চিত্তরঞ্জন পার্কে বাঙালির পাত থেকে মাছ কেড়ে নেওয়ার অভিযোগে সরব রাজনীতিকরা। চলছে চাপানউতোর এবং ক্ষত মেরামতির চেষ্টাও। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন বঙ্গ চিন্তাবিদরাও।
বিষয়টিকে ‘নিরামিষতন্ত্রের দমনপীড়ন’ হিসেবে দেখছেন প্রাক্তন সাংসদ তথা আমলা জহর সরকার। তাঁর কথায়, “আমি জানতাম এই রকম জুলুম হবে। বারংবার প্রমাণ হচ্ছে যে, নিরামিষাশীরা কিছুতেই ভারতের ৩০ শতাংশের বেশি নয়, অথচ সেখানে তারা ক্রমাগত ৭০ শতাংশ আমিষাশীদের ওপর দাদাগিরি চলিয়ে যাচ্ছে — একমাত্র রাজনৈতিক শক্তির জোরে। হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্ব কায়েম করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে।” তাঁর কথায়, “হিন্দু ধৰ্ম বরাবর বহুত্বে বিশ্বাস করে এসেছে কিন্তু এখন তাকে সঙ্কীর্ণ একরূপ অভিন্ন ব্র্যান্ডে পরিণত করা হচ্ছে। আহারের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। মাছ বাঙালিদের শুধু খাদ্য নয়, আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক। ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের হেনস্থা আর অপমান করা হচ্ছে আর এর পিছনে আরএসএস, বিজেপি কর্তাদের ইন্ধন নিশ্চয় আছে।”
ইতিহাসবিদ তথা জেএনইউ-এর প্রাক্তন অধ্যাপিকা তনিকা সরকারের বক্তব্য, “রামনবমী বা অন্য কোনও পবিত্র দিনে মাছ না খাওয়ার বিষয়টি আদৌ সর্বভারতীয় নয়। বরং আমাদের পুজোর দিনে বা অনুষ্ঠানে মাছ-মাংসের ব্যাপার থাকে। বিয়ের সময় মাছ দেওয়া হয় শুভ হিসেবে। হিন্দির মতো খাদ্যাভাসকেও এই সরকার ও দল চাপিয়ে দিতে চাইছে। এর আগেও দিল্লিতে পুজোর সময় বলেছিল, আমিষ খাবার পুজো চত্বরে বিক্রি করা যাবে না। আসলে ওরা মাঝে মাঝে জল মাপে। এক ধাক্কায় না হলেও মাঝে মাঝেই ভয় দেখাতে থাকে শাসক দলের পোষা দুর্বৃত্তরা। গণপ্রহারের ঘটনাও চলছে গরু নিয়ে যাওয়ার সন্দেহে।” তনিকা মনে করেন, চব্বিশে সাংসদ সংখ্যা কমার পরে বিজেপি হিন্দুত্বের রাশটা আরও শক্ত হাতে ধরতে চাইছে। বললেন, “গোটা ভারতে এক রকম রাম চলে না। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম রাম রয়েছেন বিভিন্ন রকম রামায়ণ রয়েছে। বিজেপি রক্তপিপাসু এক রামের ছবি চাপিয়ে দিতে চাইছে সর্বত্র। চিত্তরঞ্জন পার্কের বিষয়টি ওরা সামলে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু রেশটা থেকেই যাচ্ছে। এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা এককালীন নয়।”
সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী কিছুটা মজার ছলে বলছেন, “আমরা তো মাছের উপরে বেঁচে থাকি। বাঙালির নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম একটা কারণ হল তাঁরা মৎস্যভোজী।” তাঁর কথায়, “এই সনাতনীরা নীতিবোধ দেখান আগে, তারপর অন্য কথা বলবেন। আমি হিন্দুও নই, খ্রিস্টানও নই বা মুসলমান। আবার কড়া ধর্মনিরপেক্ষও নই। আমি নীতিবোধে বিশ্বাসী। আমাদের হাতের কাছেই রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, যিনি নৈতিকতাকে জীবনদেবতায় পরিণত করেছেন। তা তাঁর নিজেরই অংশ। এরা কী ধরনের সনাতনী? অন্য জায়গায় গিয়ে নিজেদের বিজ্ঞাপন করুন, আমাদের শেখাতে আসবেন না।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)