Advertisement
E-Paper

রামের নগরী যেন দুর্গের ঘেরাটোপে থাকা ‘পীতাম্বরী’ নববধূ

সবুজ থেকে খাঁকি, খাঁকি থেকে গেরুয়া— এই ভাবে গৈরিকীকরণের দিকে এগোল অযোধ্যায় মোদী-যোগীদের মেগা ইভেন্টের প্রস্তুতি।

আলোয় সেজে উঠেছে অযোধ্যা। ছবি: পিটিআই।

আলোয় সেজে উঠেছে অযোধ্যা। ছবি: পিটিআই।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২০ ২৩:২৫
Share
Save

গন্তব্যে নাকি প্রায় পৌঁছে গিয়েছে উড়ান, ঘোষণা অন্তত তেমনই হচ্ছিল। কিন্তু, বাইরে তার কোনও আভাস নেই। লখনউয়ের আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। মেঘের নীচে লখনউ রয়েছে, নাকি লিলুয়া, বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই।

দ্রুত কমছিল উচ্চতা, পাতলা হচ্ছিল মেঘের পরতও। আর মেঘ সরে লখনউ শহরটা দেখা দিতেই জুড়িয়ে গেল চোখ। সবুজে সবুজ চারধার। তার বুক চিরে বিসর্পিল রেখার মতো শুয়ে থাকা নদী পলিরঙা জলে টইটম্বুর। আর চারধার অদ্ভুত নির্মল।

চৌধুরি চরণ সিংহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে বেরতেই বোঝা গেল সদ্য বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে ঝেঁপে। একে প্রধানমন্ত্রীর আশু সফরের জন্য সাফ-সাফাইয়ে বেজায় জোর, তার উপরে আবার সদ্য সব ধুয়ে দিল মুষলধারা। আকাশ থেকে লখনউকে দেখে কেয়ারি করা বাগিচা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সকালের রঙে অভিভূত হয়ে বুঝে ওঠাই যায়নি যে, দিনভর রঙের খেলাই দেখতে হবে। বুঝে ওঠা যায়নি যে, নবাবি শহর থেকে মহাসড়ক যত এগোবে অবধপুরীর দিকে, ততই নতুন নতুন রং ধরা দেবে গোটা যাত্রাপথ জুড়ে।

অযোধ্যা জুড়ে গেরুয়া পতাকা আর প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার। নিজস্ব চিত্র।

লখনউ মেঘলা ছিল বটে। কিন্তু শহরের সীমানা শেষ হতেই বদলে গেল আবহাওয়া। বারাবাঁকি বেশ রোদ ঝলমল, উজ্জ্বল। আরও উজ্জ্বল ২৫-৩০ কিলোমিটার অন্তর তৈরি হওয়া পুলিশ চেকপোস্টে খাঁকি উর্দির উত্তুঙ্গ তৎপরতা। গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ— কোথা থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন, কী কাজ? প্রয়োজনে আধার দেখতে চাওয়া। অর্থাৎ সবুজ লখনউ পেরিয়ে খাঁকি বারাবাঁকি। আর বারাবাঁকির সীমানা শেষ হতেই শুরু হচ্ছে ‘জিলা অযোধ্যা’। সেখানে কোন রং-টা নেই!

আরও পড়ুন: ভূমিপুজোয় ১৭৫ জন নিমন্ত্রিত, ৪০ কেজি রূপোর ইট দিয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন মোদী

মহাসড়কের দু’ধারে যেখানেই লোকালয়, সেখানেই ছাদে-ছাদে পতপত উড়ছে গেরুয়া পতাকা। হনুমানের ছবি আঁকা পতাকা, রামচন্দ্রের ছবি আঁকা পতাকা, জরির পাড় দেওয়া পতাকা, ছোট তেকোনা পতাকা, বড় আয়তাকার পতাকা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘ওঁ’ লেখা পতাকা, আরও কত! ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে কোথাও দৌড়ে গ্রামের ভিতর দিকে ঢুকে যায় জনা বিশেক হাফপ্যান্ট-বয়সি। কোথাও সদ্য যুবারা বাইক র‌্যালির প্রস্তুতিতে মশগুল। আর এই গোটা রাস্তার দু’ধার জুড়ে, মাঝের ডিভাইডার জুড়ে, সার সার ল্যাম্পপোস্ট জুড়ে যেন গেরুয়া ব্যানারের কনভয়। সব ক’টাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত জানিয়ে। কয়েকটাতে মোদীর সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও। কোনও ব্যানারের সৌজন্যে অযোধ্যার সাংসদ লল্লু সিংহ, কোনওটা বিকাপুরের বিধায়ক শোভা সিংহ চৌহানের দেওয়া, কোনওটা অযোধ্যার মহাপৌর (পুরপ্রধান) ঋষিকেশ উপাধ্যায়ের নামে, কোনওটা অযোধ্যা ধামের বিধায়ক বেদপ্রকাশ গুপ্তর ছাপানো।

নিরাপত্তার বলয়ে অযোধ্যা, জায়গায় জায়গায় চলছে নাকা চেকিং। ছবি- পিটিআই।

এই পর্যন্ত জেনে মনে হতে পারে, সবুজ থেকে খাঁকি, খাঁকি থেকে গেরুয়া— এই ভাবে গৈরিকীকরণের দিকে এগোল অযোধ্যায় মোদী-যোগীদের মেগা ইভেন্টের প্রস্তুতি। কিন্তু আগেই বলেছি, অযোধ্যায় যে কোন রং-টা নেই, সেটাই খুঁজে দেখার বিষয়। লোকসভা নির্বাচনের হাওয়া খতিয়ে দেখতে বছরখানেক আগেই অযোধ্যায় ঢুঁ মারতে হয়েছিল। কিন্তু এক বছর আগের অযোধ্যা আর এ অযোধ্যাকে মেলানো যাচ্ছে না। চেনা যাচ্ছে না যমজ শহর ফৈজাবাদকেও। রাস্তাঘাট তকতকে, আগের চেয়ে অনেক চওড়াও। মূল রাস্তা থেকে নেমে যে গলিপথ হনুমানগঢ়ীর দরজা ছুঁয়ে ডাইনে বেঁকে চলে যায় সীতা রসোইয়ের দিকে, সেই চিরঘিঞ্জি গলিও যেন সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলেছে। কালো অ্যাসফল্টের দু’ধারে সমান্তরাল সাদা সিলিকন রেখা। সে রেখার দু’ধারে কংক্রিটের ফুটপাথ। ফুটপাথের কিনারা বরাবর পাকা নর্দমা। আর নর্দমার দু’পার বরাবর দোকানপাটের সারি যেন কুচকাওয়াজের শৃঙ্খলায় দাঁড়িয়ে। মাত্র এক বছর আগে অন্য ছবি ছিল। ফুটপাথ বা নর্দমা খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়েই দেওয়া যাক, রাস্তার ন্যায্য প্রস্থটাও রাস্তার দখলে ছিল না। হনুমানগঢ়ীতে বা রামজন্মভূমিতে পুজো দেওয়ার জন্য পেড়া-লড্ডু-সহ নানা উপকরণের পসরা আগ্রাসী হয়ে উঠত, অপ্রশস্ত গলি আরও সঙ্কীর্ণ হয়ে যেত। সোমবার সেই রাস্তায় কনভয়ের আনাগোনা। থমকে থমকে নয়, অবাধ গতিতে। তা-ও আবার পথচারীদের জন্য প্রায় কোনও অসুবিধা তৈরি না করে।

সেজে উঠেছে অযোধ্যার দেওয়াল। ছবি- পিটিআই।

রামের নগরীর যে কোনও প্রান্তে দাঁড়িয়ে যে দিকে খুশি তাকালেই যে এখন অজস্র গেরুয়া পতাকার সমাহার চোখে পড়বে, সে কথা অযোধ্যায় না এসেও যে কেউ বলতে পারবেন। কিন্তু অযোধ্যায় এলে তার সঙ্গে দেখতে পাবেন, কী ভাবে দূর্গপ্রাকারের চেহারা নিয়েছে গোটা শহরটা। মোড়ে মোড়ে নাকা, রাস্তার দু'ধার জুড়ে পুলিশের নানা আকারের গাড়ি, দিনভর শশব্যস্তে ছুটে বেড়াচ্ছে অজস্র লালবাতি-নীলবাতি, নিরাপত্তা বাহিনী নানা রাস্তায় টহল দিচ্ছে রুটমার্চের কায়দায়। অযোধ্যার আকাশ বায়ুসেনার কপ্টারের দখলে। সাকেত কলেজের মাঠে বুধবার নামবে প্রধানমন্ত্রীর কপ্টার। তাই মক ড্রিল সেরে নিচ্ছে বাহিনী। কিন্তু উর্দির একঘেয়েমি ছাপিয়ে চোখের শান্তি এনে দিচ্ছে সরযূ ঘাটের রোশনাই। সন্ধে নামতেই সাতরঙা আলোর বাহার সরযূর অট্টালিকা সজ্জিত একের পর এক ঘাটে। আর দিনের বেলায় গোটা শহর জুড়ে হলুদের বাহার। রামজন্মভূমি হোক বা হনুমানগঢ়ী, নির্মোহী আখড়া হোক বা মন্দির তৈরির কর্মশালা, যে মূল রাস্তার দু’ধার বরাবর অযোধ্যার এই আধ্যাত্মিক ভরকেন্দ্রগুলোর অবস্থান, সেই চক অযোধ্যা রোডে ঢুকলে চোখে ধাঁধা লাগার উপক্রম হবে। সরষে ক্ষেত যেমন ধাঁধা লাগায়, তেমনই আর কি। রাস্তার দু’ধার বরাবর যত দোকানপাট, যত বাড়ি, যত পাঁচিল, সব রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে হলুদে। স্থানীয় রামভক্তদের ভাষায়, ‘‘প্রভু রামের নগরীকে পীতাম্বরী করে তোলা হচ্ছে।’’

কেন পীতাম্বরী? এর তাৎপর্য কী? স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, জ্যোতিষী এবং পুরোহিতদের পরামর্শেই এই বন্দোবস্ত অযোধ্যা পুরসভার। কিন্তু কেন এমন পরামর্শ? মহাপৌর ঋষিকেশ উপাধ্যায়ের কথায়— হলুদ রং হল মাঙ্গলিক রং, যে কোনও পূজাপাঠ বা শুভ কাজের আগে হলুদ রং ব্যবহার করা হয়। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে পথ দিয়ে যাবেন, সেই পথের দু’ধার এখন পীতবরণ। জ্যোতিষিদের ব্যাখ্যা, ‘‘হলুদ রঙের সঙ্গে বৃহস্পতির সংযোগ রয়েছে। সূর্যের উজ্জ্বলতম অংশের রং-ও হলুদ। এই রং ইতিবাচক শক্তির জন্ম দেয়।’’

এই সুসজ্জিত তোরণের ভিতরেই রাম মন্দিরের কার্যশালা। পাথর কেটে কেটে তৈরি করে রাখা হচ্ছে মন্দিরের নানা অংশ। নিজস্ব চিত্র।

সবুজ, খাঁকি, গেরুয়া পেরিয়ে হলুদে পৌঁছেই শেষ হতে পারত রঙের উপাখ্যান। কিন্তু হল না। হতে দিলেন না চম্পত রায়। রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের মহাসচিব চম্পত রায় আবার সবুজেই ফেরত পাঠালেন গল্পটাকে। ভূমিপূজন এবং শিলান্যাস কর্মসূচি যতক্ষণ না মিটছে, ততক্ষণ চম্পত কিন্তু অযোধ্যার হাতেগোনা ভিভিআইপিদের এক জন। তাই চম্পত সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেই হু হু করে ছুটে যাচ্ছে অবধের ছোট্ট শহরটায় গোটা ভারত থেকে এসে জড়ো হওয়া মিডিয়া। সোমবার বিকেলে তেমনই এক সাংবাদিক সম্মেলনে সবুজের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করলেন চম্পত। যোগী আদিত্যনাথ আগেই বলেছিলেন যে, গত ৫০০ বছরে এমন শুভ সময় আর আসেনি। পরে রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিত সত্যেন্দ্র দাসও সেই মন্তব্যকে সমর্থন করেছেন। বলছেন, ‘‘৫০০ বছরের লড়াই শেষে ভগবান রামের মন্দির তৈরির সূচনা হতে চলেছে। এতে একটা প্রসন্নতা তৈরি হয়েছে। আর এই রকম প্রসন্নতা যে সময়ে তৈরি হয়, সে সময় শুভ সময় ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না।’’ ঠিক সেই সুরে চম্পত রায় এ দিন সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সুবজ রঙের দিকে। ‘চারপাশ সবুজে সবুজ হয়ে গিয়েছে’, সেটা সবাই খেয়াল করছেন কি না জানতে চাইলেন। তার পরে বিশ্লেষণ করে বললেন— প্রকৃতি যে ভাবে সবুজে মুড়ে দিয়েছে চারিধার, তা সুসময়ের সঙ্কেতই বহন করছে।

আরও পড়ুন: ‘আমি তো শুধু রামলালার পূজারী’! বললেল ‘বিষণ্ণ’ প্রধান পুরোহিত!

কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতার ব্যাখ্যা যদি এখানেই থেমে যায়, তা হলে তো রামরাজ্য প্রায় প্রতিষ্ঠা হয়েই গিয়েছে বলে ধরে নিতে হয়। অতএব ব্যাখ্যা এখানে থামে না, থামে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে। সবুজ রং পুর্ণবৃত্তের আকার তো নেয়ই। কট্টরবাদকেও পুর্ণবৃত্তে পৌঁছে দিয়ে চম্পত রায় বলেন, ‘‘সবুজ রং ইসলামের রং নয়। সবুজ হল সমৃদ্ধির রং।’’

Ayodhya Ram Mandir Narendra Modi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।