Advertisement
১১ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2023

দুগ্গি দেখেছেন ‘ডাইনি’! হিন্দি লেখিকার সঙ্গে বাংলার দেবীকে নিয়ে আড্ডায় আমেরিকার কবি

মেয়েদের জীবন, নারীশক্তি, পাঁচালী পড়া এবং নারীবাদের নানা দিক নিয়ে পুজোর মরসুমে আড্ডায় বসলেন আমেরিকার কবি অ্যানি ফিঞ্চ ও কলকাতার হিন্দি লেখিকা অলকা সারাওগী। সঙ্গে রইল আনন্দবাজার অনলাইন।

American poet Annie Finch and Writer Alka Saraogi discuss Durga Puja and culture in Kolkata

কলকাতার হিন্দি লেখিকা অলকা সারাওগী এবং আমেরিকার কবি অ্যানি ফিঞ্চ। —নিজস্ব চিত্র।

সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:০৫
Share: Save:

পুজো দেখতে কলকাতায় এসেছেন। অনেকের মতোই। আবার ততটাও অনেকের মতো নয়। আমেরিকার কবি অ্যানি ফিঞ্চ পুজোর ভিড়ে পর্যটকদের মধ্যেও আলাদা। আমেরিকা থেকে পুজোর কার্নিভাল দেখার টানে এসেছেন তো বটেই। তবে নারীশক্তির আরাধনায় এমন বিরাট উৎসব যে পৃথিবীর কোনও প্রান্তে হতে পারে, তা দেখে বিস্মিত এই নারীবাদী। বাঙালি মহিলার সঙ্গে আলাপ হতেই বলেন, ‘‘আপনাদের দুর্গা আছে! আপনারা বিশ্বের বহু মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে।’’

দুর্গাপুজো দেখা হয়েছে। কালীপুজো দেখে তবে এই দেশ ছাড়বেন। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে সেই বিস্ময় এবং কৌতূহলে ভরা নানা প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে আড্ডায় বসেছিলেন কলকাতার হিন্দি লেখিকা অলকা সারাওগির শরৎ বোস রোডের বাড়ির ছাদে। ইতিমধ্যে পূর্ব থেকে মধ্য, শহরের নানা প্রান্তের প্রতিমা দর্শন হয়েছে। সন্ধিপুজোর মন্ত্রপাঠ, অষ্টমীর অঞ্জলি দেখেছেন। তবে মন পড়ে আছে নারীবাদেই। বার বার মনে ঘুরছে, এত দেবী এ দেশে! এ তো বেশ অন্য রকম ব্যাপার।

পুরুষতান্ত্রিকতার বাইরেই কি তবে এ সংস্কৃতি? মেয়েরা কি আলাদাই সম্মান নিয়ে বাঁচেন এখানে? এমনই সব কথা ভাবছেন কি ভিন্‌দেশি কবি?

American poet Annie Finch and Writer Alka Saraogi discuss Durga Puja and culture in Kolkata

শহরের একটি পুজোমণ্ডপে অ্যানি ফিঞ্চ। —ইনস্টাগ্রাম।

বয়স ৬০ পেরিয়েছে। ততটাও একরৈখিক নয় তাঁর সমাজবোধ। ‘মি টু’ আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ ছিলেন তিনি। প্রথা থেকে প্রার্থনা— সবের মধ্যেই যে রাজনীতি থাকে, তা তাঁর উপলব্ধির বাইরে নয়। তবু জগৎটা অন্য চোখে দেখেন। বাঙালি সাংবাদিকের সঙ্গে দুর্গা-লক্ষ্মী-কালী নিয়ে গল্প করতে করতে বলেন, ‘‘আপনাদের দেশে অন্তত এত জন দেবী আছেন। তাঁদের পুজো করা হয়। নানা প্রদেশের স্ত্রী আচার আছে। সে সব বেঁচেও আছে। আমাদের নেই। তাই বলছি, সেগুলি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝি।’’ লক্ষ্মীর পাঁচালির কথা প্রথম শুনে পড়তে বলেন কবি। পড়ার ভঙ্গি, বিষয়বস্তু— সবই টানে তাঁকে। সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে যে এ ভাবে হলেও নারীদের আলাদা জায়গা আছে, তা তাঁর মনে ধরেছে।

বর্তমান ভারতে প্রচলিত ভাবনার থেকে কিছু ক্ষেত্রে আলাদা অ্যানির নারীবাদ। এমনই মনে করেন অলকা। এ দেশের লেখিকা অলকা। লক্ষ্মীপুজো, লক্ষ্মীমন্ত, লক্ষ্মীর পাঁচালী নিয়ে যেমন আহ্লাদ আছে, তেমনই আছে রজনীতি। আড্ডার মাঝেও সে সবই মনে থাকে অলকার। তবে গত কয়েক দিন ধরে মেয়েদের জীবন নিয়ে অ্যানির সঙ্গে নানা কথা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘অ্যানি নারীশক্তি নিয়ে যে সব কথা বলছিলেন, তার অধিকাংশই আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের আলোচনায় এখনও তেমন ভাবে ঠাঁই পায় না। ওঁর সঙ্গে পুজোমণ্ডপে গিয়ে বেশ অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল।’’ অ্যানির যদিও মাঝেমাঝেই গুলিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় দর্শন আর বাস্তব, তবে এ দেশের মেয়েদের জীবন নিয়ে যে কোনও আলোচনা হলেই উৎসাহ বোধ করছেন তিনি।

American poet Annie Finch and Writer Alka Saraogi discuss Durga Puja and culture in Kolkata

পুজোর দেখার মাঝে অ্যানি এবং অলকা। —সংগৃহীত।

সমান অধিকারের জন্য পুরুষদের মতো হয়ে উঠতে হবে না নারীদের। মেয়েরা নিজের নিজের মতো হয়ে থেকেই অধিকার পেতে পারেন। পাওয়া উচিত। তার জন্য শার্ট-ট্রাউজার্স পরে লড়াই কেন করতে হবে! পুরুষদের মতো কেন আচরণে হতে হবে? এমনটাই অ্যানির বক্তব্য।

এত দেবী আছে মানে এ সমাজে মেয়েদের নিজস্ব জায়গাও আছে। অ্যানির দৃষ্টিভঙ্গি তা-ই বলছে। নানা দেশের নানা দেবীকে নিয়ে গবেষণা তাঁর। প্রাচীন গ্রিস থেকে লাতিন আমেরিকা, বিভিন্ন জায়গার সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করেন। নিজের দেশে সে ভাবে কোনও দেবীর জায়গা নেই। দেবতাই সর্বস্ব। তবে ‘উইচ’ সংস্কৃতি আছে।

‘উইচ’ মানে ডাইনি? ঠিক। ডাইনিই। তবে অ্যানির ‘উইচ’ শয়তান নয়। শ্বেতাঙ্গিনী কবি বলেন, ‘‘উইচরা হলেন হাসিখুশি নারী। তাঁরা আনন্দে থাকেন। পুরুষতন্ত্রের সব চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। আমিও উইচ ধর্মে বিশ্বাসী। আমরা একে অপরকে উইচ বলি। আমরা যে কোনও সংস্কৃতির দেবীকে আরাধনা করতে পারি। মূল দেবী আমাদের ডায়ানা। তবে দেবী মানেই তিনি আরাধ্য আমাদের সংস্কৃতিতে।’’ অ্যানি আরও বোঝাতে থাকেন, ‘‘আমরা মনে করি, যে নারী নিজের মতো করে বাঁচতে পারেন, তিনিই আনন্দে থাকেন। জোর করে পুরুষদের মতো হয়ে উঠতে চাইলে কেউ আনন্দে থাকেন না। যে কোনও নারীর নিজের মতো করে, নিজের সাজ, নিজের অভ্যাস নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে।’’ দুর্গার মতো কোনও দেবীকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে যে পুজো করা হচ্ছে, তা দেখে তাই ভাল লেগেছে তাঁর।

দেবীকে আরাধনা দিন কয়েকের বিষয়। তার সঙ্গে বাস্তবের অনেক ফারাক আছে, সে সব কথাও উঠে আসে আড্ডায়। তা কি আর অ‌্যানি জানেন না? সে উপলব্ধিও হয়েছে পুজোর ভিড়ে মণ্ডপ দেখতে গিয়ে। তবু মনে করেন, যেখানে দেবীপুজোর চল আছে, সেখানে মেয়েদের সম্মানের জায়গা তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ একটু বেশি। তিনি বলেন, ‘‘শ্বেতাঙ্গিনী নারীরা আসলে সবচেয়ে বেশি পীড়িত। তা এখনও গোটা বিশ্ব বোঝে না। তাঁরা হয়তো অনেকের চেয়ে অনেক বেশি অর্থলাভ করেছেন, আপাত ভাবে মসৃণ জীবন তাঁদের। কিন্তু একটি আরোপিত সুখের ধারণায় বন্দি তাঁরা। সেই খাঁচা থেকে বেরোতে পারলে সুখী হবেন। এই যে ছোট ছোট স্ত্রী আচার এখনও এখানে বেঁচে আছে, তা প্রকৃতির সঙ্গেও যোগাযোগটা বজায় রাখে। যেমন আপনারা বলছেন, পূর্ণিমার রাতে দেবীর পুজো হয়। তার মানেই তো এখনও এ সমাজ প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়। সেই সংযোগটা এখানেও কেটে যাচ্ছে। তা গেলেই আসল বিপদটা টের পাবেন।’’

অলকা এ বার উপলব্ধি করেন অ্যানির কথা। প্রকৃতির সঙ্গে সমাজের যোগ যে ধীরে ধীরে ছিন্ন হচ্ছে, তা-ও মানেন তিনি। বলেন, ‘‘অ্যানি যে সব কথা বলছেন, সে সব উপলব্ধি করার হয়তো এখনও আমাদের প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু ওঁরা তো বলছেন নারীর প্রকৃতিগত গুণ ধরে রেখে, তা উদ্‌যাপন করার কথা। আমাদের এমন অনেক আচার আছে, যার সঙ্গে ধর্ম কম, সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি বেশি জড়িয়ে। সে সব ভুলে গিয়ে সত্যিই তো লাভ নেই কারও।’’ অলকার আরও বক্তব্য, অনেকে শুধু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজের স্বভাবে বদল আনছেন। নারীর কোমল, নম্র ভাব কেন মুছে ফেলতে হবে কর্মক্ষেত্রে উন্নতির জন্য? অ্যানির সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অলকাও। আর তা দেখে মুখে হাসি ফুটছে অ্যানির। মনে করাচ্ছেন, এ দেশে যেটুকু নরম ভাব ধরা আছে, যান্ত্রিকতার ভিড়ে তা-ও হারিয়ে গিয়েছে পশ্চিমে। তাই সে দেশে এ সব প্রশ্ন আগে তুলতে হচ্ছে। এ দেশে এত দেবী আছেন, যাঁরা রূপ-গুণে নারী, আবার বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতার প্রতীকও। দুর্গা যেমন স্বয়ং শক্তির প্রতীক। তাঁদের মনে রেখে যদি নারীস্বভাবকে সম্মান করা যায়, তবে পশ্চিমের সমাজের মতো দুর্দিন দেখতে হবে না বলেই মনে করেন কবি।

পাঁচালি পাঠ, আমেরিকার উইচদের ছড়া পড়ার মাঝে মেয়েদের জীবন আর নারীবাদ সংক্রান্ত এমন সব তত্ত্ব নিয়ে চলেছে এবং চলতেই থাকবে দেবীপক্ষের আড্ডা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE