Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
কঠিন এ সময়ে সুরে-ছন্দে গানে-গানে বন্ধন ঘোচানোর সুযোগ তেমন মেলে না। তাই অপেক্ষা থাকে বছরভর। সে অপেক্ষা মেলবন্ধনের।
music

নবীনে-প্রবীণে আদাবে-প্রণামে

মার্গগানে অবদানের জন্য এ বারের সঙ্গীতসম্মান প্রদান করা হল রাশিদ খানকে। এ বার চার রাতের আয়োজন উৎসর্গ করা হয়েছিল সদ্যপ্রয়াত চার মহারথীর নামে।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২২ ০৮:১৯
Share: Save:

অজস্র মাইলফলক রচনা করা ‘ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স’ উদ্‌যাপন করল ৭০তম সঙ্গীত সমারোহের। নজরুল মঞ্চে ১৪ থেকে ১৭ এপ্রিল চার রাতের পরিসরে শহর কলকাতা আবারও সাক্ষী থাকল অনপনেয় বহু মুহূর্তের। এ বারও প্রবীণ শিল্পীদের আশীর্বাদধন্য হয়েছে মঞ্চ। উড়েছে নবীন প্রাণের বৈজয়ন্তীও। নবীনদের কথাই বিশেষ ভাবে বলা জরুরি এ বারের আয়োজনে। কারণ, তাঁরা প্রমাণ করেছেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এবং নৃত্যশিল্পের অমৃতপাত্রটি তাঁদের হাতে প্রবহমানতায় সুরক্ষিত।

মার্গগানে অবদানের জন্য এ বারের সঙ্গীতসম্মান প্রদান করা হল রাশিদ খানকে। এ বার চার রাতের আয়োজন উৎসর্গ করা হয়েছিল সদ্যপ্রয়াত চার মহারথীর নামে। প্রথম রাত নিবেদিত অকালপ্রয়াত শিল্পী শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি। প্রথম পরিবেশনা যুগলবন্দি। সানাইয়ে হাসান হায়দার আলি খান এবং বাঁশিতে সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। তবলায় শুভেন চট্টোপাধ্যায়। শুরু পুরিয়া ধানেশ্রীতে। বিলম্বিত ঝুমরা। বিলম্বিত থেকেই চমকের শুরু। শান্ত নিবেদন। ভারী মুখের তবলায় শুভেনের ঠেকা ঝুমরার চেনা বয়ানে চলল না। ‘ধা’ একটু সরে এল সমের পরে। তাতে রূপ বদলে গেল পরিবেশনার। এমনিতে যুগলবন্দি শিল্পীদের খুব পছন্দের বিষয় নয়। কারণ, তাতে অতিক্রমণের চেষ্টা থাকে। কিন্তু তিন শিল্পীর বাদনে অতিক্রমণের বদলে পরিপূরক হয়ে ওঠার বিনম্র পেশকারিই মুগ্ধ করল। হাসান দক্ষতা বোঝালেন একক স্বরে দীর্ঘ স্থিতির জাদুতে। বাজনা তিনতালে এল যখন, দ্রুতি নিল রাজকীয় ভঙ্গি। শিল্পীরা শেষে বাজালেন পরিচিত ভজনের ধুন— পনেরোশো শতকের গুজরাতি কবি নরসিংহ মেহতার রচনা ‘বৈষ্ণবজন তো’।

দ্বিতীয় পরিবেশনা কুচিপুড়ি নৃত্যের। স্বনামধন্য মা-মেয়ে বৈজয়ন্তী কাশী ও প্রতীক্ষা কাশী। সঙ্গে দলের কুশীলবেরা। শুরু আদিতালে হংসধ্বনি-নিবদ্ধ বন্দনায়। পরে ভেঙ্কটেশ বন্দনা ও বিঠোবা বন্দনা। পরে মোহন রাগে আদিতালে ‘তরঙ্গ’, যার মধ্যে জায়গা করে নিল থালিনৃত্যও। এবং শেষে ‘পুতনা’। সব পর্বই সুন্দর এবং জমকালো। মঞ্চে পাঁচ নারী এবং এক পুরুষের লাবণ্যময় দাপিয়ে বেড়ানো ঘোর তৈরি করে। প্রতীক্ষা অনবদ্য। প্রাচীন কলাকে কী ভাবে আধুনিক বিভঙ্গে পেশ করা যায়, তারই প্রতিফলন ঘটালেন নবীন শিল্পী। বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে ‘পুতনা’ অংশও। কারণ, এখানেই অভিনয়-কলার তুঙ্গ প্রকাশ। লক্ষ্মীরূপে শিশু কৃষ্ণের সামনে পুতনার আবির্ভাব এবং চেনা কাহিনির বাকি পর্বগতি— সবেতেই বৈজয়ন্তী অসামান্য। ডান্ডির ব্যবহার, পুতনার আসল রূপে চকিতে নিম্নাঙ্গে কালো পোশাক পরে নেওয়া, নিষ্ঠুরতার প্রকাশ এবং নাটকীয়তা মনে রাখার মতো। রেকর্ড করা সঙ্গীতায়োজন চলনসই।

তৃতীয় পরিবেশনা আর্চিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তবলাবাদন। সদ্য কৈশোর পেরোনো এই নবীন প্রমাণ করলেন, তিনি লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। তাঁর সঙ্গে হারমোনিয়ামে দারুণ জ্যোতির্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনতালে আর্চিকের পরিবেশনা তাঁর বাবা প্রয়াত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্ছনা মনে করিয়ে দিয়েছে শ্রোতাদের। নানা ঘরানার কায়দা পেশ করলেন নবীন। দিল্লি ঘরানার বাদন, কেরামতুল্লা-শৈলী, অন্ত্যাক্ষরী চক্রধার, ফিরোজ খানের জটিল চক্রধার এবং তাঁর বাবার তৈরি কিছু অনুপম গৎ, টুকরা ও চক্রধার। প্রতি ক্ষেত্রেই বিনয়ী আর্চিক ‘চেষ্টা করছি’ বললেন বটে, কিন্তু লয়ের নানা বিভঙ্গে ক্ষিপ্র-স্পষ্ট গতিতে নিমেষে তিনি শ্রোতার মন জয় করলেন।

আগরা ও কিরানা ঘরানায় প্রশিক্ষিত কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী তুষার দত্ত শুরু করলেন মালকোশ দিয়ে। নির্মেদ পরিবেশনা। দ্রুত বন্দিশ ‘আজ মোর ঘর আয়ে’ চমৎকার। শেষের দাদরা খানিক গজ়লের ভঙ্গিতে গাওয়া এবং একটু দলছুট। গোটা পরিবেশনা ধরে রেখেছিল সমর সাহার প্রাজ্ঞ বাদন। হারমোনিয়ামে রূপশ্রী ভট্টাচার্য যথাযথ।

রাহুল শর্মার সন্তুর পঞ্চম উপস্থাপনা। শুরু চন্দ্রকোশে। সন্তুরে আলাপ না জমলেও তাঁর বাবা তথা গুরু শিবকুমার শর্মার দিশাপথেই চেষ্টা ছিল। কিন্তু কঠিন সেই চেষ্টার সূক্ষ্ম জায়গায় শ্রোতাদের করতালি বাজনার বিসর্জন ঘটাচ্ছিল। মধ্য লয়ে ন’মাত্রার এবং পরে দ্রুত তিনতালের পেশকারি চমৎকার। সুন্দর মিশ্র কিরওয়ানির ধুনও। তবলায় মুকুন্দরাজ দেও একেবারে মাপা।
ষষ্ঠ পরিবেশনা অশ্বিনী ভিড়ে দেশপাণ্ডের কণ্ঠসঙ্গীত। আত্রাউলি-জয়পুর ঘরানার বিদুষী শিল্পী-সঙ্গীতকার রাত তিনটে নাগাদ শুরু করলেন ললিত দিয়ে। তিনতালে বিলম্বিত খেয়াল ‘জাগো হে নন্দলাল’, ছোট খেয়াল ‘কমল পঙ্কুরি খোলো’ এবং ‘অব তো জাগো কানহাইয়া’। তিনটি বন্দিশ। তাঁর রচিত বন্দিশের তাল সবসময়ই ভাবানুগামী। তিন বন্দিশেই যশোদা কৃষ্ণের ঘুমভাঙানিয়া। গায়কিতে সে প্রয়াসের গতি-দ্রুতি এবং ধৈর্য-অধৈর্য ফুটে উঠল। পরের পরিবেশনা আহির ভৈরব ও বৈরাগীর সংমিশ্রণে তৈরি বিভাসের বাতাস লাগা বিভাবতী। সাড়ে ন’মাত্রার মধ্যম এবং দ্রুত তিনতাল। শিল্পী শুরু থেকেই আলাপ ও তানে আকস্মিকের মাধুর্য বুনলেন। শেষে মীরার ভজন। তবলায় সঞ্জয় অধিকারী, হারমোনিয়ামে রূপশ্রী ভট্টাচার্য চমৎকার।

প্রথম রাতের শেষে বিশ্বমোহন ভট্টের মোহনবীণা। তবলায় বিক্রম ঘোষ। শুরু রবিশঙ্কর-সৃষ্ট নটভৈরবে। ভোর ৫টায় শুরু। মিনিট কুড়ি পর তবলার অনুপ্রবেশ। অনুপ্রবেশ বলাই শ্রেয়। কারণ, তখন থেকে সকাল প্রায় সাড়ে ছ’টা অবধি মঞ্চে কার্যত কালবৈশাখী। বিলম্বিত, দ্রুত তিনতাল, সওয়াল-জবাব, অনুল্লিখিত তালমালা, ‘বন্দে মাতরম‌্’ এবং ভৈরবীতে ধুন— সব চড়া মাপের শব্দতাণ্ডবে পর্যবসিত। বরেণ্য শিল্পী বিশ্বমোহন এবং বিক্রম। কিন্তু এ রাতে হয়তো তাঁদের অজান্তেই প্রাণের আরামের বদলে বিষয়টি কানের ব্যারামের কারণ হয়ে উঠেছিল।

দ্বিতীয় রাত নিবেদিত বিরজু মহারাজের প্রতি। প্রথম পরিবেশনা ধ্রুপদ গানের। শিল্পী প্রশান্ত মল্লিক ও নিশান্ত মল্লিক। এই দুই ভাই ধ্রুপদের দারভাঙা ঘরানার ১৩তম প্রজন্ম। শুরু যোগ দিয়ে। আলাপ নারায়ণ বন্দনায়। পরে ১৪ মাত্রার ধামার। এর পর দুর্গা-নিবদ্ধ পদ। প্রশান্তের ভারী গলার গমকে গওহরবাণীর প্রকাশ। নিশান্তের কণ্ঠ চিকন, মিষ্টি। দু’জনের বোঝাপড়া চমৎকার। দারুণ মৃণালমোহন উপাধ্যায়ের পাখোয়াজও। কিন্তু অনুষ্ঠান দীর্ঘায়িত হওয়ায় মিঠে ধ্রুবপদ ক্রমে আক্ষরিক অর্থেই নীরস প্রবন্ধগীতি হয়ে উঠল।

মাতিয়ে দিলেন নবীন কত্থক শিল্পী বিশাল কৃষ্ণ। মঞ্চে লাবণ্যসঞ্চার ঘটল। সহশিল্পী শ্রীয়ানা কৃষ্ণ, সংস্থিতা শর্মা। বেনারস ঘরানার এই উপস্থাপনায় ধ্রুপদী পরম্পরার হাত ধরেছে আধুনিকতা। অনবদ্য বিশালের শরীরী ভাষা। শুরু করলেন ‘দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে’ স্তোত্রে। পরে তিনতালে প্রচলিত-অপ্রচলিত পেশকারি। শিল্পী জানালেন, এ সব তিনি পেয়েছেন পরম্পরাসূত্রেই। পেয়েছেন সীতারাদেবী, গোপী কৃষ্ণ, বিরজু মহারাজদের সিন্দুক থেকেই। বিশালের তৎকার-পাল্টা, গৎ, পরণ, চক্রধার-পরণ চমৎকার তো বটেই, বিস্ময়কর তাঁর জিমন্যাস্ট-কৃৎকুশলতাও। বিপুল লাফের পর চকিতে মঞ্চের মাটিতে লীন হওয়ার দক্ষতায় চমকে উঠতে হয়। থালানৃত্যেও ঝড় তুললেন নবীন শিল্পী। উদয়শঙ্কর মিশ্রের তবলা এবং বোলসঙ্গত অসাধারণ। প্রযোজনাটির বৈশিষ্ট্য নিরুদ্ধ গতি। কয়েক মুহূর্তের জন্য দম নিয়েছেন বিশাল, কিন্তু মঞ্চ থেমে থাকেনি। সব মিলিয়ে বিশাল কৃষ্ণ প্রাপ্তিরই অন্য নাম।

কিরানা ঘরানার কণ্ঠশিল্পী কুমার মারদুর। শুরু কৌশী কানাড়ায়। বিলম্বিত, মধ্যলয়, দ্রুত। দানামণ্ডিত, আশনন্দিত, স্পষ্ট তানের মধুর কণ্ঠ। লয়ে দখলদারি। তিনতালে ‘কাহে করত মোসে বরজোরি’ ভীমসেন জোশীর স্মৃতি জাগিয়ে তুলল। কুমার একটু দেরি করে ‘বরজোরি’তে পৌঁছনোয় আলাদা মাত্রা তৈরি হচ্ছিল। অনায়াস গায়ন। অনবদ্য শেষের ‘মন ফুলা ফুলা ফিরে জগত মে’ কবীরের ভজনটিও। সন্দীপ ঘোষের তবলা, গৌরব চট্টোপাধ্যায়ের হারমোনিয়াম সুন্দর।

সেতারে নয়ন ঘোষ বাজালেন ঝিঁঝিট। বাজালেন ছোট করে। দ্রুতে তিনতাল। শেষে কাজরি। উপভোগ্য উপস্থাপনা। তবে শিল্পী সময়াভাব নিয়ে পূর্ববর্তী ‘জুনিয়র’ শিল্পীদের খানিক বকাঝকা করলেও তাঁর সুযোগ্য নবীন পুত্র ঈশান ঘোষ ‘জুনিয়র’দের প্রতিভা-বৈজয়ন্তীই ওড়ালেন। অনবদ্য তাঁর তবলাসঙ্গত।

রাত ৩টে ১০। মঞ্চে রাশিদ খান। তাঁকে শুনতে যথারীতি শ্রোতার ঢল। সহশিল্পীদের মধ্যে পুত্র আরমান, তবলায় ওজস আধ্যা, হারমোনিয়ামে বিনয় মিশ্র, সারেঙ্গিতে মুরাদ আলি। শুরু করলেন ললিতে। অনায়াস রাগরূপ প্রতিষ্ঠা। দুই মধ্যমের মিড়ে আলোর পাপড়ি মেলার রাশিদি জাদু। মধ্যে মাইকবিভ্রাট। কিন্তু সব ছাপিয়ে ৫৫ মিনিটের ললিত-অমনিবাস। পরের পরিবেশনা সোহিনী। শেষে শ্রোতাদের অনুরোধে ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’। সব মিলিয়ে দারুণ। তবু তুঙ্গ আকাঙ্ক্ষার কারণেই খানিক অতৃপ্তির রেশও যেন রয়ে গেল এ-রাতে।

রাতের শেষ শিল্পী লক্ষ্মীনারায়ণ সুব্রহ্মণ্যম। কেন এই প্রবীণ শিল্পী-সঙ্গীতকার কর্নাটকি এবং পাশ্চাত্য ধারামূর্ছনার অবিসংবাদী সমার্থ, তা আরও একবার প্রত্যক্ষ করল কলকাতা। বেহালায় আভোগী তুলে নিলেন সুব্রহ্মণ্যম। ত্যাগরাজার কৃতি বা কীর্তন। প্রেক্ষাগৃহে পিনপতনের শব্দও শোনা যাচ্ছে তখন। কোনও ‘ক্যাকোফোনি’ নয়, মধুর রসের বন্যা। সঙ্গে তুলনাহীন সঙ্গতে তবলায় তন্ময় বসু, মৃদঙ্গমে ডি এস আর মূর্তি এবং ঘটমে এন রাধাকৃষ্ণণ। পরের নন্দিত পরিবেশনা বহুদারিতে রাগম‌্-তানম্-পল্লবী। এবং শেষে দক্ষিণী প্রথায় তানি আবর্তনম্ ও রাগমালিকা।
রাজন মিশ্রের স্মৃতিতে নিবেদিত তৃতীয় রাতের শুরুতে কণ্ঠসঙ্গীতে তাঁরই পুত্র রীতেশ মিশ্র ও রজনীশ মিশ্র। বেনারস ঘরানার শিল্পীরা শুরু করলেন যোগকোশে। বিলম্বিত একতালে ‘কাহে করে তু ঘুমান’ এবং দ্রুত একতালে ‘জগৎ হে সমঝ স্বপনা’। পরে জয়জয়ন্তী। সবই রাজন মিশ্রের কম্পোজ়িশন। শেষে ভজন। সব মিলিয়ে উপভোগ্য। তবলায় অরূপ চট্টোপাধ্যায় ও হারমোনিয়ামে সনাতন গোস্বামীর সঙ্গত মাপা।

পরের শিল্পী ভরতনাট্যমে রাধিকা শেঠী ও সতীর্থ শিল্পীরা। পার্বতীবন্দনা ও শিববন্দনা। পরে তুলসীদাসের ভজনে একক নৃত্যে রাধিকা— মিশ্র খাম্বাজে বাঁধা ‘ঠুমক চলত রামচন্দ্র। রেকর্ড করা মাঝারি মানের মিউজিক। তবে এ গানের নাম না জানা শিল্পীর কণ্ঠ মনে করিয়ে দিল সুব্বুলক্ষ্মীকে। এই পর্বের উপস্থাপনাতেই রাধিকা সবচেয়ে সপ্রতিভ। শেষে বৃন্দাবনী রাগে আদিতালে বিলম্বিত, মধ্য ও দ্রুত লয়ে প্রথামাফিক তিলানা।

এর পর বাঁশি। হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার উত্তরসূরি রাকেশ চৌরাশিয়া শুরু করলেন যোগ দিয়ে। ন’মাত্রা-নিবদ্ধ চমৎকার বাদন। পরে তিনতালে দেশও সুন্দর। শেষে তবলায় রামকুমার মিশ্রের সঙ্গে সওয়াল-জবাব। ছিল পাহাড়ির ধুনও।

পরবর্তী শিল্পী পার্থসারথি। সরোদ। দরবারি কানাড়ায় শুরু। ঝকঝকে উপস্থাপনা। পরের পরিবেশনা চন্দ্রকোশ অঙ্গে যোগকোশ। সুঠাম-সুন্দর। প্রথম দিকের তুলনায় শিল্পী পরের দিকে বেশি আকর্ষক। শুভজ্যোতি গুহের তবলাসঙ্গত শ্রুতিনন্দন।

মঞ্জিরি আসনারে কেলকর শুরু করলেন ভৈরব দিয়ে। সতেজ, দানাময় তানকারি। ঝাঁপতালে বিলম্বিত ‘দুখ দূর কিজিয়ে’ মুহূর্তে শ্রোতার কান শিল্পীমুখী করে তোলে। দ্রুত একতালে ‘জাগো জাগো লাল মেরে’তে একই ম্যাজিক। পরের পরিবেশনা দেশকারে তিনতাল মধ্যলয়ে ওঙ্কারনাথ-খ্যাত বন্দিশ ‘ঝনঝরিয়া ঝনকে’। অপূর্ব আদাকারী। শেষে তুকারামের আভং ‘বোলাবা বিঠ্ঠল’। স্মরণীয় উপস্থাপনা। যোগ্য সঙ্গত তবলায় বিভাস সাংহাই ও হারমোনিয়ামে হিরণ্ময় মিত্রের।

রাতের শেষ শিল্পী সুজাত হোসেন খান। তিনি মঞ্চে ওঠার আগেই ভোরের বাতাস মেখে নতুন অনেক শ্রোতা আসন নিয়েছেন। ইমদাদখানি ঘরানা মঞ্চ নিয়ে ধরলেন বিলাসখানি টোড়ি। জানালেন, তিনি যা বাজাচ্ছেন, তা শিখেছেন তাঁর বাবা তথা গুরু বিলায়েত খান এবং আর-এক গুরু আমির খানের কাছে। বাজনার শুরু থেকে সেই পরম্পরাই কথকতা হয়ে উঠল তরফের তারঝংকারে। দীর্ঘ আলাপ-জোড়-ঝালা। গায়কি অঙ্গের রূপরস মূর্ত হয়ে উঠল। আদ্ধা এবং পরে তিনতালে লয়ের দ্রুতি অদ্ভুত নাটকীয়তায়। মাখনগতিতে লয়বৃদ্ধি। শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গতে দুই তবলাশিল্পী অমিত চৌবে ও শারিক মুস্তাফা। তিন জনের বোঝাপড়া নিপুণ ভাবে ‘স্ক্রিপ্টেড’। কোনও তানপুরা ছিল না। তবে, সুজাতের কানতানপুরা ছিলই। বারদু’য়েক সুর নামতেই কানে মিলিয়ে ঠিক করে নিলেন। এর পর ভৈরবী। সেখানে বাদনের সঙ্গে গায়নও। গাইলেন ‘ভবানী দয়ানি’, গজ়ল ‘তুমহারা শেহর কা মৌসম’ এবং দাদরা ‘হামারি আতারিয়া পে’। শ্রোতা-অনুরোধে গাইলেন-বাজালেন তিনটি বাংলা গানের অংশও। ‘লালপাহাড়ির দেশে যা’, ‘তোমায় হৃদ্‌মাঝারে রাখব’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’। শিল্পী এই সবক’টিতেই রীতিমতো জমালেন এবং প্রায় সব লিরিকই ভুল গাইলেন। প্রতিবার কেন রবীন্দ্রনাথের গানের কথাও ভুল গান সুজাত? যাঁর বাবার জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ গাইতে গিয়ে তিনি কেন গাইবেন ‘নিয়ে যাবে কে আমারে’? অভিযোগ না হলেও অভিমান ক্রিয়াশীল হওয়াই সঙ্গত।

আনন্দগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ে নিবেদিত শেষ রাতের প্রথম পরিবেশনা কণ্ঠলাবণ্য উপচে পড়া এক নবীনের। রাশিদপুত্র আরমান খান। প্রশিক্ষিত গলা। স্পষ্ট উচ্চারণ এবং চোখ বুজে শুনলে অল্প বয়সের রাশিদই। গাইলেন পুরিয়া ধানেশ্রী। খেয়াল, তারানা এবং ঠুমরি ও দাদরা। স্বপ্নিল ভিসের তবলা, মুরাদ আলির সারেঙ্গি আর বিনয় মিশ্রের হারমোনিয়াম অসামান্য সঙ্গ দিয়েছে।
ওড়িশি নৃত্যের পরিবেশনায় শর্মিলা বিশ্বাস এবং সতীর্থ শিল্পীরা। প্রথম পর্ব ‘বিলাসিনী’। বৃদ্ধা দেবদাসীদের অতীত রোমন্থন নিয়ে তৈরি। আলোর ব্যবহার প্রশংসনীয়। রেকর্ড করা সঙ্গীত উচ্চকিত নয়। সুন্দর উপস্থাপনা। তবে পরের পর্ব একটু একঘেয়ে। শিল্পীর দাবি অনুযায়ী, ডারউইন-প্রবর্তিত বিবর্তনবাদ বহু আগেই ভারতীয় পুরাণে দশাবতার তত্ত্বে বিবৃত। এই ব্যক্তিগত বিশ্বাসেরই ছাপ এই পর্বে এবং সেই সূত্রেই বেশ আরোপিত। শেষ পর্ব অর্চনামূলক। মঞ্চে করতাল, ঘণ্টা, চামর, পাখার ব্যবহার।

পরের উপস্থাপনা তালবাদ্যের— ‘ড্রামস অব ইন্ডিয়া’। তবলায় বিক্রম ঘোষ, মৃদঙ্গমে এস শেখর, শ্রীখোলে গোপাল বর্মণ ও মোরসিংয়ে বি রাজশেখর। উত্তর ভারতীয় এবং কর্নাটকি শৈলীর জারণে ন’মাত্রিক (চার+পাঁচ) চলন এবং ষোলো মাত্রার আদিতালে পেশকারি। সব শিল্পীই আপনাপন বলয়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠ। কিন্তু গোটাটা মিলিয়ে এই ধরনের প্রয়াসে চারুছন্দ তৈরি হওয়া মাঝেমধ্যেই অধরা থেকে যায় উচ্চকিত হয়ে যাওয়ার কারণে। সেই আশঙ্কা খানিক সত্য হল এ বারও। তবে আলাদা আলাদা ভাবে শ্রোতাদের আমোদিতই করেছেন শিল্পীরা।
গৌরী পাথারের কণ্ঠ মানেই সুঠাম মাধুর্যের মুখোমুখি হওয়া। এ বারের সমারোহে বাগেশ্রী এল তাঁর সূত্রেই। বিস্তার, তানকারি, অলঙ্কার এবং লয়ের উপর দখলদারি নজরকাড়া। বিলম্বিত একতালে গাইলেন ‘সখি, মন লাগে না’ এবং দ্রুত তিনতালে ‘গুন্দ লাওরি মালানিয়া’। শেষে চৈতী— ‘চৈত মাস বোলে কোয়েলিয়া’ এবং হোরি— ‘রং ডারুঙ্গি’। লাবণ্য, ওজস্বিতা আর আধো উচ্চারণের মায়া-রসায়ন। সমারোহের অন্যতম প্রাপ্তি। তবলায় শুভাশিস ভট্টাচার্য, সারেঙ্গিতে সারওয়ার হোসেন অনবদ্য।

তিনি কী বাজাবেন, তা নিয়ে সন্ধে থেকেই আগ্রহ ছিল শ্রোতাদের মধ্যে। সরোদে রাগ দেশ ধরলেন আমান আলি খান। বিস্ময়কর বুনটের নম্রসুন্দর আলাপ। গৎ ঝাঁপতালে। দেখনদারির ছিটেফোঁটাও নেই। আছে তানসিদ্ধ রসিকের হাতে রাগের তন্ময় প্রতিমা নির্মাণ। এখানেই আমান প্রতিতুলনার ঊর্ধ্বে এক সাধক। এর পরে ব্যতিক্রমী এক কাজ করলেন শিল্পী। জানালেন, এর পরে বাজাবেন গৎ। কিন্তু বাদনের সঙ্গে প্রথাগত তাল-সওয়ারির বদলে তালের কাঠামোয় ধাবিত হবে বাজনা। হলও তাই। প্রাজ্ঞ শিল্পী কুমার বসুর তবলায় তিনতাল। সঙ্গে আমন বাজালেন তাঁর প্রপিতামহ হাফিজ আলি খান, পিতা আমজাদ আলি খান এবং বিলায়েত খানের তৈরি তিনতাল-নিবদ্ধ গৎ। পরম্পরার ঐতিহাসিক মুহূর্ত। পরের পর্বে শিল্পী পরিবেশন করলেন রাগ সরস্বতী এবং হংসধ্বনি। দু’টিই একতালে। দু’টিই তুলনাহীন। এর পরে নন্দকোশ। ২০২০ সালের শীতের ডোভার লেনে এই রাগেই অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন আমান। সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর তৈরি এই রাগের প্রতি তাঁর টান অবিদিত নয়। এ বারও বিলম্বিত তিনতালের নন্দকোশ চিরকাল মনে রাখার মতো। শিল্পী অনুষ্ঠান শেষ করলেন ললিতে। প্রথমে আড়া চৌতাল, পরে দ্রুত তিনতালে। কুমার বসুর বাদন এ রাতেও তাঁরই মাপের কিংবদন্তি হয়ে রইল। স্মরণীয় হয়ে রইল নবীন-প্রবীণের অভিযাত্রা।

সমারোহের শেষ শিল্পী কৈবল্যকুমার গুরভ। শুরু ভৈরবে। শুরুতে সামান্য নীরক্ত গায়ন। তিনতাল দ্রুতে ‘জাগো মোহন প্যায়ারে’ থেকে ছন্দে ফিরলেন কিরানা ঘরানার শিল্পী। পরের পরিবেশনা বসন্ত। মধ্যলয় ও দ্রত আদ্ধা। এর পর দ্রুত তিনতালে গাইলেন ভাটিয়ার দু’টি বন্দিশ। শেষে ভৈরবী-নিবদ্ধ হোরি। গোটা উপস্থাপনায় হারমোনিয়ামে চিরন্তন জ্যোতি গোহ। তবলায় রামকুমার মিশ্র একই রকম সুন্দর।

চার রাতের মার্গ আয়োজন। কিন্তু কঠিন এই সময়ে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ভাবনায় অমূল্য সঞ্চয়। নবীনে-প্রবীণে আদাবে-প্রণামে আবারও ভাস্বর হল উপমহাদেশের সাঙ্গীতিক অদ্বৈতবাদ।

অন্য বিষয়গুলি:

music Harmony
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy