সন্তানধারণের পরিকল্পনা শুরুর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গেলে প্রথমেই তাঁরা দেহের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখতে বলেন। —প্রতীকী চিত্র।
ফেসবুক জুড়ে অজস্র গ্রুপ। কোনওটা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বীকারোক্তির, কোনওটায় বা মেয়েদের শরীর-মনের যত্ন, চাকরি ও সংসার সামলে চলার রকমারি টিপস। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রতিটা গ্রুপেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে, সেই প্রশ্ন মাত্রাতিরিক্ত ওজন, পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম) এবং সন্তানধারণ সংক্রান্ত। প্রশ্নের তলায় কমেন্ট থ্রেডে চলে আলোচনা, ডাক্তার ও চিকিৎসার সুলুক-সন্ধান। চোখ-কান খোলা রাখলে বোঝা যায়, বর্তমান জীবনযাপনে ও সন্তানধারণে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিতে পারে অতিরিক্ত ওজন ও পিসিওএস।
সন্তানধারণের পরিকল্পনা শুরুর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গেলে প্রথমেই তাঁরা দেহের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখতে বলেন। চিকিৎসকেরা এ বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত যে শরীরে জমা মেদ বিভিন্ন হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে, যা সন্তানধারণে বাধা দেয়। এ ছাড়াও শারীরিক নানা জটিলতায় হবু মা ও ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে।
সন্তানধারণের আদর্শ ওজন
অবস্টেট্রিশিয়ান-গাইনিকলজিস্ট ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “মানুষের ওজন নির্ভর করে তার দেহের উচ্চতা ও গঠনের উপর। শরীরের বডি মাস ইনডেক্স তথা বিএমআই হিসেব করে বোঝা যায় ওজন বেশি না প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনলাইনের যে কোনও বিশ্বাসযোগ্য সাইটের বিএমআই টেবলে নিজের উচ্চতা ও ওজন দিয়ে এই হিসেব করা যায়।” বিএমআই যদি স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয় তা হলে আন্ডারওয়েট। যদি বেশি হয় তা হলে সেই অনুসারে ওভারওয়েট বা ওবিস বলে।
স্বাভাবিক বিএমআই
অবস্টেট্রিশিয়ান-গাইনিকলজিস্ট চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলছেন, “সাধারণত ১৮.৫ থেকে ২৪.৫-এর মধ্যে বিএমআই এলে সেটিকে স্বাভাবিক বিএমআই ধরা হয়। এই বিএমআইয়ের মানুষদের ওজন থাকে নিয়ন্ত্রিত। শরীর থাকে সুস্থ ও সন্তানধারণের উপযুক্ত। ১৮.৫-এর কম যদি বিএমআই হয়, তা হলে স্বাভাবিকের থেকে ওজন কম। ২৫ থেকে ২৯-এর মধ্যে হলে ওভারওয়েট এবং ৩০ পেরিয়ে গেলে অবশ্যই ওবিস। সেক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে ওজন কমানোর।” চন্দ্রিমার কথায়, হবু মায়ের অতিরিক্ত ওজন গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, শরীরে কোনও ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুদের মায়েদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। ওবিসদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব, মিসক্যারেজ ও কিছু ক্ষেত্রে গর্ভে শিশু মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
সন্তানধারণে ওজন কী ধরনের প্রভাব ফেলে?
অভিনিবেশ বললেন, “সন্তানধারণে বেশি ওজন, কম ওজন অনেক সময়েই কোনও প্রভাব ফেলে না, আবার অনেক সময়ে গুরুতর প্রভাব ফেলে। তাই ঠিক ওজনে এসে সন্তানধারণই বাঞ্ছনীয়। ওজনের হেরফেরে সমস্যা দেখা দেয় ওভিউলেশন তথা ডিম্বস্ফোটনে। মাসের নির্দিষ্ট সময়ে মহিলাদের ডিম্বাশয় থেকে পরিণত একটি এগ বা ডিম্বাণু বা ওভাম নির্গত হয়। একে ওভিউলেশন বলে। ওজন বেশি বা কম থাকলে ডিম্বাশয় থেকে পরিণত ডিম্বাণু নির্গত হতে পারে না। মাসিক চক্র অনিয়মিত হতে শুরু করে।”
চন্দ্রিমার কথায়, “অতিরিক্ত ওজন যে শুধু ফার্টিলিটি তথা সন্তানধারণের ক্ষমতাকে প্রতিহত করে তা নয়, গর্ভাবস্থাতেও প্রভূত ক্ষতি হতে পারে মায়ের। আমাদের শরীর হরমোন নিয়ন্ত্রিত। ওজন বেশি হলে সেই হরমোন ক্ষরণ ঠিক ভাবে হয় না। ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হওয়া বন্ধ হয়ে যায়, একে বলা হয় অ্যানোভিউলেশন।” যাদের অতিরিক্ত কম ওজন, অর্থাৎ বিএমআই ১৮.৫ বা তার কম, তাদের ক্ষেত্রে তো ওভিউলেশন অনিয়মিত হয়ে যায়। ওবিস তথা মাত্রাতিরিক্ত ওজন যাদের তাদের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয় ডিম্বস্ফোটনে।
অভিনিবেশ এ-ও জানালেন, অনেকের অতিরিক্ত ওজন সত্ত্বেও মাসিক চক্র ও ডিম্বস্ফোটন ঠিক থাকে। তা-ও সন্তানধারণে সমস্যা হয়। তখন নজর দিতে হবে ওজন বেশি হওয়ার অন্য সমস্যা তথা থাইরয়েড, ইনসুলিন রেজ়িন্ট্যান্স ও ডায়াবিটিসে। প্রসঙ্গত, ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স পিসিওএসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।
ওবেসিটি ও গর্ভধারণের সমস্যা
বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে ওজন বেশি হলে বেশির ভাগের সন্তানধারণে সমস্যা হয়। এমনকি, ওবেসিটি থাকলে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজ়েশন পদ্ধতিতে সন্তানধারণেও সাফল্য আসে দেরিতে। এ ছাড়া, মিসক্যারেজ, জেস্টেশনাল ডায়াবিটিস ও উচ্চ রক্তচাপ তথা প্রি-এক্ল্যাম্পশিয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায়। ওজন বেশি থাকলে নর্মাল ডেলিভারি হয় না বললেই চলে।
চন্দ্রিমা জানালেন, দেখা গিয়েছে যদি পাঁচ শতাংশও ওজন কমানো যায় তা হলেই মাসিক চক্র ও ওভিউলেশন অনেকটা ঠিক হয়ে যায়। তবে, সেই ওজন ক্র্যাশ ডায়েট বা প্রবল এক্সারসাইজ়ের মাধ্যমে কমালে হিতে বিপরীত। পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ধীরে ধীরে কমানোই ভাল। এর কারণ, শুধু ওজন কমিয়ে ফেললেই হবে না, কম ওজন বজায়ও রাখতে হবে। দিনে ২০ মিনিট ব্রিস্ক ওয়াক করতেই হবে।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম
অভিনিবেশ ও চন্দ্রিমা জানালেন, বর্তমানে ৮ থেকে দশ শতাংশ মহিলা ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স ও পিসিওএসে আক্রান্ত হন। এটি মূলত লাইফস্টাইল ডিজ়িজ়। তবে, পিসিওএসে পলিসিস্টিক কথাটি থাকলেও ক্যানসার বা টিউমরের সিস্টের সঙ্গে এর মিল নেই। চন্দ্রিমার কথায়, ওভারির উপর ঘামাচির মতো অপরিণত ডিম্বাণু জমা হয়। সেখান থেকেই এই নাম। নামে সিস্ট রয়েছে মানেই অপারেশন করতে হবে, এমন নয়। তবে, পিসিওএসের মোকাবিলার ‘গোল্ডেন রুল’ হল ওজন কমানো। তার জন্য সেডেন্টারি লাইফস্টাইল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শারীরচর্চা, সুষম খাদ্যাভাস মেনে চললে সমস্যা মিটবে অনেকটাই। সঙ্গে নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ।
ঠিক ওজন ও বিএমআই
অভিনিবেশ বললেন, “চিকিৎসক ওজন কমাতে বললে পুষ্টিবিদের পরামর্শে ঠিক খাদ্যাভাস পালন ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ব্যায়াম করতে হবে। পাশাপাশি, কোনও কারণে সন্তানধারণে সমস্যা হলে যথাযথ চিকিৎসা করতে হবে। ধীরে ধীরে কমবে ওজন, স্বাভাবিক হবে বিএমআই, নিয়মিত হবে ওভিউলেশন। তবে, বয়স ও বিএমআই ৪০ পার হলে বেরিয়াট্রিক সার্জারি করে ওজন কমানো সমীচীন।”
শরীরের মধ্যে তিল তিল করে একটি প্রাণ বেড়ে উঠুক, স্বপ্ন অনেকেরই। সেই প্রাণকে লালন করতে, আগে যত্ন নিতে হবে নিজের। ওজন কমানো সেই যত্নেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy