কোভিডের নিভৃতবাসে গান শুনে মন ভাল রাখার পরামর্শ চিকিৎসকের। ছবি: শাটারস্টক
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নানা অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি আরও একটা হাতিয়ারকে সঙ্গী করতে পারেন। সুর শুনিয়ে কিছুটা বশ করা যায় নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে নিউ নর্মাল জীবনের মন খারাপ আর ছোটখাটো শারীরিক অস্বস্তি। দুষ্টু লোকেদের গান গেয়ে যেমন থামিয়ে দিত গুপি বাঘা, তেমনই সুরের জাদুতে পালানোর পথ খোঁজে মনের অসুখের কারণ। কেমব্রিজের অ্যাঞ্জিলা রাসকিন ইউনিভার্সিটির মিউজিক, হেলথ অ্যান্ড ব্রেনের গবেষক জর্জ ফ্যাকনার ও তাঁর সহযোগীরা হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের নানা সুর শুনিয়ে তাঁদের মস্তিষ্কের ইলেকট্রোএনসেফ্যালোগ্রাম বা ইইজি রিপোর্টে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখেছেন।
এই গবেষণাপত্রে জানা গেছে যে, মস্তিষ্কের এক বিশেষ নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনেকটাই কমে। মিউজিক থেরাপি গবেষণায় এটি এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে দাবি প্রোফেসর ফ্যাকনারের। মিউজিক থেরাপির বিশেষজ্ঞদের মতে সুরের জাদুতে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের বাড়বাড়ন্তকে আটকে দেওয়া যায়।
ভারতবর্ষ, মিশর, চিন, গ্রিস আর রোমে সভ্যতার শুরুতে সুরের সাহায্যে অসুখ সারানো হত। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বহু দিন তা ধামাচাপা পড়ে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে চিকিৎসকেরা আহত সৈন্যদের ব্যথা-যন্ত্রণা কমাতে মৃদু লয়ের গান-বাজনা ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য ফল পান। গান বাজনা দিয়ে চিকিৎসার সূত্রপাত তখন থেকেই। সৈন্যদের কষ্ট লাঘব হওয়ার সময় থেকেই একদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী সমীক্ষা শুরু করে তা লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। দেখা যায়, শরীর ও মন— দুইয়ের কষ্ট কমাতেই সুরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।
ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনেকটাই কমে। ফাইল ছবি।
বস্টনের বার্কলে কলেজ অফ মিউজিকের অধ্যাপক সুজান হ্যানসার সুর-চিকিৎসার সাহায্যে শরীর ও মনের বেশ কিছু সমস্যা নিয়ন্ত্রণের কথা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: বাইরে বেরলেও কমেনি ঝুঁকি, ‘নিউ নর্ম্যাল’-জীবনে কী করবেন, কী করবেন না
• নির্দিষ্ট কিছু সুর শোনালে রোগীর উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ কমে মন শান্ত হয়।
• শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রমশ স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
• রক্তচাপ কমে।
• হৃদপিণ্ডের অতিরিক্ত স্পন্দন কমতে শুরু করে।
• পেশির কাঠিন্য ও ব্যথার উপশম হয়।
• মন-মেজাজের তিরিক্ষি ভাব চলে গিয়ে মন শান্ত হয়।
• মাথার যন্ত্রণা, বুকে অস্বস্তি কমে।
• ডোপামিন নিঃসরণ হয় বলে ভাল ঘুম হয়।
• শারীরিক অস্বস্তি ও কষ্টের বোধ কমে যায়।
• হজমের অসুবিধা ও পেটের সমস্যা চলে যায়।
• রাগ চলে গিয়ে মন ভাল থাকে।
• ডিপ্রেশন ও অকারণ মন খারাপের হাত থেকে রেহাই মেলে।
তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, মিউজিক থেরাপি কিন্তু কোনও ম্যাজিক ওষুধ নয়, ধীরে ধীরে কাজ করে। সুর চিকিৎসা খুব ভাল কাজ করে বাচ্চা ও বয়স্কদের উপরে।
সুর চিকিৎসা খুব ভাল কাজ করে বাচ্চাদের উপরেও। ফাইল ছবি।
কলকাতার অর্থোপেডিক সার্জন ও মিউজিক থেরাপির গবেষক সুমন্ত ঠাকুর জানালেন, দুর্ঘটনায় ভয়ঙ্কর ভাবে আহত রোগীর কানে হেডফোন লাগিয়ে মৃদুলয়ের সেতার, সরোদ-সহ হালকা বাজনা শুনিয়ে প্রাথমিক ভাবে তাদের স্থিতিশীল অবস্থায় এনে তার পর সার্জারি করা হলে রোগীর কষ্ট অনেক কম থাকে। দ্রুত সেরেও ওঠেন। তবে ব্যথার ওষুধ যে একেবারেই লাগে না, তা নয়। যে কোনও শারীরিক কষ্ট হলে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: করোনাকালে অটিস্টিকদের নিয়ে চিন্তা, হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করছে এই সব নেটওয়ার্ক
সুন্দর সুর শুনলে ডোপামিন নামে নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ বেড়ে গিয়ে কষ্ট কমাতে সাহায্য করে। সুমন্তবাবু আরও জানালেন, মিউজিক থেরাপির সাহায্যে রোগীর নাড়ির গতি (পালস রেট), হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে। তবে এটাও ঠিক যে, মিউজিক থেরাপি কোনও স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা নয়, সহায়ক চিকিৎসা মাত্র।
কোভিড-১৯ সংক্রমণে যাঁদের সপ্তাহ দুয়েক হাসপাতালে বা আইসোলেশনে থাকতে হয় তাঁদের জন্য এটি কার্যকর হবে বলে মনে করেন চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুর। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি অর্থোপেডিক রোগীদের সার্জারির আগে ও পরে গান শুনিয়ে ব্যথা কমাচ্ছেন। তাই এই থেরাপি আইসোলেশনে বা করোনা নিভৃতবাসে কার্যকর হবে বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: মাথা-ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা? নার্ভের সমস্যা নয় তো? কীভাবে বুঝবেন
ঠাকুর’স মিউজিক অ্যান্ড মুভমেন্ট থেরাপি রিসার্চ সেন্টারের পক্ষে ইন্দ্রনীল মণ্ডল জানালেন, ফিমেল ওয়ার্ডে তাঁর গান শুনে অক্সিজেনের মাস্ক খুলে গলা মিলিয়েছেন সিওপিডি আক্রান্ত এক প্রৌঢ়া। আপার লিম্ব সার্জারির সময় জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার বদলে লোকাল লক করেই অস্ত্রোপচার করেন সুমন্তবাবু। তিনি কোভিডের নিভৃতবাসে গান শুনে মন ভাল রাখার পরামর্শ দিলেন। গান মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। পড়াশোনায় অমনোযোগী বাচ্চাদের উপর রীতিমত সমীক্ষা করে দেখা গেছে, যারা অত্যন্ত চঞ্চল তাদের সুন্দর গান বা বাজনা শোনালে টানা ছয়-সাত মিনিট পর্যন্ত নিবিষ্ট মনে শোনে।
সমীক্ষায় প্রমাণিত, ছোট্ট বয়স থেকে যারা গান-বাজনা শোনে তাদের একাগ্রতা তুলনামূলক ভাবে বেশি। এমনকি যে সব বাচ্চা জন্মের সময় থেকেই গান শোনে, তারা অন্যদের থেকে অনেক আগে কথা বলতে শেখে। মস্তিষ্কের কথা বলার অংশকে উজ্জীবিত করে সুর। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোক আক্রান্ত বয়স্ক মানুষদের কথা বলার ক্ষমতা চলে গেলে (অ্যাফাসিয়া) ভাল গান শোনালে তাঁরা সহজে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পান।
শরীর মন— দুই-ই ভাল রাখতে সাহায্য করে সুন্দর সুর, জানিয়েছেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিল–এর মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল জে লেভিটিন, নিউরোসায়েন্স অব মিউজিক-এর উপর ৪০০টি স্টাডি করে তিনি এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
গান একাগ্রতা বাড়াতে সাহায্য করে। ফাইল ছবি।
গুরুতর অসুস্থ কিছু রোগীকে নিয়ম করে গান-বাজনা শুনিয়ে দেখা গেছে যে, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক ইমিউনোগ্লোবিউলিনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এই ন্যাচারাল কিলার সেল আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার জীবাণুদের বিরুদ্ধেও লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে আমাদের শরীর। এছাড়া স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে মনের চাপ কমায়। সুতরাং, করোনা অসুরকে জব্দ করতে সঙ্গী করুন সুরকে।
আরও পড়ুন: নাগাড়ে কাশি, স্বরে বদল ফুসফুস ক্যানসারের উপসর্গ হতে পারে
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy