E-Paper

ছ’বছরের চিকিৎসা-যুদ্ধে পাশে সঙ্গী, নতুন জীবনের পথে তরুণী

তরুণী নিজে হাল ছাড়লেও, তাঁর হাত ছাড়তে চাননি সমাজমাধ্যমে পরিচয় হওয়া সেই সঙ্গী। বরং তিনিই সর্বক্ষণ জুগিয়েছেন সাহস।

জুটি: মুনমুন বণিকের সঙ্গে রঞ্জন অধিকারী।

জুটি: মুনমুন বণিকের সঙ্গে রঞ্জন অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:১১
Share
Save

কানে হেডফোন লাগিয়ে সঙ্গীর সঙ্গে কথার মাঝেই আচমকা জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন তরুণী। সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শুরু হয়েছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত জীবন। তরুণী নিজে হাল ছাড়লেও, তাঁর হাত ছাড়তে চাননি সমাজমাধ্যমে পরিচয় হওয়া সেই সঙ্গী। বরং তিনিই সর্বক্ষণ জুগিয়েছেন সাহস। তাতে ভর করেই ছ’বছরের লড়াইয়ের পরে এ বার তাঁদের চারহাত এক হতে চলেছে।

যা দেখে চিকিৎসকেরাও বলছেন, ‘‘চিকিৎসা তো আছেই। কিন্তু পক্ষাঘাতগ্রস্ত তরুণীর চোখে নতুন করে আশার আলো জ্বালাতে, ওঁর সঙ্গীর অবদান অনস্বীকার্য।’’

২০১৮-র ২৪ অক্টোবর। টালিগঞ্জের বাসিন্দা মুনমুন বণিক বোনকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মী পুজোর কেনাকাটায় বেরিয়ে ছিলেন। হাঁটতে হাঁটতেই মোবাইলে কথা বলছিলেন চার বছর আগে বিয়ের রেজিস্ট্রি হওয়া রঞ্জন অধিকারীর সঙ্গে। হঠাৎ বিপত্তি। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন মুনমুন। তড়িঘড়ি বাড়িতে এনে প্রাথমিক শুশ্রূষায় জ্ঞান ফিরলেও, পরের দিন সকালে ফের জ্ঞান হারালেন তরুণী। তাঁর মা সুমিতা জানাচ্ছেন, মেয়েকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও রক্তচাপ কিছুতেই নামছিল না মুনমুনের।

সুমিতা বলেন, ‘‘হাসপাতালে থাকাকালীন মেয়ে ফের জ্ঞান হারায়। তখন চিকিৎসকদের পরামর্শে অন্যত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। বাইপাসের ধারের ওই হাসপাতালে ধরা পড়ল মেয়ের স্ট্রোক হয়েছে।’’ তত দিনে হাঁটা ও দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ছিলেন মুনমুন। কথা জড়িয়ে গিয়েছিল। ঠিক মতো বসতেও পারতেন না। তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত জীবনে রঞ্জনের আসা ঠিক হবে না ভেবে মুনমুন দাবি করেছিলেন বিয়ে ভেঙে দিতে। ওই তরুণী বলেন, ‘‘ওঁকে বলি, আমার জন্য নিজের জীবন নষ্ট না করতে। মনে করলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করুক।’’ রাজি হননি বেসরকারি সংস্থার কর্মী বারাসতের বাসিন্দা রঞ্জন। বরং প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে এসে বিছানাবন্দি মুনমুনের অসাড় ডান হাতটি আঁকড়ে রঞ্জন বলেছেন, ‘‘তুমি ঠিক হবেই। আমরা তখন সংসার শুরু করব।’’ টানা ছ’বছর ধরে সমস্ত চিকিৎসায় পাশে থেকেছেন রঞ্জন।

মুনমুনের কথায়, ‘‘সর্বক্ষণ মনে হত, রঞ্জন কেন আমার জন্য অপেক্ষা করবে? ওর তো সুস্থ জীবনের অধিকার আছে। কিন্তু সে সব শুনত না।’’ ২০১৭-তে বাবা মারা যাওয়ায় ২০১৮-তে মুনমুন ও রঞ্জনের বিয়ের কথা ছিল। তার আগেই স্ট্রোক ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল সব স্বপ্ন।

রঞ্জন বলেন, ‘‘আমার আশা ছিল মুনমুন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেই। তত দিন না হয় অপেক্ষাই করলাম।’’ এই জায়গাতেই রঞ্জনকে বাহবা দিচ্ছেন মুনমুনের এখনকার চিকিৎসক তথা এসএসকেএমের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের (পিএমআর) বিভাগীয় প্রধান রাজেশ প্রামাণিক। তাঁর কথায়, ‘‘অনিশ্চয়তা জেনেও মুনমুনের পাশে থেকে সব সময় মনের জোর জুগিয়েছেন রঞ্জন। এই আন্তরিকতা ও মানবিকতাই আসল ওষুধ।’’

২০১৯ নাগাদ সামান্য সময়ের জন্য দাঁড়াতে এবং খুবই কষ্ট করে পা টেনে হাঁটতে হত মুনমুনকে। ডান হাত পুরোই অসাড়। তখন কথাও খুব একটা স্পষ্ট হয়নি। তরুণীর মা জানাচ্ছেন, এমন করেই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়েই প্রায় তিন বছর কেটে যায়। তেমন উন্নতি না হওয়ায় ২০২২-এ পিজির ‘পিএমআর’ বিভাগে চিকিৎসার জন্য মুনমুনকে নিয়ে আসেন তাঁর পরিজনেরা। রাজেশ জানাচ্ছেন, তরুণীর হাত-পায়ের মাংসপেশি শক্ত হয়েছিল, মুখের এক দিক বেঁকে গিয়েছিল। পর পর দু’বার দীর্ঘ দিন ধরে ওই তরুণীকে ভর্তি রেখে বিশেষ একটি ইঞ্জেকশন দিয়ে মাংসপেশি শিথিল করা হয়। দাঁড়ানোর জন্য ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রশিক্ষণ চলে। পাশাপাশি, আরও অনেক ধরনের চিকিৎসা চালানো হয়েছিল।

টালিগঞ্জের রাজেন্দ্র প্রসাদ কলোনির ছোট্ট ঘরে বসে নিজের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে চোখের কোন চিকচিক করে উঠছিল মুনমুনের। বললেন, ‘‘গত সাত-আট মাস ধরে টানা এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। টানা হাঁটতেও পারি। বসতেও পারি। তাতেই নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছি।’’ আর পাঁচ জনের মতো মুনমুনও এখন রঞ্জনের সঙ্গে পুজোয় ঠাকুর দেখা, সিনেমা দেখা, রেস্তরাঁয় খাওয়ার আনন্দে শামিল হন। দু’জনে মিলে বিয়ের কেনাকাটা করেছেন। তবে ডান হাতের অসাড়তা এখনও পুরো কাটেনি মুনমুনের। তা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও, তিনি বলেন, ‘‘লড়াই করে এতটা যখন পেরেছি, এক দিন হাতও হয়তো পুরো ঠিক হবে।’’ রাজেশ জানাচ্ছেন, মুনমুনকে মস্তিষ্কে ম্যাগনেটিভ স্টিমুলেশন দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাতে আগামীতে তাঁর হাতের ক্ষমতা আরও বাড়বে।

রঞ্জনের পরিবারও পূত্রবধূকে বরণ করার অপেক্ষায় রয়েছে। যুবকের কথায়, ‘‘পারস্পরিক ভালবাসা, বিশ্বাসের জোরে এই সিদ্ধান্ত। আমারও এমন হলে মুনমুনও পাশে থাকত।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

treatment Marriage Cerebral Attack

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।