গোলাপি চুল। গোলাপি পোশাক। চোখের উপর নীল আইশ্যাডো। ঠোঁট গোলাপি। সঙ্গে নানা রঙের পাথরের গয়না। তাতেও আছে গোলাপির আধিক্য। এমন সাজেই অশীতিপর এক ‘তরুণী’ চষে বেড়াচ্ছেন গোটা কলকাতা। দু’দণ্ড স্বস্তির জলপান করতে করতে সেই জ়্যান্ড্রা রোড্স বলেন, ‘‘গোলাপিই হল এখনকার নেভি ব্লু, বুঝলেন! সব জায়গায় পরা যায়। যেমন করে পরবেন, তেমনই ভাল লাগবে।’’

সিমা গ্যালারিতে জ়্যান্ড্রা রোড্স। ছবি: অমিত দত্ত।
অন্য কেউ হলে সেই উক্তি দাপুটে মনে হতে পারত। তবে জ়্যান্ড্রা সাজের জগৎটা হাতের তালুর মতো চেনেন। সে জগৎও তাঁকে মাথায় তুলে রাখে। বলিউড বা দেশের অন্য কোনও প্রান্তের ফ্যাশন-তারকা হলে এত স্বচ্ছন্দে কলকাতার ফাঁকা হলঘরে হেঁটে বেড়িয়ে গল্প করতে পারতেন না জ়্যান্ড্রা। চারদিক থেকে ক্যামেরা ভরিয়ে দিত শব্দে। নিজের দেশ ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকা, ফ্রান্সে বোধহয় এমনই হয়! এখানে বেড়াতে এসেছেন বন্ধুদের নিয়ে। বিশেষ হইচই চাইছেন না। তাই বলে কি কেউ জানেন না যে, তিনি রাজকুমারী ডায়ানার পোশাকশিল্পী ছিলেন এক কালে! সাজিয়েছেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের আরও অনেককেই। তবে শুধু তারকা রাজবধূ নন, জ়্যান্ড্রার কাজের ব্যাপ্তি অনেক। নানা মাধ্যম নিয়ে কাজ করা তারকাদের সাজ সমৃদ্ধ করেছে তাঁর শিল্প। দুনিয়া কাঁপানো ব্রিটিশ রক ব্যান্ডের মুখ ফ্রেডি মার্কারির সাজও তৈরি হয়েছে তাঁর হাতে। সাজিয়েছেন আমেরিকার হলিউডের নামী ব্যক্তিদেরও। ফ্যাশন-শিল্পের ইতিহাস গড়ছেন এবং বয়ে বেড়াচ্ছেন গত ৫৫ বছর ধরে! এখনও করে চলেছেন নিত্যনতুন কাজ। লন্ডনের ‘ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইল মিউজ়িয়াম’ তৈরি করেছেন সেই ইতিহাসকে ধরে রাখতে। কলকাতার সাংবাদিক তা নিয়ে প্রশ্ন করলে হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নানা রঙে সাজানো মুখশ্রী। জ়্যান্ড্রা বলেন, ‘‘মিউজ়িয়ামের কথা দেখছি এখন অনেকেই জানেন! আমি কিন্তু সকলকে ফ্যাশনের গল্প বলতে ভালবাসি।’’

রক তারকা ফ্রেডি মার্কারি থেকে রাজকুমারী ডায়ানা, সকলকেই সাজিয়েছেন জ়্যান্ড্রা রোড্স।
সেই তিনি সোমবার সারা দিন কলকাতা দর্শন করে, এখানকার গল্প জোগাড় করে কাটিয়েছেন। মোটের উপর নিরুপদ্রবেই। এসেই খবর পেয়েছেন পুরনো গোরস্থানের। বন্ধু ইংরেজ ভাস্কর অ্যান্ড্রু লোগান ও স্থপতি মার্টিন ডেভিসকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটের সেই গোরস্থানে। সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন বালিগঞ্জের সিমা গ্যালারি। সেখানে চলছে ‘সিমা অ্যাওয়ার্ডস শো’। পেন্টিং থেকে ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন— সব দেখে মুগ্ধ শিল্পী। বলছেন, ‘‘২৪ বছর পর কলকাতায় এলাম। এক দিনেই শহরের ইতিহাস থেকে বর্তমান, কত কী দেখে ফেললাম। ভাগ্যিস এলাম!’’
কলকাতার ইংরেজ শাসন, এখানকার ব্রিটিশ-ইতিহাস নিয়ে যেমন শুনতে-জানতে ইচ্ছা করছে, তেমনই আবার এই শহরটা এখন কেমন, তা জানতেও উৎসাহী তাঁরা।
এক কালে জ়্যান্ড্রা শাড়িও ডিজ়াইন করেছেন। জানালেন, প্রথম যে বার এ দেশে এসেছিলেন, শাড়ি দেখে পছন্দ হয়েছিল তাঁর। তার পর শাড়ি তৈরি করেন। তার প্রদর্শনীও করেন এ দেশে এসে। সে ছিল সত্তরের দশক। এ বার বাঙালি সাংবাদিকের পোশাক দেখে জ়্যান্ড্রা বলেন, ‘‘আপনি তো সে সব সময় দেখেননি মনে হয়? তখন এ দেশে বেশির ভাগ মহিলাকেই শাড়ি পরতে দেখেছি। কী সুন্দর সুন্দর সব শাড়ি! এ বার এসে দেখছি সব বদলে গিয়েছে। অন্য রকম সাজগোজ।’’ সে সাজ কি পছন্দ হয়নি? তা নয়। কলকাতা শহর, তার রং, বৈচিত্র দেখে আরও দেখার ইচ্ছা বেড়ে গিয়েছে, নিজেই জানালেন শিল্পী।

সিমা গ্যালারির প্রতীতী বসু সরকারের সঙ্গে জ়্যান্ড্রা রোড্স, অ্যান্ড্রু লোগান, পল কার্টিন, মাইকেল ডেভিস ও টিনা কার্টিন। ছবি: অমিত দত্ত।
সাজপোশাক তো গতিময়তার কথা বলে। তাই তা পরিবর্তনশীল। সব দেশেই বদলেছে। তাই কাজ ছাড়া বেড়াতে এসেও সে সব অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ছে। বলেন, ‘‘এ দেশের তো এক এক জায়গায় এক এক রকম সাজ! আমি আগেও খেয়াল করেছি। সবই খুব সুন্দর। এ বারও দেখছি।’’
শিল্প-সচেতন সংস্কৃতি দেখলে শিল্পীর ভাল লাগে। কথায় কথায় জানালেন নিজেই। জ়্যান্ড্রা বললেন, ‘‘আমার বন্ধুও তো শিল্পী। অ্যান্ড্রুর হাতে তৈরি কাচ আর পাথরের গয়না পরে এসেছি, দেখুন।’’ শুধু জ়্যান্ড্রা নন অবশ্য, পাঁচ জনের যে দল সে সময়ে গ্যালারি দর্শনে বেরিয়েছেন, তাঁদের সকলের পরনেই ছোট-বড় গয়না। সবই অ্যান্ড্রুর বানানো। কোনওটা বেশি জমকালো, কোনওটা তুলনায় হালকা। অ্যান্ড্রু বলেন, ‘‘আমি এই গয়নাগুলোকে বলি ‘ওয়্যারেব্ল আর্ট’। অর্থাৎ, যে শিল্প পরা যায়।’’ কাজ তাঁর অনেক, তবে বন্ধুদের সাজিয়ে রাখতে ভালবাসেন। তাই জ়্যান্ড্রা যেমন আংটি, চুড়ি, ব্রুচ, নানা রকম গয়না পরেছেন অ্যান্ড্রুর তৈরি, তেমনই আবার পল কার্টিন, টিনা কার্টিন ও মাইকেল পরেছেন মূলত ব্রুচ। টিনা বলেন, ‘‘আপনি যদি অ্যান্ড্রুকে চেনেন, তা হলে আপনার কাছে এমন একটা গয়না অন্তত থাকবেই!’’

নিজের তৈরি গয়না পরে অ্যান্ড্রু লোগান। — নিজস্ব চিত্র।
আর জ়্যান্ড্রাকে চিনলে কী পরতে হয়? হাওয়ায় এখনও উত্তর ভাসে, ডায়ানার সাজ দেখতে হয়! কিন্তু এক দিকে রক-পপ তারকাদের সাজাতেন। আর এক দিকে রাজকুমারী। সামলাতেন কী করে জ়্যান্ড্রা? অভিজ্ঞ হাসি ফিরে আসে ঠোঁটে। শিল্পী বলেন, ‘‘ওইটাই তো আসল শিল্প। যে যেমন, তাঁকে তেমন করে সাজাতাম। এখনও তা-ই করি!’’