভেম্বর ১৯১৮, চার বছর রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে গোলাগুলির আওয়াজ থামল। জার্মানি যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সই করেছে। এই সময়ের পর প্রথম যে মহিলা রাইন পার হয়ে ও দিকে গেলেন, তাঁর নাম ফ্রান্সেস মারিয়োন।
সমাজের ডাকে সাড়া দেওয়ার একটা ইতিহাসও ছিল মারিয়োনের। ১৯১৫ সালের ২৩ অক্টোবর এক ঐতিহাসিক মিছিল হয় নিউ ইয়র্ক শহরে। সে মিছিলে হেঁটেছিলেন মারিয়োন, সঙ্গে ছিল তিরিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। মিছিলের দাবি ছিল মহিলাদের ভোটাধিকার।
যুদ্ধ থেকে ফিরে যোগ দিলেন ‘কসমোপলিটান পিকচার্স’-এ। তখনকার বিখ্যাত লেখিকা ফ্যানি হার্স্টের এক উপন্যাস অবলম্বনে লিখলেন নতুন চিত্রনাট্য। সেই চিত্রনাট্য কসমোপলিটান পিকচার্সকে এনে দিল ‘ফোটোপ্লে মেডেল অব অনার’। এই পুরস্কারকে বলা যেতে পারে অস্কারের পূর্বসূরি। তখনও অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড চালু হয়নি।
বন্ধু মেরি পিকফোর্ডকে একটা গল্প বলেছিলেন মারিয়োন, যেটি কিছু দিন আগে তিনি শুনেছিলেন ইটালিতে। ইটালিতে তখন মারিয়োন তাঁর তৃতীয় বিবাহের মধুচন্দ্রিমা কাটাচ্ছিলেন। গল্প শুনেই পিকফোর্ড বলে বসলেন, পরের ছবি তিনি করবেন এই গল্প নিয়েই। পিকফোর্ড আরও একটা কথা বললেন, যা তখন চমকে দিয়েছিল মারিনকে। মারিয়োন শুধু চিত্রনাট্য লিখবেন না, তিনিই হবেন এ ছবির পরিচালক! তৈরি হল সে ছবি, পরিচালক হিসেবে মারিয়োনের প্রথম কাজ, নাম ‘দ্য লাভ লাইট’। মারিয়োন অবশ্য ছবি পরিচালনার থেকে লেখাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এর পর তিনি মাত্র আর একটি ছবিই পরিচালনা করেন, যার নাম ‘দ্য সং অব লাভ’। তবে সেখানে তাঁর সঙ্গে আরও এক জন পরিচালক ছিলেন।
১৯৩১ সালে চিত্রনাট্য লেখার জন্য পেলেন অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ছবির নাম ‘দ্য বিগ হাউস’। ১৯৩২-এ আবারও, এ বারে ছবির গল্পের জন্য, ছবির নাম ‘দ্য চ্যাম্প’। সারা জীবনে তিনশোরও বেশি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন মারিয়োন।
মারিয়োন কাজ করেছেন তিন দশক ধরে, ১৯১৫ থেকে ১৯৪৬। অনেক সময় নিয়েছেন অন্য লেখকের গল্প, কখনও মৌলিক গল্প থেকে লিখেছেন চিত্রনাট্য। মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের স্টুডিয়োয় কাজ করেছেন স্যামুয়েল গোল্ডউইন ও এরভিং থ্যালবার্গের সঙ্গে। ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরেরও কিছু বেশি আগে লস অ্যাঞ্জেলসে তাঁর নিজের বাড়িতে মারা যান ফ্রান্সেস মারিয়োন।
মারিয়োন ছিলেন খুব জনদরদি। অন্যান্য লেখক, অভিনেতা, কলাকুশলী সবার সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিল সৌহার্দের। বিপদে-আপদে সবার পাশে দাঁড়াতেন। কমেডিয়ান ড্রেসলার এবং আর এক চিত্রনাট্যকার লর্না মুন, যাঁরা তখন খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের কাজ পাইয়ে দিতে মারিয়োন যে চেষ্টা করেছিলেন তা হলিউডে স্মরণীয় হয়ে আছে। ভ্যালেরিয়া বেলেটি, যিনি ছিলেন স্যামুয়েল গোল্ডউইন-এর সেক্রেটারি, তাঁর চিঠি থেকে মারিয়োনের এ রকম অনেক পরোপকারের কাহিনি পাওয়া যায়।
১৯১৯ সালে ‘মুভিং পিকচার ওয়ার্ল্ড’ থেকে নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নিজের কাজ বলতে মারিয়োন ঠিক কী বোঝেন। মারিয়োন বলেছিলেন, “গল্প ও চিত্রনাট্য লেখা, যে চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালক সরাসরি শুট শুরু করতে পারবেন এবং সেই পরিচালকের পাশে প্রতিটি মুহূর্ত থাকা, সম্পাদনা থেকে টাইটল ফেলা পর্যন্ত— পুরোটাই আমার কাজ।”
মারিয়োন জেনে নিতেন তিনি যে ছবির চিত্রনাট্য লিখছেন, তার কোন চরিত্রে কে থাকবেন। সব অভিনেতারই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, এক-এক জন এক-এক ধরনের অভিনয় ও সংলাপে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেই খুঁটিনাটি মাথায় রাখতে পারতেন বলেই এক দিকে যেমন সফল হত তাঁর চিত্রনাট্য, অন্য দিকে অনেক শিল্পী খ্যাতনামা তারকা হয়ে উঠেছেন তাঁর লেখা চিত্রনাট্যের সাহায্যে। এঁদের মধ্যে যাঁদের নাম করতেই হয় তারা হলেন মারি ড্রেসলার, গ্রেটা গার্বো, মারিয়োন ডেভিস এবং মারিয়োনের অন্যতম স্বামী ফ্রেড টমসন, ‘কাউবয়’ ছবিতে যাঁর তখন জুড়ি ছিল না।
পরবর্তী প্রজন্মের চিত্রনাট্যকারদের জন্য মারিয়োন লিখেছিলেন ‘হাউ টু রাইট অ্যান্ড সেল ফিল্ম স্টোরিজ়’। লেখকদের যে অবস্থার মধ্যে লিখতে হয়, তা নিয়েও বার বার সরব হয়েছেন তিনি। ১৯১৭ সালে ‘ফোটোপ্লে’ পত্রিকার সাংবাদিক এলিজ়াবেথ পেল্ট্রেট-কে বলেছিলেন, “আমি নিজের বাড়িতে বসে লিখতে ভালবাসি। আর আমি বুঝতে পারি না, এরা কী ভাবে আশা করেন যে এক জন চিত্রনাট্যকার নিজের মনোজগতে ডুবে যাবে যখন রাস্তার ও পারে রোম পুড়ছে।” ১৯৩৩ সালে স্ক্রিন রাইটার্স গিল্ডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পিছনে ছিলেন মারিয়োন।
তবে তাঁর এই সমাজ ও সময় নিয়ে সচেতনতা খুব একটা বেশি সামনে আনতে চায়নি সে দিনের সিনেমা-পত্রিকাগুলো। ছবির তারকাদের মতোই তাঁর একটা ইমেজ তৈরি করা হয়েছিল জনসমক্ষে।
ছবি তৈরির সব বিভাগেই যুক্ত থাকতেন মারিয়োন। কিন্তু তাঁর নাম যেত শুধু গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে। এক বার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, স্বীকৃতি যখন শুধু লেখার জন্য তখন বাকি এত কাজের বোঝা তিনি নেন কেন? মারিয়োন উত্তর দিয়েছিলেন, “শুরুর দিন থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, যদি যা লিখেছি তাই হচ্ছে এমনটা চাই, তা হলে এক জন লেখককে হতে হবে লেখক-পরিচালক অথবা লেখক-প্রযোজক, অলিখিত ভাবে হলেও। তা না হলে চিত্রনাট্য লেখার কাজটা হয়ে দাঁড়ায় ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে বালিতে কিছু লেখার মতো।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy