Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Social media Hatred

সমাজমাধ্যমে হুমকি, হেনস্থা

সমাজমাধ্যমে ধর্ষণের হুমকি, ট্রোলিং বা বডিশেমিং এড়িয়ে যাবেন না। আইনি পদক্ষেপ করুন

শ্রেয়া ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১৭
Share: Save:

দামি ফোন ও ট্যাবলেট, উন্নত ডিজিটাল পরিষেবা, সমাজমাধ্যমে কলকাতা থেকে ক্যানবেরা যোগাযোগ — সবক’টিরই প্রতিশ্রুতি ছিল মানুষের জীবন একটু সহজ করার। সহজ হয়তো হয়েছে, সেই সঙ্গে প্রকট হয়েছে মনের লুকানো ক্লেদ। পাঁকের চোরাস্রোত বইতে লেগেছে মেয়েদের ঘিরে। দৃষ্টিসুখের অত্যাচার থেকে শুরু করে অযাচিত ‘বন্ধুত্বের’ আহ্বান তো রয়েছেই। তবে, সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক হল নিন্দার ঝড়, ট্রোলিং ও রেপ থ্রেট।

২০২১ সালে বিরাট কোহলি ও অনুষ্কা শর্মার মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল আইআইটির এক পড়ুয়া। সে মনে করেছিল, সমাজমাধ্যমে তার ‘ইকোসিস্টেম অব হেট’ (তার সঙ্গে সহমত একাধিক মানুষ) এতটাই পোক্ত যে দশ মাসের শিশুকেও হুমকি দেওয়া যায়। গত কয়েক বছরে রয়েছে এমন ভূরিভূরি উদাহরণ। মহিলাদের কাছেও সমাজমাধ্যমে ধর্ষণের হুমকি নতুন নয়।

আর জি কর হাসপাতালের নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়েও ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ফেলছে অনেকে। ট্রোলিং তো চলছেই। ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়। সুতরাং, সমাজমাধ্যমে ধর্ষণের হুমকি আসলে নারীকে দমিয়ে রাখার অস্ত্র। এর সঙ্গে গালিগালাজ, বডিশেমিং তো রয়েছেই।

কোন মানসিকতা কাজ করে?

সমাজতাত্ত্বিক ড. অনিরূদ্ধ চৌধুরীর মতে, ধর্ষণের হুমকি, ট্রোলিং ইত্যাদির পিছনে সোশিয়ো-সাইকোলজিকাল আঙ্গিক থেকে মূলত তিন ধরনের মানসিকতা দেখা যায়। এই ধরনের মানুষের ব্যক্তিত্বের সঙ্কট রয়েছে, আত্মসম্মান অত্যন্ত কম। বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সমাজমাধ্যমে যেহেতু মেঘনাদের মতো আড়াল থেকে আক্রমণ শানানো যায়, তাই দুর্বলচিত্তের কিছু মানুষ ট্রোলিং বা রেপ থ্রেট বেছে নেয়। এর মাধ্যমে তারা অন্যায় করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার আনন্দ অনুভব করে। এই ধরনের মানুষ বাস্তবে গুরুত্ব পায় না, নিজস্ব সম্পর্কের জায়গায় অসুখী, তার প্রকাশ ঘটে সমাজমাধ্যমে। দ্বিতীয় ধরনের মানুষের মধ্যে রয়েছে তীব্র নারীবিদ্বেষী মনোভাব। এরা মেয়েদের কোনও না কোনও ভাবে দমিয়ে রাখতে চায়, তাদের পণ্য মনে করে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের ঠুনকো পৌরুষ। কোনও মহিলার ছবি, স্টেটাস, পোস্ট বা কমেন্টের ফলে সেই পৌরুষ ঘা খেলে শুরু হয় নির্বিচারে আজেবাজে কথা, ক্ষমতার দম্ভ ও আস্ফালন।” এরাই আবার মেয়েদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। প্রাক্তন প্রেমিকা, বান্ধবী থেকে তারকা— হুমকি দিতে কাউকেই ছাড়ে না এরা।

ড. চৌধুরীর মতে, ভারতের ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি ধরন রয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে ট্রোলিং ও ধর্ষণের হুমকি। মহিলা রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও তারকাদের বহু বার এর সম্মুখীন হতে হয়েছে। মূলত, সমাজমাধ্যমে লিখে মেয়েরা যে বিষয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তার থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য চলে এই সমবেত গণনিন্দা ও হুমকি।

প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ

এই প্রসঙ্গে কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী সোহম বন্দ্যোপাধ্যায় একটু অন্য রকম ভাবেন। তাঁর কথায়, “সমাজমাধ্যম বাক্‌স্বাধীনতাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার অপব্যবহার অপরাধ হয়ে উঠছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে বাক্‌স্বাধীনতা ও অপরাধের মধ্যে পার্থক্য খুবই ঝাপসা। মনে রাখতে হবে, ‘রাইট টু অফেন্ড ইজ় অ্যান এসেনশিয়াল পার্ট অব ফ্রিডম অব স্পিচ।’ ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতার সমালোচনা করে বানানো মিম কি আদৌ সাইবার ক্রাইম? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে চর্চার পাশাপাশি রেপ থ্রেট, হেট স্পিচ, স্টকিং, সাইবার বুলিয়িং-এর বিরুদ্ধে আরও নির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে।”

  • এই ধরনের ট্রোলিং, রেপ থ্রেট পেলে প্রাথমিক কর্তব্য কী?

এরকম সমস্যার সম্মুখীন হলে লোকাল থানায় বা সাইবার থানায় অভিযুক্তের সোশাল মিডিয়ার পরিচয়সহ বিস্তারিত লিখিত ভাবে জানাতে হবে। পাশাপাশি ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টং পোর্টাল (https://cybercrime.gov.in/)- এ অবশ্যই অভিযোগ নথিভুক্ত করতে হবে। তবেই দ্রুত পদক্ষেপ আশা করা যাবে ।

  • কী কী আইন রয়েছে এই হুমকির বিরুদ্ধে?

আলাদা করে ট্রোলিং বা রেপ থ্রেট ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় কোথাও বর্ণিত না থাকলেও বিভিন্ন ধারায় উক্ত আচরণগুলো অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় । হেট স্পিচ মোকাবিলা করার জন্য ১৯৬ ধারা রয়েছে, পাশাপাশি ৩৫২ ধারাও আকৃষ্ট হতে পারে। সমাজমাধ্যমে রেপ থ্রেটের ক্ষেত্রে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ৭৫, ৭৯ এবং ৩৫১-এর পাশাপাশি ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্টের ৬৭ এবং ৬৭এ ধারায় প্রশাসন পদক্ষেপ করতে পারে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৭৮ ধারায় সাইবার স্টকিং শাস্তিযোগ্য। উক্ত ধারাগুলিতে জেল, জরিমানা সবই হতে পারে। রিপিটেড অফেন্ডারদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কড়া শাস্তির বিধানও রয়েছে।

  • ফেক প্রোফাইল থেকে হুমকি পেলে কী করবেন?

সব সময়েই লোকাল থানা বা সাইবার থানায় লিখিত জানানোর পাশাপাশি, ন্যাশনাল পোর্টালে অভিযোগ করতে হবে। ফেক আইডির পিছনে কে আছে সেটা তদন্তকারী সংস্থা বার করে ফেলে। তাই এ ধরনের বিষয় চেপে না গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে। ট্রায়ালে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি সুনিশ্চিত করার এটাই একমাত্র উপায়।

প্রতিবাদ তো করতেই হবে, স্বাভাবিক ভাবে। তবে, সমাজের প্রতিটা আঙ্গিক, যা ধর্ষণ ও নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবায় প্রচ্ছন্ন অনুমোদন দেয়, প্রশ্ন তুলতে হবে সেখানেও। তবেই হয়তো ভাঙা যাবে ভয়ের শেকল।

অন্য বিষয়গুলি:

Social Media Body shaming
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE