সৌম্যমূর্তি: দেবভাষা গ্যালারির ‘কবিপক্ষ’ প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন’, সেই কবে লেখা জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’র লাইনগুলি যেন খুব সচেতন হয়েই একটু অন্য ভাবে ব্যবহার করেছেন দেবভাষা কর্তৃপক্ষ। ‘কবিপক্ষ’ উপলক্ষে এই নামেই ৯ জনের ২৪টি কাজ তাঁরা প্রদর্শন করলেন সম্প্রতি। চিত্র-ভাস্কর্যে সবই রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। এ ভাবেই ‘পৃথিবীব্যাপী গভীরতর অসুখের কালে তাঁকে স্মরণ’ কর্তৃপক্ষের কথায়। তবে কবির প্রতিকৃতি করতে গিয়ে কেউ কেউ অতি উদ্দামতায় কি না জানা নেই, কোন ভাবনায় যে এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁর মুখশ্রীর এমন রূপ দিলেন! অনেকটাই অবাক করেছে কাজগুলি। কাজ হিসেবে স্টাইল-টেকনিক যথেষ্ট উন্নত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি? না, চট করে মেনে নেওয়া যায় না। হয়তো শিল্পী সে ভাবে ব্যাখ্যা করবেন বা তাঁর মতো ভেবেছেন, কিন্তু কবির চিরাচরিত ওই সৌম্য দর্শন একটু ধাক্কা খায় বইকি! প্রদর্শনীটি তাঁদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজেও দেখা গিয়েছে। এই প্রতিকূল সময়ে মানুষ যাঁর কাছে আশ্রয় পেতে পারেন, তিনি একমাত্র রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত আজ বর্তমান পৃথিবীর ‘সভ্যতার সংকট’কালে তাঁকেই অন্য ভাবে ফিরে দেখা।
গণেশ হালুই কাগজে-ইঙ্কে যৎসামান্য কয়েকটি লাইনে উল্লম্ব একটি সদ্য গজানো চারাগাছের মতো ড্রয়িং করেছেন। সমান্তরাল, আনুভূমিক রেখার মাধ্যমে নীচের ছড়ানো সরু শিকড়, উপরে পল্লবিত পুষ্প এঁকে মহামানবের আগমনকে বুঝিয়েছেন। নীচে লেখা ‘ঐ মহামানব আসে’। প্রতিকৃতিহীন প্রতীকী চিত্র। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় লালচে কমলার অতি সূক্ষ্ম ঘষা বর্ণের হলদে পটভূমিতে অনেকটা বাউলবেশী রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি কালো কাব্যিক রেখায় চিত্রিত করেছেন। শ্মশ্রুগুম্ফ ও সেই সাদা চুল অদৃশ্য। টুপির মতো কিছু লাইনে মাথা ঢাকা যেন। অল্প রেখায় লাবণ্যময় কাজ। শুভাপ্রসন্ন এক ফুটেরও ছোট একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল মুখ এঁকেছেন কবির, মাধ্যম তেল-রং ক্যানভাসে।
বিমল কুণ্ডুর ব্রোঞ্জে করা রবীন্দ্র-প্রতিকৃতিটিতে আংশিক চৈনিক চরিত্রের প্রকাশ। অপেক্ষাকৃত লম্বা মুখাবয়বে জ্যামিতিক প্রাধান্য। কপাল থেকে সমতলীয় ভাবে টানা নেমে আসা নাসিকা, গুম্ফ-শ্মশ্রুর সোপানসদৃশ আকার ডিজ়াইনের মতো হয়ে গিয়েছে। দু’পাশের লম্বা চুলের ফর্মকেও তিনি দু’ভাবে ভেঙে, একঘেয়েমি কাটিয়ে একটি অভিনবত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অন্য দু’টি ভাস্কর্যসুলভ পেন-ইঙ্কের প্রতিকৃতিতে কিছুটা হলেও কাঠিন্য লক্ষ করা যায়।
প্রত্নতত্ত্বের এক সামান্য আদিমতার মতো গাঢ় খয়েরি আবহে চমৎকার ফর্মের এক প্যাটার্ন তৈরি করে, মাঝখানে কবির টুপি-পরিহিত আপাতবিষণ্ণ রূপটিকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করেছেন অতীন বসাক তাঁর এচিংটিতে। এখানে আধুনিকতার সঙ্গে পুরাতনীর একটি প্রায়ান্ধকার পরিবেশের মধ্যে আলোর উদ্ভাসটুকু বড় বেশি মায়াবী। বেশ অভিব্যক্তিময় গ্রাফিক্স।
শেখর রায় তিনটি কাগজে অ্যাক্রিলিকের কাজেই কবির তিন রকম রূপকে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে বাস্তবায়িত করেছেন। এখানে তাঁর সেই অন্ধকারাচ্ছন্নতা কাটানো এক আবহ। সরু তুলির সূক্ষ্মতায় স্ট্রোকধর্মী রেখায় কবির পরিচিত সৌম্য মুখ, সামান্য ঘষামাজা ও ছিটোনো বর্ণের প্রাধান্যে ও বিশেষত প্রতিচ্ছায়াময় এক আশ্চর্য টেক্সচার ও ব্রাশিংয়ের পরিকল্পিত স্ট্রোক ও টানটোনে কবির আপাত-নিম্নমুখী প্রোফাইলটি অসামান্য। গাঢ় কালচে খয়েরি বর্ণ, সামান্যতম সাদা ও অ্যাক্রিলিকের যৎসামান্য বর্ণের স্বচ্ছতার সঙ্গে মেলামেশার বেশ অন্য রকম স্টাইলকে এখানে চিত্রায়িত করেছেন। যা টেকনিকের সঙ্গে মিলে একটি নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও ঐক্য ও উন্মাদনা তৈরি করে। প্রদীপ রক্ষিতের রবীন্দ্র-প্রতিকৃতিগুলি বেশ ভাল। জোরালো কাজ।
পার্থ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথের মুখাবয়বকে বিকৃত করেননি, কিন্তু তাঁর মতো করে নিরীক্ষা করতে গিয়ে পরিচিত কবি হারিয়ে গিয়েছেন। যে লালচে টেরাকোটাগুলি তিনি গড়েছেন— স্টাইলের দিক থেকে মানানসই, কিন্তু রবীন্দ্র-প্রতিকৃতির চরিত্রের সঙ্গে কোনও ভাবেই মানানসই নয়। একটা লোকশিল্পের আঙ্গিক ও পৌত্তলিকতা মেশানো কাজগুলি কাজ হিসেবে নিঃসন্দেহে দৃষ্টিনন্দন, কিন্তু রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি হিসেবে নয়। প্রখর মুনশিয়ানা থাকা সত্ত্বেও তাঁর এই পরীক্ষানির্ভর ভাবনার অন্তরালে হয়তো নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। জানা নেই।
একটি তরঙ্গনির্ভর স্টাইলে কবির দীর্ঘাকৃতি ব্রোঞ্জ প্রতিকৃতিটি তন্ময় বন্দোপাধ্যায়ের অনন্য নির্মাণ। বেশ জীবন্ত। কৃষ্ণেন্দু চাকী খুব দ্রুত, স্কেচি, ঘষামাজা-সম্বলিত অসাধারণ কয়েকটি প্রতিকৃতি এঁকেছেন। তাঁর ব্রাশিং ভারী সুন্দর। সে দিক থেকে প্রতিটি কাজেই তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy