Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Dance Drama

গীতিনাট্য থেকে নৃত্যনাট্য

সম্প্রতি মধুসূদন মঞ্চে কসবা সুরঞ্জনী আয়োজিত নৃত্যনাট্য ‘মায়ার খেলা’ মঞ্চস্থ করা হল। অনুষ্ঠান শুরু হয় দু’টি সম্মেলক রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে, ‘বাজে বাজে রম্যবীণা’ ও ‘আমারে করো তোমার বীণা’।

নৃত্যনাট্য উপস্থাপনায় শিল্পীবৃন্দ।

নৃত্যনাট্য উপস্থাপনায় শিল্পীবৃন্দ।

শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ ০৭:৪৬
Share: Save:

সম্প্রতি মধুসূদন মঞ্চে কসবা সুরঞ্জনী আয়োজিত নৃত্যনাট্য ‘মায়ার খেলা’ মঞ্চস্থ করা হল। অনুষ্ঠান শুরু হয় দু’টি সম্মেলক রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে, ‘বাজে বাজে রম্যবীণা’ ও ‘আমারে করো তোমার বীণা’। এর পর গুণিজন সংবর্ধনা। ড. পবিত্র সরকার ও দেবাশিস কুমারকে সম্মাননা জ্ঞাপন করেন রিনা মুখোপাধ্যায় ও সুরঞ্জনীর ছাত্রছাত্রীরা। তার পর নৃত্যনাট্য ‘মায়ার খেলা’ নিবেদিত হয়। সখী সমিতির সদস্যা সরলা রায়ের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্য রচনা করেন। ১৮৮৮ সালে বেথুন স্কুলের প্রাঙ্গণে আয়োজিত শিল্প মেলার প্রথম দিনে ‘মায়ার খেলা’ অভিনীত হয়। ‘মায়ার খেলা’কে কবি ‘নাট্যের সূত্রে গানের মালা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। সে কালে মহিলাদের মঞ্চে অভিনয় করা ছিল অকল্পনীয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা সেই প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে অভিনয় করেন। দর্শকও ছিলেন মহিলারাই। ১৮৯২-৯৩ সালে ‘মায়ার খেলা’র ঘরোয়া পারিবারিক অভিনয় হয় বির্জিতলার বাড়িতে। মায়াকুমারীর অভাবে রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মদন ও বসন্ত সেজে গান করেছিলেন। শেষ বয়সে (১৯৩৯) কবি ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যকে নৃত্যনাট্যে রূপায়ণের কাজে হাত লাগান। বোঝা যায়, স্রষ্টার নিজের কাছে এই গীতিনাট্যের মূল্য পরিণত বয়স পর্যন্ত অটুট ছিল— মন্তব্য করেন ইন্দিরা দেবী। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য অভিনীত হয়নি। ষাটের দশকে সঙ্গীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার সুরঙ্গমা সঙ্গীত শিক্ষায়তনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। আশ্রমিক সংঘের ক্ষেমেন্দ্রমোহন সেনের উদ্যোগে গীতিনাট্য ‘মায়ার খেলা’ বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। তখন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা স্টেজে গান গেয়ে অভিনয় করেছেন। সুচিত্রা মিত্র, গীতা ঘটক, গীতা সেন, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসাদ সেনের মতো সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে কলকাতার শিল্পীরা মিলেমিশে গীতিনাট্য ‘মায়ার খেলা’ মঞ্চস্থ করেন।

‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্য খুব বেশি মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়নি। তাই রিনা মুখোপাধ্যায়ের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। রিনা এক সময়ে শৈলজারঞ্জনের কাছে গান শিখেছেন। তাঁর পরিচালনায় ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য দর্শকের আগ্রহ বাড়িয়েছিল। কিন্তু তিনি এই কাজটি সুসম্পন্ন করতে পেরেছেন, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। উপস্থাপনায় গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যকে তিনি মিশিয়েছেন। নৃত্যনাট্যে মায়াকুমারীদের উপস্থিতি কম, গীতিনাট্যে বেশি। রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যনাট্যের মঞ্চায়ন করলে হয়তো তিনিও কিছু অদলবদল করতেন। শৈলজারঞ্জনও কিছু বদল ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু ‘চণ্ডালিকা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শ্যামা’র মতো ‘মায়ার খেলা’র মঞ্চায়ন সফল হয়নি। রিনাও শৈলজারঞ্জনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চায়ন করতে গিয়ে, কাহিনিকে অযথা দীর্ঘায়িত করেছেন। গানের টানে নাটকের খেই হারিয়েছে কোথাও কোথাও। মায়াকুমারীদের গানের সঙ্গে বোলনাচ বাহুল্য মনে হয়েছে। প্রমদার ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করেন পূর্ণিমা ঘোষ। শৈলজারঞ্জন পরিচালিত ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যেও তিনি প্রমদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এতগুলি বছর অতিক্রম করে ৮২ বছরের নৃত্যাঙ্গনা পূর্ণিমা ঘোষের প্রমদার ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় বিস্ময়কর। এই নৃত্যনাট্যের নৃত্য পরিচালনা ও পোশাক পরিকল্পনাও তাঁরই। পূর্ণিমা ঘোষকে কুর্নিশ জানাই। তাঁর অসাধারণ নৃত্য নিবেদন মনে থাকবে।

নৃত্যনাট্য উপস্থাপনায় শিল্পীবৃন্দ।

নৃত্যনাট্য উপস্থাপনায় শিল্পীবৃন্দ।

শান্তার ভূমিকায় এষা গোস্বামী যথাযথ। অমরের ভূমিকায় কৌশিক চক্রবর্তীর কথাকলি আঙ্গিকে নৃত্যের পরিকল্পনা ভাল লাগে৷ তবে তাঁর অভিনয়—যা কথাকলি নৃত্যের অনুসারী— ভাল লাগেনি। এই প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনৃত্যের শিল্পী ও কথাকলির শিক্ষক কেলু নায়ারের কথা স্মরণ করি। তাঁর কথায়— গুরুদেব কথাকলি নৃত্য আঙ্গিকে ছেলেদের নৃত্য উপস্থাপনা পছন্দ করতেন। কিন্তু কথাকলির মতো অভিনয় তাঁর পছন্দ ছিল না। অভিনয় সহজ স্বাভাবিক করার দিকেই তিনি জোর দিতেন। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের উপস্থাপনায় শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার সঙ্গে কলকাতার শিল্পীদের নৃত্য পরিকল্পনায় তফাত থেকে যায়। অশোকের ভূমিকায় আশিস মৈত্রের মণিপুরী নৃত্যের প্রয়োগ এবং কুমারের ভূমিকায় নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের সৃজনশীল নৃত্যের প্রয়োগ (শম্ভু ভট্টাচার্যের নৃত্য অনুসারী) ভাল লাগে। সখীদের ভূমিকায় নন্দা, জয়িতা, মৃত্তিকা, শ্রাবণী, হৈমন্তী ও মায়াকুমারীদের নৃত্যাভিনয়ে নম্রতা, হৃদিমা, শ্রেয়া, দিৎসা, উজ্জয়িনী, অন্বেষা, সোহানার নৃত্যাভিনয় প্রশংসার যোগ্য। সঙ্গীতে প্রমদা— শ্রাবণী রায়, নূপুর চক্রবর্তী, সৌগতা দাশগুপ্ত; শান্তা—রিনা মুখোপাধ্যায়, মালিকা চক্রবর্তী, মৌসুমী চক্রবর্তী মণ্ডল; অমর— সৈকত শেখরেশ্বর রায়; অশোক— দীপাঞ্জন পাল; কুমার—বাসব ঘোষ; সখীদের সঙ্গীতাংশে—অনিতা রায়চৌধুরী, ভাস্বতী ভট্টাচার্য, সুজাতা নাথ, চন্দনা সামন্ত, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, সুরভি ঘোষ, লেখা বিশ্বাস প্রমুখ। মায়াকুমারীদের সঙ্গীতাংশে— মৌমিতা দত্ত, সময়িতা বিশ্বাস, স্বাতী মুখোপাধ্যায়, বন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোনালি চক্রবর্তী, শর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।

গানের উপস্থাপনা ভাল, তবে বেশ কিছু গানের সুরে বিচ্যুতি ঘটেছে। যন্ত্রানুষঙ্গে—তালবাদ্যে বিপ্লব মণ্ডল, সেতারে কুমারেশ চন্দ, কি- বোর্ডে সুব্রতবাবু মুখোপাধ্যায়, এস্রাজে দেবাশিস হালদার, বাঁশিতে প্রশান্ত পাল, পারকাশনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের সহযোগিতা নৃত্যনাট্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মঞ্চসজ্জায় সুবল সাহা, আলোয় বিশ্বনাথ দে, ধ্বনিতে হাসি পাঞ্চাল। মঞ্চসজ্জা ও আলো ত্রুটিপূর্ণ। গ্যালারিতে সঙ্গীতশিল্পীরা বসে থাকার ফলে ও একঘেয়ে আলো পরিকল্পনার কারণে নৃত্যশিল্পীদের পিছনে সব সময়ে গানের শিল্পীদের দেখা গিয়েছে। ইদানীং এই ধরনের গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে। এতে গানের শিল্পীদের আলোকিত করতেই নৃত্যশিল্পীদের জন্য যে বিশেষ আলোর ব্যবস্থা, যা নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে— তা হতে পারছে না। এই প্রসঙ্গে আলোকশিল্পী তাপস সেন, কনিষ্ক সেনের আলোক প্রক্ষেপণের কথা মনে পড়ছে। ব্যবস্থাপনায় এক্সেলেন্স।

অন্য বিষয়গুলি:

Dance Drama Madhusudan Mancha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy