মোদী জমানায় সরকারি পরিসংখ্যানের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। ফাইল চিত্র।
‘দরিদ্র’ তো বটেই। ভারত এখন এক ‘চরম অসাম্যের দেশ’ও। আজ ‘বিশ্ব অসাম্য রিপোর্ট’ জানাল, ভারতের নীচের সারির অর্ধেক মানুষের হাতে দেশের সম্পদের প্রায় কিছুই নেই। অথচ ধনীরা অত্যন্ত ধনী। ২০২১-এ দেশের মোট আয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগই গিয়েছে দেশের উপরের সারির এক শতাংশ মানুষের হাতে। অথচ নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষকে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ নিয়েই দিন গুজরান করতে হয়েছে।
প্যারিস স্কুল অব ইকনমিকস—এ অবস্থিত ‘ওয়র্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব’-এর এই রিপোর্ট তৈরিতে সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি। রিপোর্টের মুখবন্ধে নোবেলজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডুফলো লিখেছেন, বিশ্বের যে সব দেশে অসাম্য চরমে, ভারত এখন তার মধ্যে পড়ছে।
শুধু ভারতে অসাম্যের ছবি তুলে ধরা নয়, সেই অসাম্য কতটা গভীরে, তা বুঝতে নরেন্দ্র মোদী জমানায় সরকারি পরিসংখ্যানের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘গত তিন বছরে অসাম্য নিয়ে সরকার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তার গুণগত মান গুরুতর ভাবে খারাপ হয়েছে। ফলে অসাম্যের ছবিটা সম্প্রতি কতটা বদলেছে, তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
অর্থনীতিবিদেরা রিপোর্টে বলছেন, কোভিড-সঙ্কটে গোটা বিশ্ব জুড়েই ‘বিলিয়নেয়ার’ বা কোটিপতিদের সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বিশ্বের মাত্র ২,৭৫০ জন বিলিয়নেয়ারের হাতে এখন পৃথিবীর ৩.৫ শতাংশ সম্পদ। ১৯৯৫ সালে এঁদের হাতে বিশ্বের ১ শতাংশ সম্পদ ছিল। কোভিডের সময়ই ধনীরা আরও ফুলেফেঁপে উঠেছেন। নীচের সারির অর্ধেক মানুষের কাছে এই ধনীদের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ সম্পদ রয়েছে।
ভারতের সম্পর্কে অসাম্য রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্রয়ক্ষমতার তুলনার নিরিখে ভারতের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বছরে ২ লক্ষ ৪ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু আয়ের দিক থেকে নীচের সারির অর্ধেক মানুষের গড় আয় মাত্র ৫৩ হাজার ৬১০ টাকা। উপরের সারির ১০ শতাংশ মানুষের আয় তার প্রায় ২০ গুণ। ১১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫২০ টাকা।
সম্পদের ক্ষেত্রে অসাম্যের মাত্রা আরও বেড়েছে। দেশের পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ ৯ লক্ষ ৮৩ হাজার ১০ টাকা। কিন্তু নিচুতলার ৫০ শতাংশ পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৬৬ হাজার ২৮০ টাকা। উপরের সারির বা ধনীতম ১ শতাংশ বা ১০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় মধ্যবিত্তও যথেষ্ট গরিব। ধনীতম ১০ শতাংশ পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ ৬৩ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকার বেশি। ধনীতম ১ শতাংশ পরিবারের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ৩ কোটি ২৪ লক্ষ টাকার বেশি। সেই তুলনায় মধ্যবিত্ত পরিবারের গড় সম্পদের পরিমাণ মাত্র ৭ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব’-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে লিঙ্গ বৈষম্যও চরমে। মোট আয়ে মহিলা শ্রমিক-কর্মীদের ভাগ মাত্র ১৮ শতাংশ। এই হার গোটা বিশ্বের মধ্যেই নিম্নতম। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতেই মহিলাদের আয়ের ভাগ ১৫ শতাংশ। চিন বাদ দিয়ে এশিয়ার দেশগুলিতে এর হার ২১ শতাংশ।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ জমানায় ভারতে আয়ের অসাম্য চরমে ছিল। ১০ শতাংশ ধনীতম মানুষের ঝোলায় দেশের মোট আয়ের অর্ধেক চলে যেত। স্বাধীনতার পরে সমাজতন্ত্রের অনুপ্রেরণায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলে অসাম্য কমে। ধনীতম ১০ শতাংশ মানুষের আয় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে আসে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া, উদারীকরণ শুরুর পরে বিশ্বের মধ্যে ভারতে আয়-সম্পদের অসাম্য প্রবল ভাবে বেড়েছে। উপরের সারির ১ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংস্কারের ফায়দা পেয়েছেন। কিন্তু কম ও মাঝারি আয়ের মানুষের আয় ততটা বাড়েনি। দারিদ্র বজায় থেকেছে।
অভিজিৎ কিছু দিন আগেই দেশের মানুষ চরম কষ্টে রয়েছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। রিপোর্টের মুখবন্ধে অভিজিৎ ও এস্থার লিখেছেন, আর্থিক বৃদ্ধিকে বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভারত ও চিনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আলগা করা হয়েছিল। এবং উদারীকরণের সেই যুক্তি দিয়েই বলা হয়েছিল যে, অসাম্য নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। তার ফলেই ভারত এখন অন্যতম চরম অসাম্যের দেশ। চিনেরও এই অবস্থায় পৌঁছনোর যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy