হাই হিল ছাড়াও ফ্যাশন সম্ভব।
রাত বারোটা বাজতেই বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়েছিল সিন্ডারেলা। রাজকুমারের হাত ছাড়িয়ে রাজপ্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে হোঁচট খেয়েছিল সে, খুলে গিয়েছিল একপাটি জুতো। সেই জুতো ফেলে রেখেই দিয়েছিল দৌড়। নিন্দুকে বলে, অনভ্যস্ত পায়ে স্টিলেটো সামলাতে পারেনি সে। তাতে রাজকুমারের সঙ্গে পুনর্মিলনের সুযোগ তৈরি হলেও সেই সময়ে স্টিলেটো পরে দৌড়তে গিয়ে কী ব্যথাই না পেয়েছিল মেয়েটা! আর কেউ না বুঝলেও বিখ্যাত একটি ফরাসি ফ্যাশন সংস্থা ডিয়রের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মারিয়া গ্রাৎসিয়া চিউরি বুঝেছিলেন। তাই বরাবরই নিজের ফ্যাশন শোয়ে হিলের বদলে ফ্ল্যাট জুতোই বেছে নিয়েছেন তিনি।
সেই প্রতিচ্ছবিই দেখা গেল গত বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ে ডিয়রের প্রথম ফ্যাশন শোয়ে। প্রি ফল কালেকশনের প্রদর্শনীতে হিল জুতো একেবারেই বাদ দিয়ে দিল বিশ্ববিখ্যাত এই সংস্থাটি। উঠে এল বিভিন্ন রকমের ফ্ল্যাটস, যেমন স্লাইডারস, স্ট্র্যাপি স্যান্ডলস এমনকি ফ্লিপফ্লপের মতো অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু আরামদায়ক জুতোও। স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি বিষয়, কষ্ট করে ফ্যাশনের দিন শেষ। অতিমারির ঝড় সামলে এখন আমরা আরামদায়ক পরিচ্ছদই বেছে নেব।
এই প্রসঙ্গেই শু-ডিজ়াইনার রোহন অরোরা বললেন, “ফ্ল্যাট জুতো কখনওই ট্রেন্ডের বাইরে ছিল না, বরং বলা চলে ফ্লিপফ্লপস, লোফারস বা যে কোনও ধরনে ফ্ল্যাট জুতো ভীষণ ক্লাসি ও কমফর্টেবল। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ফ্ল্যাট জুতো পরার প্রবণতা কোনও ট্রেন্ড বা ফেজ় নয়। ফ্যাশনে একটি ট্রেন্ড এই আছে, এই নেই। ফ্ল্যাট জুতো কিন্তু চিরকাল থেকে যাবে, কারণ মানুষ পোশাকে আরাম চায়, সেটাই স্বাভাবিক।” রোহন আরও বললেন, ডিয়র যে ভাবে ফ্ল্যাট জুতোকে তুলে ধরল, তা প্রয়োজনীয় ছিল। এই পদক্ষেপ বার্তা দেয়, আত্মবিশ্বাসী হওয়ার সঙ্গে হিল জুতোর কোনও সম্পর্ক নেই। প্রকারান্তরে যেন নারী ক্ষমতায়নকেও ছুঁয়ে যায় এই পদক্ষেপ।
রোহনের কথার সুর ধরেই ফিরে আসা যাক মারিয়ার কথায়। মারিয়া মনে করেন, হিল জুতো আদতে চিন-দেশীয় পা বেঁধে রাখার মিথের আধুনিক প্রয়োগ। তিনি আরও মনে করেন, প্রতি মুহূর্তে ফ্যাশন ট্রেন্ডকে প্রশ্ন করা উচিত। নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কখনওই আপস করা উচিত নয়। রোহনেরও তাই মত। তিনি জানালেন, তাঁর স্টোরে একাধিক আলমারি শুধু ফ্ল্যাট জুতোর জন্যই রাখা।
সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান ফ্যাশন দুনিয়ায় জুতোর নকশা ২০১৮ সাল থেকেই হিল ঝেড়ে ফেলে ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকেছে। ২০১৮ সালের স্প্রিং প্যারিস ফ্যাশন উইক, ২০১৯-২০ সালের অটাম-উইন্টার ওত কুতুর কালেকশন, এমনকি ২০২৩ সালের ফল কালেকশন সবেতেই মারিয়া বেছে নিয়েছেন ফ্ল্যাট জুতোকেই। বলা চলে, স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামই এখন ফ্যাশনিস্তাদের প্রথম পছন্দ।
আর তা হবে না-ই বা কেন? ফ্ল্যাট জুতোর রয়েছে নানা সুবিধে:
এই জুতো পরে হাঁটা-চলায় সুবিধে। হিল জুতোয় পা পিছলে যাওয়ার বা হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কখনও কখনও র্যাম্পেও মডেলদের হোঁচট খেতে দেখা যায়। ফ্ল্যাট জুতোয় সেই সুযোগই নেই! আবার, অনেকক্ষণ হিল জুতো পরে থাকলে পায়ে তীব্র ব্যথা হতে পারে। তখন আর কিছুতে মন দেওয়া যায় না। সেই ব্যথার সুযোগও ফ্ল্যাট জুতোয় নেই।
রোহনের মতে, ইউরোপ-আমেরিকায় খুব কম বয়স থেকেই দৈনন্দিন জীবন যাপনে হিল জুতো পরা হয়। এ দেশে সেটার হার খানিক কম। এখানে হিল জুতো খানিকটা অনুষ্ঠান নির্ভর। পাশাপাশি, ও দেশে রাস্তা ঘাটের অবস্থার সঙ্গে এ দেশের খানিক ফারাক রয়েছে। তাই হিল জুতোয় পড়ে যাওয়ার প্রবণতা এ দেশে খানিক বেশি। আর হিল জুতো পরার প্রবণতা এ দেশে খানিকটা রয়েছে উচ্চতা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বর্তমান ফ্যাশন দুনিয়ার বার্তা— আত্মবিশ্বাস ও সৌন্দর্যের জন্য হিল না পরলেও চলে।
কোমর ব্যথা থেকে মুক্তিও মেলে ফ্ল্যাট জুতো পরলে। দীর্ঘদিন ও দীর্ঘক্ষণ স্টিলেটো জাতীয় হিল পরে থাকলে পায়ের উপর চাপ পড়ে। তার ফলে ক্রনিক ব্যাক পেন দেখা দেয় অনেক সময়েই। পাশাপাশি, যাঁদের পায়ের আকার বড় হিল জুতো তাঁদের পক্ষে খুব অস্বাচ্ছন্দ্যকর হয়ে ওঠে, ফ্ল্যাটসে কিন্তু সেই সমস্যা নেই। আর প্রচলিত যে দাবি, ফ্ল্যাটসে স্টাইলিশ হয়ে ওঠা যায় না— তাতে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে র্যাম্পে মহাসমারোহে ফ্ল্যাটসকে নিয়ে আসছে বিখ্যাত ফ্যাশন সংস্থাগুলিই!
অতিমারির ঝড় মানুষকে শিখিয়েছে নিজেকে যন্ত্রণা না দিয়েও সুন্দর থাকা যায়। আগে ফ্যাশনের সঙ্গে যন্ত্রণার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক ছিল। তবে সেই দিন পাল্টাচ্ছে। এখন যা আরামদায়ক, যাতে মানুষ স্বচ্ছন্দ, তা-ই ফ্যাশন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy