Advertisement
০৮ জানুয়ারি ২০২৫
Cultural Programme

আঁকাবাঁকা পথে নতুন অধ্যায়

কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের ২৫টি জায়গায় শতাধিক শিল্পী মিলে বসাচ্ছেন বিয়েনেলের রংবেরঙের আসর। থিমের নাম ‘আঁকাবাঁকা’। ২৯ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে শুরু হয়েছে।

শিল্পী নিখিল চোপড়ার কাজ।

শিল্পী নিখিল চোপড়ার কাজ।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৪৯
Share: Save:

ভিসা-জটে ঢাকা থেকে আসা বাতিল হল তায়েবা আর মেহেবুবের। কিন্তু তাঁদের প্রদর্শনী হবেই, ঠিক করলেন প্রথম বেঙ্গল বিয়েনেলের সংগঠকেরা। বাংলাদেশের বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের ‘দরজিখানা’ তাই সেজে উঠেছে শান্তিনিকেতনের গাবা কলা চর্চা কেন্দ্রের দালানে। তায়েবাদের পাঠানো কাপড়ের টুকরোয় কিউরেটর সিদ্ধার্থ শিবকুমার ও তাঁর বন্ধুরা মিলেই অ্যাপ্লিকের কোলাজ সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভিডিয়ো কলে তাঁদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন বৃত্তের শিল্পী বন্ধুরাই। বেঙ্গল বিয়েনেলের কিউরেটর, ডিরেক্টর সিদ্ধার্থ শিবকুমার শান্তিনিকেতনের ভূমিপুত্র। বললেন, “এই অ্যাপ্লিকের কাজে ছেঁড়া, ফাটার জোড়া লাগার মধ্যে একটা রূপক আছে। খণ্ডিত বাংলার শিল্পী মনকে মেলানোর মেজাজ।”

বাংলার মন মানে ঘরের সব ক’টা জানালা খুলে দেওয়া। তুরস্কের তিন শিল্পী দক্ষিণ কলকাতার সাবেক বাড়ির চিত্রশালায় ভিডিয়ো ইনস্টলেশন পেশ করছেন। উনিশ শতকের ব্রিটিশ মহিলা মারিয়া গ্রাহামের বিস্মৃত ভ্রমণকাহিনির ভিত্তিতে ইটালি, ব্রাজ়িল, চিলি, ভারতের দৃশ্য মেলে ধরছেন চার দেশের শিল্পীরাই। শান্তিনিকেতনে নন্দন সংগ্রহশালায় এই ডিসেম্বরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনেক ছবি দেখার সুযোগ।

কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের ২৫টি জায়গায় শতাধিক শিল্পী মিলে বসাচ্ছেন বিয়েনেলের রংবেরঙের আসর। থিমের নাম ‘আঁকাবাঁকা’। ২৯ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে শুরু হয়েছে। কলকাতায় শেষ ৫ জানুয়ারি। বিশ্ব জুড়ে নানা শহরে এমন দ্বিবার্ষিক শিল্পকলা উৎসবের আসর এক ধরনের সাংস্কৃতিক পরিচয়। পথ দেখিয়েছিল ইটালির ‘ভেনিস বিয়ানেলে’। এই উৎসবের অন‍্যতম ট্রাস্টি গেমপ্ল্যানের মালবিকা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় ইতালীয় টানে ‘বিয়ানেলে’ বলতেই ভালবাসেন। কোচিতে ভারতের প্রথম বিয়েনেলও চলছে এক যুগের বেশি। “কিন্তু বাংলাই দেশের আধুনিক যুগের শিল্পকলাচর্চার আঁতুড়ঘর! এখানে কিছু একটা শুরু করতেই হত”, বললেন মালবিকা।

শিল্পভাষার জন্মগাথা মানে আবার নানা ভাষার মোহনারও গল্প! অবন ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’ নিয়ে এত কথা হয়, নেপথ‍্যে জাপানি ওয়াশের প্রভাব নিয়ে তত হয় না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে অনেক দিন বাদে অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ আর আরব‍্য রজনীর ছবিগুলি দেখা যাবে। সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথ ও তাঁদের বোন সুনয়নী দেবীর ছবিও। সুনয়নী থেকে শানু লাহিড়ী, যামিনী রায়, চিত্তপ্রসাদ, নীরদ মজুমদার, কেজি সুব্রহ্মণ‍্যম থেকে পরেশ মাইতি, জয়শ্রী চক্রবর্তী, ছত্রপতি দত্তদের ছুঁয়ে বাংলার আগামীর প্রতিভাদের ছোঁয়াচ থাকছে নানা আসরেই। যোগেন চৌধুরী, আর শিবকুমারেরা রয়েছেন নেপথ‍্যে। প্রবীণ শান্তিনিকেতনপ্রেমী শিল্পী সুধীর পটবর্ধন দারুণ খুশি, “যাক্ দু’বছর অন্তর শান্তিনিকেতনে আসার ছুতো পেয়ে গেলাম!”

কলাভবনের কৃতী প্রাক্তনীরা অনেকেই এ শীতে শান্তিনিকেতন, কলকাতার প্রদর্শনী আসরে ফিরছেন। আলিপুর জেল মিউজিয়মের কুঠুরিতে ইতিহাস ও সমকালের সংঘাত নিয়ে শীলা গৌড়ার স্থাপনা শিল্প। সোমনাথ হোরের স্টুডিয়োয় শ্রমিক আন্দোলন, কারিগরদের অধিকার, পরিযায়ীদের আখ‍্যান নিয়ে প্রদর্শনীতে অর্চনা হান্ডে, শমিত দাসেরা। গবেষণাধর্মী শিল্পী মিঠু সেন বলছিলেন, “কলাভবন ছাড়ার তিন দশক বাদে এই প্রথম শান্তিনিকেতনে আমার কাজ এল। বিয়েনেলের জন‍্যই ঘটল!” পিয়ার্সন পল্লির সাঁওতালদের ঘরগুলো প্রাকৃতিক রঙে অলচিকি লিপিতে লেপে দিয়েছেন মিঠু, তাঁর বন্ধু সন্ন‍্যাসী লোহার, স্থানীয় সহযোগীরা। ভাষা বা অক্ষর বরাবরই মিঠুর কাছে একটা অস্ত্র। সাঁওতাল পল্লিতে সাঁওতালদের মাতৃভাষার আশ্রয় ফিরিয়ে দিলেন তাঁরা।

শিল্পভাষার মধ‍্যে আঙ্গিকের বর্ডার, চেকপোস্টও উড়িয়ে দিচ্ছে এই বিয়েনেল। গাবায় বৃত্তের দরজিখানার পাশেই হুগলির পুড়শুড়ার তরুণী ওহিদা খন্দকারের ‘স্বপ্নের জাদুঘর’। গ্রাম বাংলার গেরস্থালিতে কয়েক প্রজন্মের জমানো আসবাব, তৈজসপত্র থেকে পুরনো চিঠিও জাদুঘরের গল্প শোনায়। মিনিয়েচার আর্ট শিল্পী ওহিদা এই কাজটা করেছেন সিনেমার ভাষায়। তাঁর ছোট্ট ছবি লন্ডনে ভিক্টোরিয়া অ‍্যালবার্ট মিউজিয়মে সদ্য জামিলস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। খামখেয়ালি বৃষ্টিতে জলজ শান্তিনিকেতনের ছবি দর্শকদের সামনে এঁকে বিশ্বের উষ্ণায়নের শঙ্কা বুঝিয়েছেন নিখিল চোপড়া। জল ও জীবনের কথা বলতে শান্তিনিকেতনে আসছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ভাষ্যের সঙ্গে গ্রাফিক নভেল লেখক সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির সংলাপের নাম ‘জলের কথা। পার্ক স্ট্রিটের ট্রিঙ্কাজ মাতানো কিবোর্ড, পিয়ানিস্ট লুইজ ব্যাঙ্কসের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী আসর ট্রিঙ্কাজেই। কলকাতার জাদুঘরে প্রয়াত বন্ধু রাশিদ খানকে নিয়ে আলোকচিত্র শিল্পী দয়ানিতা সিংহের উপস্থাপনার জন‍্যও অপেক্ষা তীব্র হচ্ছে। শান্তিনিকেতনের ‘কাঁথা ঘরে’ কাঁথার ক‍্যানভাসে স্থানীয় শিল্পীদের গল্প। মৌলালির জোড়া গির্জায় মাধবী পারিখের বিনির্মাণে ‘দ‍্য লাস্ট সাপার’-এর পটে নানা সংস্কৃতির মিশেল।

কলকাতার দুর্গাপুজোর মণ্ডপ শিল্পেও অনেকে বিয়েনেলের ছাপ দেখেন। নাকতলার পুজোয় রিফিউজি পাড়ার মেয়েদের স্মৃতি নিয়ে শিল্পী প্রদীপ দাসের একটি কাজও আর্ট একরে দেখা যাবে। বাঙালির শীতযাপনের সঙ্গে বিয়ের হিড়িক প্রতি বছরের রীতি। দু’বছর অন্তর বিয়েনেলে নানা শিল্প ঘরানার বিবাহও সম্ভবত নতুনের স্বাক্ষর বয়ে আনবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Shantiniketan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy