Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Painting Exhibition

স্বল্পবর্ণ-সূক্ষ্মরেখার গহনে নির্মিত শ্রমজীবীদের খণ্ডিত জীবন

১৯টি কাজের অনেকটাই ড্রয়িং-বেসড পেন্টিং।

রেখাপাত: ইমামি আর্টের অনলাইন প্রদর্শনীতে শিল্পী অঞ্জন মোদকের চিত্রশিল্প

রেখাপাত: ইমামি আর্টের অনলাইন প্রদর্শনীতে শিল্পী অঞ্জন মোদকের চিত্রশিল্প

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২০ ০৩:১৮
Share: Save:

শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার জীবনকথা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। খেটে খাওয়া দিনমজুর, কুলি-কামিন, নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি তাঁর বরাবর একটি দুর্বলতা ছিলই। বিশেষত, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা-যন্ত্রণার ধারাবাহিক ধারাপাত তাঁকে উদ্বেগে রেখেছিল এক সময়ে। তাঁর অবচেতনে থাকা কিছু আশ্চর্য ও কঠিন বাস্তবতা সেই সব সত্যকে অবশেষে সচেতন রূপ দিতে সাহায্য করেছিল এই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ের আবহে। পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় মৃত্যু-যন্ত্রণার দৈনিক দুর্দশা বরাবর অন্তর্মুখী অঞ্জন মোদককে গভীর ভাবে বিচলিত করেছিল। সদ্যনির্মিত ১৯টি চিত্রশিল্পে তিনি তাঁর যাবতীয় ভাবনা প্রতিফলিত করেছেন ‘ফ্র্যাগমেন্টেড লাইফ’ শিরোনামে। ‘খণ্ডিত জীবন’ নামের এই প্রদর্শনীটি সমকালের এক অসাধারণ নিদর্শন। অনলাইন প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিল ইমামি আর্ট। বর্তমানে শিল্পী দৃশ্যকলার অতিথি অধ্যাপক হিসেবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

তাঁর ১৯টি কাজের অনেকটাই ড্রয়িং-বেসড পেন্টিং। ড্রয়িংকে যেমন নিবিড় ভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন, সেই সঙ্গে গ্রাফাইটের ব্যবহার, রেখার সূক্ষ্মতম কিরিকিরি জমাট বুনট তৈরি ও তুলির নমনীয় রেখার রিয়্যালিজ়মের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ফলে সামগ্রিকভাবে অত্যল্প বর্ণবিন্যাস ও ছায়াতপের দ্বৈত সত্তার সঙ্গে রেখাঙ্কনের সূক্ষ্মতার আন্তরিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক-একটি পেন্টিং।

জলরং, গ্রাফাইট, আর্কাইভাল ইঙ্ক, পেপার কাটিং (একটিমাত্র কাজে) ইত্যাদি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দশটি ছবি তিনি ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের বর্তুলাকার আনকাট পেপারের উপরে এঁকেছেন। বাকি কাজগুলি দেড়-দু’ফুট থেকে ৪ ফুট x ৫ ফুট কাগজে করা। মাঝামাঝি মাপেরও কিছু ছবি আছে। প্রতিটি ছবিই অবয়বী, বিশেষত ভীষণ ভাবে প্রতীকী এবং রূপক। সেই অর্থে ছবির কম্পোজ়িশনে কখনও পক্ষী, কীটপতঙ্গ, সাপ, পেঁচা, জিহ্বা, স্তন, পাকস্থলী, উড়ন্ত চোখ, বিকশিত দন্ত, জাল, টর্চ, ডানা...এমন নানারকম অনুষঙ্গ প্রয়োজনে জুড়ে দিয়েছেন ছবিতে। অকারণ জুড়ে দেওয়া নয়, সমগ্র রচনার প্রেক্ষিতে এক-একটি অনুষঙ্গ, সেই হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ। তা রূপক অর্থে, এমনকি প্রতীকী ধারণাকে রচনার সঙ্গে আশ্চর্য ভাবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রেও।

বর্তুলাকার আনকাট পেপারের মধ্যভাগে এক-একটি হাতে গড়া রুটি এঁকেছেন, অবয়বগুলিকে তার মাঝখানে কম্পোজ় করে গোটা অ্যারেঞ্জমেন্টে ঘটনাবলিকে নির্মিত করেছেন। এখানে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রতিটি কাজেই শিল্পী এই পরিযায়ী শ্রমিক, গৃহহীন নিম্নবর্গের মানুষের খাদ্যাভাব, বাসস্থানহীনতা, আশ্রয় খোঁজার এক অদ্ভুত অথচ বাস্তব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টার সেই মুহূর্তগুলিকে প্রতীকায়িত করেছেন এই দ্বিমাত্রিক চিত্রকলায়। খুব ছোট্ট ছোট্ট অজস্র ঘরবাড়িই যে তাঁদের এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় অথচ আবদ্ধ, তা যে কতটা দুরূহ এক বদ্ধতার মোড়কে বন্দি, ছবিতে ভীষণভাবেই তা প্রতিফলিত। ফলে প্রায় অধিকাংশ ছবিতেই মানুষের অসহনীয় অবস্থার আসল রূপককে তিনি প্রতীকী অর্থে বাস্তবতাও স্বপ্নের মোড়কেও কল্পনা করেছেন। এখানে সামাজিক ব্যাধি, রাজনৈতিক এক টানাপড়েনও লক্ষণীয়।

এই খণ্ডিত জীবন তাই শিল্পীর কাছে খাদ্যের নিদারুণ সংকট, আশ্রয়-বাসস্থানের অনির্দেশ্য যাত্রা, নীরব আর্তনাদের মধ্যেও বেঁচে থাকার, লড়াই করার দুর্মর প্রয়াস হিসেবে বড় হয়ে ওঠে। তাই ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’র ওই ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময় পৃথিবীর আর এক রকম অভাব ও যন্ত্রণাকে চিত্রশিল্পের করুণ কাব্যময়তায় দেখিয়েছেন। সে অর্থে অশ্রুসজল ছবি।

রঙিন বস্তাবন্দি প্রচুর ঘরবাড়ি বাঁধা অবস্থায় কোলে নিয়ে বসে থাকা মানুষ, পিঠে অনুরূপ বোঝা নিয়ে হামাগুড়ির অবস্থায় থাকা গৃহহীন, পিঠে ডানার রূপকল্পে সুটকেস ভরা বাড়িঘর আঁকড়ে থাকা শ্রমিক, ঘরবাড়ি আশ্রিত গাছের মধ্যে ঊর্ধ্বে শোয়া, খেটে-খাওয়া মানুষ ছবি জুড়ে। এমনকি মা পাখি তার সন্তানকে যেভাবে খাইয়ে দেয় সেই চরম অবস্থাটিও পক্ষী-মানবী রূপকল্পে এঁকেছেন, চাঁদ যেখানে ঝলসানো রুটির উপমাকে মনে পড়ায়। তবু কোথায় যেন তাঁর ছবি দেখতে দেখতে অর্পণা কৌর ও অর্ঘ্যপ্রিয় মজুমদারের ছবি ভেসে ওঠে। তাঁর কল্পনাপ্রসূত মানুষেরা যন্ত্রণা-আর্তনাদ-কষ্টের মোচড় দেওয়া অবস্থাকে প্রত্যক্ষ করিয়েছে। মিতবর্ণ রেখার অমিত সূক্ষ্মতা, ড্রয়িংয়ের চমৎকার আবহ নিয়ে সমগ্র স্টাইলাইজ়েশন ও টেকনিক নিঃসন্দেহে একটি দাগ রেখে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Painting Exhibition Emami Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy