Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Bengali Rock Music

‘সঙ্গীতের বীভৎস রূপকে বাঙালি পাত্তা দেয়নি, গানের সেই ছিন্নমস্তাই এখন দুই বাংলার রক’

ধানমন্ডির এক কিশোর, যার বাবা পাঁচ ওয়ক্ত নমাজি, বা কল্যাণীর কোনও কচুরির দোকানের মালিকের ছেলে রক গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখে কী করে? এই স্পর্ধা তাকে দেখায় কে? বাংলার রক-জগতের যাপন ঠিক কেমন?

রক যাপনের প্রিয় বিষয়ই হল মানুষ। যত মানুষ, তত বৈচিত্র, যত প্রেম, তত ভাঙন।

রক যাপনের প্রিয় বিষয়ই হল মানুষ। যত মানুষ, তত বৈচিত্র, যত প্রেম, তত ভাঙন। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।

সাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
সাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:০১
Share: Save:

“গানবাজনা করে পেট চলবে? তা-ও আবার রক নাকি একটা গান! আমাদের পরিবারে গানবাজনা করে না, এটা হারাম, শয়তানের সঙ্গীত।”

উপরের পঙ্‌ক্তিগুলি হল দুই বাংলার সর্বোচ্চ পারিবারিক বিরোধের নমুনা, পশ্চিমবঙ্গে যা প্রধানত আর্থ-সামাজিক চিন্তা, বাংলাদেশের সেই চিন্তা শুরু হয় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই দুই পারের বাংলা মৌলিক গানের ধারায় রক সঙ্গীতের প্রায় ছয় দশকের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও আজও শিল্পীদের রকযাপনে বাধা হয়েছে প্রধানত ধর্ম এবং অর্থ। পরিবেশের দোহাই লাগে না, রক সঙ্গীত প্রতিকূলতা থেকেই জন্মায়, প্রতিকূলতা ছাড়া রক-চিন্তা বিকশিত হয় না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে খালি গ্রেনেডের বাক্স বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রকস্টার হবেন।

গৌতম  চট্টোপাধ্যায়, এ বাংলায় যাঁর হাতে প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল রকসঙ্গীত।

গৌতম চট্টোপাধ্যায়, এ বাংলায় যাঁর হাতে প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল রকসঙ্গীত। ছবি: সংগৃহীত।

সেই যুদ্ধ যাপন তাঁর ভিতর বুনে দিয়েছিল ‘রক-বোধ’, সেই তরুণ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি আজ়ম খান, বাংলাদেশি রকের আদি পিতা। প্রায় সমসময়েই উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া এক তরুণ জন্ম দিয়েছিলেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলির’ মতো ব্যান্ডের। তিনি গৌতম চট্টোপাধ্যায়, এ বাংলায় যাঁর হাতে প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল রকসঙ্গীত। ‘বিটল্‌স’, ‘লেড জ়েপেলিন’ অথবা ‘রোলিং স্টোন্‌স’-এর মতো পাশ্চাত্য রক মিউজিকের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের হাত ধরে অথবা অনুপ্রেরণায় জন্ম নিয়েছিল এক দর্শন— সেক্স, ড্রাগস অ্যান্ড রক এন রোল।

বিটল্‌স।

বিটল্‌স। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু ধানমন্ডির এক কিশোর, যার বাবা পাঁচ ওয়ক্ত নমাজি বা কল্যাণীর কোনও কচুরির দোকানের মালিকের ছেলে সেই স্বপ্ন দেখে কী করে? এই স্পর্ধা তাকে দেখায় কে? তারা স্বপ্ন দেখে, কারণ তারা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়, চায় জেমসের মতো মঞ্চে উঠে হুঙ্কার দিতে , ‘আমি মাস্তানা, আমি দিওয়ানা’ অথবা প্রথম প্রেমের বিরহে বলতে চায় ‘শুধু তুমি এলে না’, শহরের কোন এক বাইপাসে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে ‘জীবন চলছে না আর সোজা পথে’…। পশ্চিমবঙ্গের মেয়েটা যখন বেস প্লেয়ার হতে চায়, তখন ঢাকায় বেইজ-বাবা সুমন ক্যানসারকে অনেক বার হারিয়ে স্ক্রু লাগানো মেরুদণ্ড নিয়ে এসে দাঁড়ান মঞ্চে… ওঁকে গাইতেও হয় না, পুরোটাই প্রায় দর্শকেরা গান, তিনি বাজান, এই দুই বাংলা দখল হয় রকযাপনে। এই যাপন আসলে তিন পর্যায়ে আসে বলে মনে হয়— প্রথম, আমি কী এবং কেন? দ্বিতীয়ত, আমি কী ভাবি আর কী প্রকাশ করি, তৃতীয়ত এবং শেষ পর্যায় যার ভিতর মূলত রকার অথবা রকস্টার প্রধানত নিজেরা আশ্রয় নেন, তা হল বদলে দেওয়ার চিন্তা। নিজেকে জাগতিকতা থেকে সুকৌশলে আলাদা করে দেওয়া। নিভৃতে চলে গান শোনা, নানা রকমের শারীরিক এবং সাঙ্গীতিক শৃঙ্খলা এবং বিবিধ ভাবনা। রকযাপন যেমন লিখিয়ে নিয়েছে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে’, আবার সেই যাপনই লিখিয়েছে ‘কেউ ভাবে মনের খবর যাচ্ছে উড়ে ঢাকনা দে/ কেউ ভাবে উড়তে হবে কাঁধে দুটো পাখনা দে’।

সঙ্গীতের বিরহরূপ, শৃঙ্গার বা ভক্তিভাব যে কিসিমে দুই পারের বাঙালির কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য, তা একটি বাক্যে বলতে গেলে দাঁড়ায়— ‘গানটায় মেলোডি আছে’। সঙ্গীতের বীভৎস রূপকে বাঙালি এক প্রকার পাত্তাই দেয়নি। কিন্তু, সেই রূপও তো আছে! সেই সাঙ্গীতিক ছিন্নমস্তাই আজকের বাংলা রক। মৌলিক গানের ধারা খরাক্রান্ত হলেও তার উপশাখা কিন্তু ফাটল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সামাজিকতার চালচিত্রে। লালন সাঁই বা আব্দুল শাহ করিমের আউলিয়া, সুফি, বাউল-বাদের সঙ্গীত দর্শন ও যাপন আজ আপনার ঘরের কোণে বড় হচ্ছে। মনে হতেই পারে, অতটা গোছানো নয় এই যাপন, সাফসুতরোও নয়, কিন্তু দর্শন ব্যাপারটা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো কবেই বা ছিল! সে বাড়ি-গাড়ির কিস্তি বা প্রেমিকার জন্মদিন নিয়ে কি আদৌ ভাবে? বরং সে তার ব্যক্তিগত রাধার ফোনালাপে জ্যাজ়ের ছন্দ খুঁজে পায়। সে আটকাতে চায় না কোনও আবেগেই। কারণ, রকযাপনের প্রিয় বিষয়ই হল মানুষ। যত মানুষ, তত বৈচিত্র, তত প্রেম, তত ভাঙন। সেখানে নানা আবেগের জাগলারি রেডিয়ো নেই, অনুষ্ঠান নেই, হল অফ ফেম নেই, পেনশন নেই। শহরের পাব-এ পাব-এ, নিজের মাতৃভাষার রাজ্যে রিজিয়োনাল নাইট হিসেবে সপ্তাহে একটা জায়গা খোঁজা রকার কোনও কিছুতেই দমে না পশ্চিমবঙ্গে। আবার বাঙালির দেশ বাংলাদেশে প্রচার আছে, প্রসার আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আছে পরিকাঠামোর অভাবও।

‘ক্যাকটাস’-এর কথা ফলে যায় ‘নিঝুম শহরের ছাদে বিপন্ন রকবোধ কাঁদে’।

‘ক্যাকটাস’-এর কথা ফলে যায় ‘নিঝুম শহরের ছাদে বিপন্ন রকবোধ কাঁদে’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

‘নেমেসিস’-এর মতো রকব্যান্ডের সদস্য যখন ‘রক সঙ্গীত হারাম’ বলে ফেসবুক পোস্ট দেন, তখন ‘ক্যাকটাস’-এর কথা ফলে যায় ‘নিঝুম শহরের ছাদে বিপন্ন রকবোধ কাঁদে’, তখন আমাদের মতো জন্ম-রকাররা ‘লক্ষ্মীছাড়া’র গানের মতো পালিয়ে বেড়ায়, দেশ থেকে দেশে, সিলেট থেকে সামপ্লেস এল্‌স-এ। শোনায় রকযাপনের বীরগাথা, অবিশ্বাস্য সব গান মুহূর্তে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। গুরু ম্যাক, আয়ুব বাচ্চু থেকে ‘অভিলাষা’, ‘ফসিল্‌স’। এর পরেই শেষ ট্রেনে ফিরে যাবে তারা, অপেক্ষা করবে আবার কবে মানুষ ডাকবে, তাদের মাথার উপর ‘সফল এক শতাংশের’ সদস্য আমি উড়ে যাব দুই বাংলার আলোকিত বর্ডার দেখতে দেখতে, কান্নাচোখে কালো সানগ্লাসে চোখ ঢেকে। আরও দৃঢ় হবে এই চেতনা— যে ভাষা দেশ স্বাধীন করে, সে অডিটোরিয়াম ভরাতে পারে না এই কথা আজম খান, গৌতম চট্টোপাধ্যয়, শিলাজিৎ, জেমস, রূপম ইসলাম, গুরু ম্যাক, সাফিন আহমেদ, সিধু, গাবুর বাংলা কোনও দিন বিশ্বাস করেনি এবং করবেও না। তার চেয়ে বরং ‘কাম অন বেবি, লাইট মাই ফায়ার’।

জেমস।

জেমস। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

শিল্পীর একা হয়ে যাওয়া বা নীরবতা অবলম্বন করার অনেক কারণ থাকে। প্রচুর প্রত্যাখ্যান তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এই ক্লিশে বিষাদ-বিলাস আসলে বাস্তব নয়! বরং প্রত্যাখ্যান তত ক্ষণই থাকে যত ক্ষণ না তা অর্জিত হচ্ছে, আর থাকে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলা। শুভানুধ্যায়ীরা, যাঁরা ফ্রি পাস চান (সবাই নন), তাঁদের বোঝানো যায় না, শোয়ের ভেন্যুতে জলও বাড়তি দামে কিনে খেতে হয়। সেখানে পাস বা টিকিট কেনার ভিতরেই থাকে আসল গৌরব।

বাংলাদেশের যন্ত্রপাতির দাম প্রায় তিনশো গুণ। তাই সেখানে অনেকগুলো বড় ভাইয়ের হাত ঘুরে আসা কোনও এক ব্র্যান্ডের গিটার অ্যাফোর্ড করা সম্ভব হয়। যেখানে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের রক-শিল্পীরা অনেকটাই বাজারচলতি দামে কিনতে পারেন। বাংলাদেশে বরাবরই রক সঙ্গীত একটু আমেরিকান রক ঘেঁষা। যেখানে মাস্‌ল বেশি, সঙ্গীত আয়োজনে মনোযোগ বেশি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রক অনেক বেশি লিরিক্যাল, সেরিব্রাল। অনেকটা ব্রিটিশ রকের প্রভাব, একটু ক্যালকুলেটিভ, সেখানে বাংলাদেশ দরাজ, আবেগি।

পশ্চিমবঙ্গের রক অনেক বেশি লিরিক্যাল, সেরিব্রাল। ছবিতে, ফসিলস।

পশ্চিমবঙ্গের রক অনেক বেশি লিরিক্যাল, সেরিব্রাল। ছবিতে, ফসিলস। ছবি: ফেসবুক।

‘নেশা’ আর ‘রক মিউজ়িক’ সমার্থক— এই কথাটা প্রায় প্রবাদ হয়ে গিয়েছে, তবে সত্যিই কি তাই? মঞ্চে, অনুশীলনে, আড্ডায় নেশা করা রকযাপনের অংশ? না, অংশ নয়। বরং তা একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। ‘মিউজ়িক করব বলেই নেশা করছি’-মার্কা মতবাদ আজ আর পালে হাওয়া পায় না।

‘মাইলস’ ব্যান্ডটির কথাই ধরুন, কিংবদন্তি এই বাংলা রক ব্যান্ডের গায়ক বেস প্লেয়ার প্রয়াত শাফিন আহমেদ ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপ আজও স্মরণীয়। তখন শুধু সঙ্গীত আর শিক্ষা ছিল, তুলনায় আজকে রক দর্শন অনেক সুশৃঙ্খল, নেশা চিরকালই পরজীবীত্বে বিশ্বাসী। সে কখনও সামাজিক, কখনও আনুষ্ঠানিকতার উপরে ভর করে এসেছে। বিশিষ্ট কোনও সঙ্গীতধারার সঙ্গে এর কোনও নাড়ির সম্পর্ক নেই।

মঞ্চে মাইলস। গিটার হাতে মাঝখানে শাফিন আহমেদ।

মঞ্চে মাইলস। গিটার হাতে মাঝখানে শাফিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলা রকের আর একটি গুণ হল, তারা পাশ্চাত্য রকের ধারাকে শুরুতে অবলম্বন করলেও পরে নিজ গুণে তা বিবর্তিত হয়ে একটা অথেনটিক বাংলা রকের সাউন্ড হতে পেরেছে, যা ফরাসি বা জাপানি রক পারেনি। যদিও কিছুটা মঙ্গোলিয়ন রক সেটা ভাঙতে পেরেছে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যেমন ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ আছে, আমাদের তেমন শিলাজিৎ মজুমদার আছেন। এক অনন্য অভিনব শব্দ প্রক্ষেপণ, যাকে বলা যায় ‘ওয়ান অফ আ কাইন্ড’। আমার ব্যক্তিগত ভাবনায় তিনি একমাত্র মানুষ, যিনি রকযাপনের প্রতিটা ধাপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যা গতানুগতিকতার একেবারেই বাইরে।

নৈরাজ্যবাদ বা নিহিলিজ়ম রক ভাবনার একটা স্তম্ভ ছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। তাই সার্বিয়া-বস্‌নিয়া যুদ্ধের সময় ওখানে নির্ভানা টি-শার্ট পরলে তাদের ‘নিহিলিস্ট মিলিয়োনিয়ার’ বলে খেপানো হত। বাংলা রকে নৈরাজ্যবাদের কোন জায়গা নেই। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিতে রক মিউজ়িক প্রান্তিক সঙ্গীত হিসেবেই অবস্থান করে এসেছে। সিনেমায় একজন মায়াবী চরিত্রের নায়ক কেন গান গাওয়ার সময় পঞ্জাবি গাইছে, সেই প্রশ্নকে ‘লিপ অফ ফেথ’ বলে গোঁজামিলে সোজা করানো যাচ্ছে, ভোজপুরি সঙ্গীত কেন সরস্বতী পুজোয় চলবে, তা নিয়েও বাগ্‌বিতণ্ডার শেষ নেই। কিন্তু টিভি চ্যানেলে কেন বাংলা গান চলছে না, সে হা-হুতাশে কলকাতার কার্বন মোনো-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়লেও, চট্টগ্রামের কোনও কনটেন্ট ক্রিয়েটার মেয়ে যখন চন্দননগরের ‘ক্রসরোডস’-এর গান নিয়ে রিল বানাচ্ছে, মুহূর্তে গানটা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি থেকে সূর্য সেনের পাড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। একাত্তরের যুদ্ধের পর সেই সময়কার তরুণ সঙ্গীতশিল্পী নিওমেন্ডিস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের সই করা চিঠি নিয়ে কলকাতায় এসে সম্ভবত ট্রিঙ্কাজ়-এ পারফর্ম করেছিলেন, সেখানে বাংলাদেশের জন্য প্রায় সত্তর হাজার টাকা ত্রাণ উঠেছিল।

পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যেমন ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ আছে, আমাদের তেমন শিলাজিৎ মজুমদার আছেন।

পাশ্চাত্য সঙ্গীতের যেমন ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ আছে, আমাদের তেমন শিলাজিৎ মজুমদার আছেন। ছবি: সংগৃহীত।

ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে ভারতীয় ইউটিউবারেরা ২০২২-এ প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার কন্ট্রিবিউশন করেছেন, অথচ হিন্দি-পঞ্জাবি গানের দাপটে কোণঠাসা পুরো দেশের মৌলিক গানের শিল্পীদের অবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বিষহ। আপনার সন্তান বছর বছর ধরে স্বনামধন্য মানুষের গান গেয়ে যাবে আর আপনিও পুজোয়, জন্মদিনে, বিশ্বকর্মায়, মিলাদুন্নবিতে তা-ই শুনবেন— এটা বড়ই বেজায় ‘মনোটনি’। তার চেয়ে বরং নিজের সন্তানকে গান লিখতে শেখান, তার গান শুনুন। হয়তো পরের ‘ইম্যাজিন’টা বাঘাযতীনের কোনও বাঙালি লিখবেন অথবা টংয়ের চায়ের চুমুকে জন্ম নেবে কোনও রুদ্র শহীদুল্লাহ, যাঁর গান ‘আমার ভিতর বাহিরে’ আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেবে আজও শুনছেন।

ঢাকায় আমি অনুশীলন করি রাত সাড়ে দশটায়। কারণ, সারা দিন রাস্তায় বিখ্যাত জ্যামে সব শিল্প-সাহিত্যের পেট্রল পোড়ে। এক কলকাতার বাঙালি, এক মেলবোর্নের আর এক ঢাকার বাঙালি মিলে তৈরি করেছিলাম ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে ব্যান্ডটি। প্রথম শো, ঢাকা রক ফেস্ট-এ তিন নম্বর গানটা শেষ করেছি সবেমাত্র, প্রায় দেড় হাজার শ্রোতা একসঙ্গে ‘ব্রহ্মপুত্র ব্রহ্মপুত্র’ বলে চিৎকার করছে, যা দুর্লভ একটা ব্যান্ডের প্রথম শোয়ে। এখানেই সার্থক যাপন। এই ‘অল্টারনেটিভ’ দুনিয়া, এই উপমহাদেশেই তৈরি হয়েছে। তবু বাঙালি বিশ্বের হয়েও হয়নি।

প্রথম শো, ঢাকা রক ফেস্ট-এ তিন নম্বর গানটা শেষ করেছি সবেমাত্র, প্রায় দেড় হাজার শ্রোতা একসঙ্গে ‘ব্রহ্মপুত্র ব্রহ্মপুত্র’ বলে চিৎকার করছে।

প্রথম শো, ঢাকা রক ফেস্ট-এ তিন নম্বর গানটা শেষ করেছি সবেমাত্র, প্রায় দেড় হাজার শ্রোতা একসঙ্গে ‘ব্রহ্মপুত্র ব্রহ্মপুত্র’ বলে চিৎকার করছে। ছবি: সংগৃহীত।

তবু সে কোথা থেকে এসেছে, সেটা মুখ্য হয়নি। সে বাংলায় লেখে, ভাবে, গায়, কাঁদে, হাসায়। এই বিশ্ববাঙালিরা রূপকথা হবেন কি না, তা সময় বলবে। পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশেই সফ্‌টড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপনে হিরো হন গুরু জেমস, বাচ্চু ভাই। আর এই ভাবেই লংশটে কাশফুলে ধোঁয়া ট্রেনের ছুটে যাওয়া উঠে আসবে কোনও রক কবির কলমে শতাব্দীতে এক বার।

এই ভাবেই যাপিত হবে টুকি বন্দ্যোপাধ্যায়, অ্যালেন আও-এর গিটার, হাসানের হাই পিচ্‌, রাফার আকাশ পাঠানোর গান, আনুশেহ্‌ আনাদিলের অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্ত, বুটি কি-বোর্ডের জাদু, মারজুক রাসেলের ‘মীরাবাই’, রাজীব আশরাফের ‘হোক কলরব’… আরও কত চেনা-অচেনা মুখ। আহা! মহাকাল সাক্ষী, তুলো চাষের ক্ষেতে ক্যানেস্তারা বাজিয়ে গাওয়া ক্রীতদাসের দয়ার আর্তনাদে জন্ম নেওয়া সঙ্গীত আসলে পাড়ার চোঙে কুলিয়ে ওঠার কথা নয়। তাই ‘পথের বাবা-ই বাপরে মনা, পথের মা-ই মা/ এই পথের মাঝেই খুঁজে পাবি আপন ঠিকানা’। যে রাজ্যে যে দেশে ঘরে ঘরে গিটার থাকে, সেই রাজ্য, সেই দেশ কেন সুখী নয়, তা আমি অনেকটাই জানি না, কিন্তু বাংলা রক -সঙ্গীতের নকশিকাঁথা কখনও না কখনও নিশ্চয়ই বোনা হবে।

(লেখক ‘ব্রহ্মপুত্র’ ব্যান্ডের গায়ক ও সঙ্গীতকার)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Rock Music Miles band Fossils Rupam Islam Beatles Faruq Mahfuz Anam James Silajit Majumder Cactus Sidhu Shafin Ahmed Moheener Ghoraguli Goutam Chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy