মাস কয়েক আগে লেখক, থিয়েটার পরিচালক তাহিরা কাশ্যপ একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন সোশ্যাল নেটওয়র্কিং সাইটে। সম্পর্কে তিনি অভিনেতা আয়ুষ্মান খুরানার স্ত্রীও। তাহিরা সদ্য ব্রেস্ট ক্যানসার জয় করে ফিরেছিলেন। সেই ছবিতে স্পষ্ট কাটাছেঁড়ার দাগ। তিনি লিখেছিলেন, ‘জীবন অনেক সময়েই ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। দরকার হয় শুধু উঠে দাঁড়ানোর।’ সদ্য শেষ হয়েছে ব্রেস্ট ক্যানসার সচেতনতা মাস। সমীক্ষার হারে ব্রেস্ট ক্যানসারের সমস্যা যত বাড়ছে, ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে ব্রেস্টের যত্নআত্তি। আসলে ক্যানসারের ভয়ে নয়, শরীরের বাকি সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যেমন খেয়াল রাখেন, তেমনই জরুরি স্তনের যত্ন। কারণ স্তন তার নিজস্ব সৌন্দর্যেই বিরাজমান। কী ভাবে তাকে ভাল রাখবেন?
শুরুর কথা
স্তনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে অন্তর্বাস। বহু আগে কাঁচুলি, অঙ্গবস্ত্রের চল ছিল। কিন্তু পরে পোশাক ও সুবিধের প্রয়োজনেই সেই ধারণা বদলে গিয়েছে ব্রা-এ। আগেকার দিনে অনেক সময়ে অধিকাংশ মা তাঁর কিশোরী সন্তানকে ব্রা পরতে দিতেন না। এতে মেয়ে ‘বড় হয়ে যাওয়ার’ অমূলক ভ্রান্ত ধারণা থাকত। আবার জিনগত কারণেই অনেক সময়ে দেখা যেত, চোদ্দো-পনেরো বছরের কিশোরীরা প্রথম শুরু করেছে ব্রা পরা। কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গেই ফের বদলে গিয়েছে ধারণা। প্রত্যেকের শারীরিক গঠন অনুযায়ী অন্তর্বাস পরার সূচনার হেরফের হতে পারে। তবে কোনও কিশোরী কখন ব্রা পরা শুরু করবে সেই বিষয়ে যেহেতু সিদ্ধান্ত নেন মায়েরা, তাই ব্রা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা স্বচ্ছ হওয়া জরুরি। বেড়ে ওঠা সন্তানের জন্য তাই গেঞ্জির কাপড়ের টেপজামাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু কী ভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন? খেলাধুলোর সময়ে সন্তানের দিকে খেয়াল রাখুন। দৌড়াদৌড়ি করে খেলার সময়ে আপনার মেয়ের স্তনের মুভমেন্ট চোখে পড়লে, ব্রা পরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়াই ভাল। তবে কেমন হবে সন্তানের প্রথম অন্তর্বাস? ২৯ বছর ধরে অন্তর্বাস স্পেশ্যালিস্ট স্বাতী গৌতম বললেন, ‘‘একটু ফার্ম, ফুল টাইট না হলেও হোল্ড করার জন্য শেপ থাকবে— এটাই জরুরি প্রথম ব্রা-এর জন্য। যে কোনও কাপে সেলাই দিয়ে শেপ তৈরি করা হয়। সেই সেলাই ব্রা-কে সাপোর্ট দেয়। যে ব্রায়ে সেলাই নেই অর্থাৎ সিমলেস, সেখানে থাকে ফোমিং বা প্যাডিং। বাচ্চার প্রথম ব্রায়ে শেপ দরকার। এই পর্যায়ে সন্তানের ডেভেলপমেন্ট তাড়াতাড়ি হয়। ফলে সেই অনুযায়ী বদলাবে অন্তর্বাসও।’’
অন্তর্বাসের খুঁটিনাটি
স্তন সুন্দর রাখার জন্য অন্তর্বাসও ঠিক হওয়া জরুরি। অন্তর্বাস পরারও কিছু নিয়মকানুন আছে। দেখে নেওয়া যাক সেগুলি।
• খেয়াল রাখতে হবে ব্রা পরার পরে পাশ থেকে বা উপর থেকে যেন স্তনের অংশ বেরিয়ে না থাকে। টাইট কাপে সাধারণত এই ধরনের সমস্যা হয়। আর এর থেকেই নানা রোগেরও সৃষ্টি হয়।
• হাত উপরে তুললে কাপের নীচ থেকে স্তন যেন বেরিয়ে না যায়। অত্যধিক লুজ় বা আলগা কাপ ফাইব্রয়েডের মতো সমস্যা ডেকে আনে। যে কাপ স্তনকে পুরো কভারেজ দেয়, সেটিই উপযুক্ত। ব্রেস্ট টিসুর উপরে চাপ পড়লে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
• ব্রেস্ট ভারী হলে, ব্রা-এর চার দিকের ব্যান্ড ফিটেড না হলে পিঠের দিকে স্ট্র্যাপ উপরে উঠে আসবে। গ্র্যাভিটির জোরে স্তন সামনের দিকে ঝুঁকলে রিফ্লেক্টেড পেন হয় লোয়ার ব্যাকে। তাই ঠিক ফিট দেখে কিনুন।
• নর্মাল ফিটিং ব্রা পড়লে বুকের ওজন ভাগ হয়ে যাবে কাঁধ এবং কোমরে। স্ট্র্যাপ লুজ় হলে চলবে না।
ভ্রান্ত ধারণা এবং তার সত্যতা
আন্ডারওয়্যারড অন্তর্বাস: মেকআপ প্রডাক্ট যতই ভাল মানের হোক, তা তুলতেই হয়। না হলে আখেরে ক্ষতি হয় ত্বকের। তেমনই আন্ডারওয়্যার ব্রা-এরও ভুল ব্যবহার ডেকে আনতে পারে ক্ষতি। ব্রা-এর হাফ ওয়্যারে স্তনে এবং ফুল ওয়্যারে আর্মপিটে খোঁচা লাগতে পারে। এখানেই লিম্ফ নোডস থাকে (যা ইনফেকশন এবং নানা রোগের মোকাবিলা করতে শরীরকে সাহায্য করে)। ফলে ক্ষতি হতে পারে শরীরের। তাই যখন দরকার নেই, তখন ওয়্যারড ব্রা না পরাই ভাল।
ব্যবহারের সময়কাল: প্রত্যেক মানুষের উপরে নির্ভর করে, তাঁর অন্তর্বাস কত দিন টিকবে। কম ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ঠান্ডা জলে অন্তর্বাস কেচে ছায়ায় মেলে দিলে ভাল থাকে অনেক দিন। তবে ইলাস্টিক স্ট্র্যাপ ও কাপ লুজ় হয়ে গেলে, কাপড়ে বাব্ল উঠলে বদলে ফেলাই ভাল।
রাতের ব্যবহার: অনেকেই বাড়ি ফিরে অন্তর্বাস খুলে ফেলেন। তবে স্বাতী গৌতম বললেন, ‘‘রাতে শোয়ার সময়েও অন্তর্বাস পরা জরুরি। এর জন্য পুরনো, আলগা হয়ে যাওয়া কিংবা এক সাইজ় বড় ব্রা ব্যবহার করতে পারেন। অন্তর্বাস পরে শুলে একটি স্তনের চাপ আর একটিতে পড়ে না এবং শেপও ধরে রাখে তা। অথচ রাতে ঘুমোনোর আরামেও কোনও অসুবিধে হয় না।’’
রকমফের: পুশ আপ, টি-শার্ট, স্পোর্টস বা জিমিং, সিমলেস, স্ট্র্যাপলেস... অন্তর্বাসের ধরন নানা রকম। পোশাক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু যেমন অন্তর্বাসই পরুন, তা ঠিকঠাক ফিট করা জরুরি।
স্তনের যত্নে
শুধু অন্তর্বাস নয়, এ ছাড়াও স্তনের জন্য প্রয়োজন আর একটু বেশি যত্ন।
ময়শ্চারাইজ়িং: মুখ বা শরীরের নানা অংশের মতোই বুকেরও দরকার ময়শ্চারাইজ়িং। স্তনের ত্বক সাধারণত ভীষণ পাতলা ও সংবেদনশীল হয়। তাই কোকো বাটার জাতীয় ময়শ্চারাইজ়ার লাগাতে পারেন। নিয়মিত ব্যবহারে স্তনের ত্বক ভাল থাকবে।
সুগন্ধী: সাধারণত ঘামের কারণে আর্মপিটের তলায়, বুকের ভাঁজে দুর্গন্ধ ছড়ায়। র্যাশ বা ইরিটেশন হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এর জন্য বেবি পাউডার বা ভাল ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করতে পারেন সেই সব অংশে।
সানস্ক্রিন: বিকিনি বা লো নেক পোশাক পরলে দিনের বেলায় বুকের উপরের অংশে ভাল করে সানস্ক্রিন লাগানো জরুরি।
খাবারদাবার: পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার এমনিতেই সারা শরীরের জন্য ভাল। কিন্তু সয়বিন, টোফু জাতীয় খাবার তালিকায় রাখলে তা স্তনের জন্য উপকারী। তবে অবশ্যই তা পরিমাণ মতো। এতে ফাইব্রোসিস্টিক জাতীয় রোগের আশঙ্কা কমে। পিচ, স্যামন, অলিভ অয়েল, ব্রকোলি, ওয়ালনাট আবার বুকের টিউমর সেলের গ্রোথ কমাতে সাহায্য করে। তাই সপ্তাহের খাদ্যতালিকায় ভাগ করে এই জাতীয় খাবার রাখা যেতেই পারে।
ব্যায়ামের কেরামতি: স্তনে রক্ত সঞ্চালনের জন্য মাসাজ দরকার। এর জন্য দু’হাতে স্তন ধরে আলতো ভাবে উপরের দিকে তুলুন। সেই সময়েই আস্তে আস্তে প্রেস করুন। এ বার আঙুলের সাহায্যে ক্লকওয়াইজ় এবং অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ় মাসাজ করতে থাকুন। স্তনকে ধরে রাখতে সাহায্য করে পেকটোরাল মাসল। কুয়ো থেকে জল তোলা, টিউবওয়েল থেকে জল তোলা, কাঁসার মতো ভারী বাসন চেপে মাজলে এই মাসলের ব্যায়াম হয়। এই মাসলকে যত সচল রাখা যায়, তা শরীরের জন্য তত ভাল। ফিটনেস এক্সপার্ট সোমনাথ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘ব্যায়ামের মাধ্যমে ব্রেস্ট টোন করা যায়। অতিরিক্ত ওজন থাকলে, ব্যায়ামের সাহায্যে মেদও কমানো যায়। কিন্তু জিনগত কারণে কারও ব্রেস্ট বড় হলে, তা ছোট করা যায় না। জিমে গেলে ডাম্বেল চেস্ট প্রেস, বিশেষ কিছু পুশ আপ করতে পারেন। বাড়িতে স্পট জগিং কিংবা অ্যারোবিক্স ডান্সও করা যেতে পারে।’’ তবে প্রশিক্ষিতের সাহায্য নিয়েই ব্যায়াম করা ভাল।
পরীক্ষা করুন নিজেই
আপনার স্তনের দেখভাল যেমন নিজেই করবেন, তেমন সে সুস্থ আছে কি না, তা-ও দেখতে পারেন নিজেই। কনসালট্যান্ট ব্রেস্ট সার্জন তাপ্তি সেন বলছেন, ‘‘পিরিয়ডস হওয়ার চার-পাঁচ দিন পরে স্নান করার সময়ে সাবান মাখতে মাখতে নিজের স্তন পরীক্ষা করা জরুরি। দেখতে হবে কোথাও লাম্প হয়েছে কি না, স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বেরোচ্ছে কি না, স্তনবৃন্ত ভিতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে কি না বা আর্মপিটে কোনও ফোলা ভাব বোঝা যাচ্ছে কি না। ব্রেস্টের সব টিউমরই ক্যানসার হয় না। ইদানীং ব্রেস্ট টিউবরকুলোসিসের প্রবণতা বাড়ছে। তিরিশ বছরের পরে বছরে এক বার ক্লিনিকালি এগজ়ামিনেশন করিয়ে নেওয়া উচিত।’’ তবে নিজে নিজে পরীক্ষা কিন্তু ব্রেস্ট ডেভেলপমেন্টের পর থেকেই করা উচিত। বিদেশে সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলারা ব্রেস্ট ক্যানসারে ভুগলেও, এ দেশে আক্রান্তের বয়স সাধারণত ৩০ থেকে ৫০। ক্যানসার ছাড়াও ব্রেস্টের নানা সমস্যা হতেই পারে। তাই নিয়মিত পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
রোগের আতঙ্কে নয়, বুকের যত্ন নিন তাকে ভালবেসে। যা কিছু একান্ত ব্যক্তিগত এবং নিজস্ব, তার জন্য না হয় সামান্য বেশি যত্নই থাকুক। সে-ও ভাল থাকবে, ভাল থাকবেন আপনিও।
মডেল: ঐশ্বর্য সেন; ছবি: অয়ন নন্দী; মেকআপ: সুমন গঙ্গোপাধ্যায়; হসপিটালিটি ও ফুড পার্টনার: মোনোটেল, সেক্টর ফাইভ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy